বিশেষ সংবাদদাতা : বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে বহুমুখী কারসাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিশোধনকারী মিলমালিকদের প্রস্তাব অনুযায়ী আরেক দফা দাম বাড়াতে না পেরে তারা এই কারসাজি করছেন। তারা বাজারে ভোজ্যতেলের বিশেষ করে সয়াবিনের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। রমজানের আগে বেশি মুনাফার আশায় বাজারে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে গত ১৬ ডিসেম্বর সয়াবিন, পামঅয়েল আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়।
অপরদিকে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে মিলমালিক কর্তৃপক্ষ বলছেন, কারসাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন। বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ব্যাপক। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, রমজানকে কেন্দ্র করে আরেক দফা সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে চায় দেশীয় ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা। পরিশোধনকারী মিলমালিকদের পক্ষ থেকে দাম আরও এক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে। প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মালিকপক্ষ গিয়েছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা তাদেরকে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুরোধ করলে তারা তা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর থেকেই মিলমালিকরা নানা কৌশলে সয়াবিন তেল বিশেষ করে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ে নানামুখী কারসাজি করছেন।
ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতি, অপরদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কারসাজি- দুটো মিলে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১৬৫ থেকে ১৭৩ টাকায় কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষ এখন অনেকটাই দিশেহারা। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনের লাইনও বড় হচ্ছে প্রতিদিন। রমজানকে কেন্দ্র করে গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০০ টাকা লিটার দরে সয়াবিন তেলসহ ছোলা, খেজুর, চিনি ও মসুর ডাল এই পাঁচ পণ্য বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারসাজির মাধ্যমে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল করার অপতৎপরতা নতুন কিছু নয়। দাম বাড়ানো এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগেরও অন্ত নেই। ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের দাম। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে নিত্যপণ্যের সঙ্গে ভোজ্যতেলের দাম ব্যাপকহারে বাড়ানো হয়েছে। সব শেষ গত বছর যেভাবে বাজার থেকে ভোজ্যতেল উধাও করে দাম বাড়ানো হলো, তা এককথায় নজিরবিহীন।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আবার ভোজ্যতেলের বাজারে দেখা দিয়েছে সেই দুর্বৃত্তপনার ছায়া। জানা গেছে, করোনার মধ্যেও বিশ্বে সয়াবিনের উৎপাদন বেড়েছে। তবু বেড়েছে সয়াবিনের দাম। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উৎপাদক দেশগুলো রফতানি বাড়ালেও ডলারের বিপরীতে ওই দেশগুলোর মুদ্রা শক্তিশালী হওয়ায় সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। মার্কিন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সবক্স-এর তথ্যানুযায়ী, গতবছর থেকেই সয়াবিন থেকে তৈরি প্রাকৃতিক জ্বালানি বায়োডিজেলের উৎপাদন কমেছে। এতে বেড়েছে সয়াবিন তেলের উৎপাদন। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যেখানে বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয়, সেখানে ২০২০ সালে হয়েছিল ৬ কোটি ১০ লাখ টন। তারপরও কেন দাম বাড়লো? কারণ হিসেবে ইনডেক্সবক্স বলছে, উৎপাদক দেশগুলো রফতানি শুল্ক বাড়িয়েছে বলেই দাম বেড়েছে। সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে চীন ১ কোটি ৮০ লাখ টন ও যুক্তরাষ্ট্র ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৮০ লাখ টন। ২০২০ সালে বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৬ কোটি ১০ লাখ টন। করোনার কারণে সয়াবিন তেলের উপজাত সয়ামিলের (সয়াবিন থেকে তৈরি খাবার) চাহিদাও কমে যায়, এ কারণেও বাড়তে পারে তেলের দাম। জানা গেছে, সম্প্রতি সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বাণিজ্য সচিবের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আবদুর রহিম খানের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ও ভোজ্যতেল পাইকারি ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা আবারও সয়াবিন, পামঅয়েলের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে।
কিন্তু সরকার রমজানের আগে কোনোভাবেই সয়াবিন, পামঅয়েলের দাম বাড়াতে রাজি নয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও এখন সয়াবিন, পামঅয়েলের বাজার স্থিতিশীল। অনেকটা কমতির দিকে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার পেছনে রয়েছে মূলত পাঁচটি পরিশোধনকারী কারখানার সিন্ডিকেট। তারাই ঠিক করে দেয় বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কত হবে। দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানিতে সবগুলো প্রতিষ্ঠান সক্রিয় নেই। এতে প্রতিযোগিতাও কমেছে। সম্প্রতি নূরজাহান গ্রুপ, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ও মোস্তফা গ্রুপ ভোজ্যতেল আমদানি শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তবে এসব কোম্পানি তেলের বাজারে কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে সিটি গ্রুপ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে টিকে গ্রুপ। তৃতীয় অবস্থানে মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। ভোজ্যতেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখনও মূলত এদের হাতেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, দামের কারসাজি ধরতে কয়েকবার রিফাইনারি কারখানার প্রধান কার্যালয়গুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান চালানো হয় সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও টিকে গ্রুপে। এ ছাড়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং টিম মেঘনা ও সিটি গ্রুপের মিলও পরিদর্শন করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্য সচিব আবদুর রহিম খান জানিয়েছেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে যথেষ্ট পরিমাণে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। কোম্পানিগুলোও বলছে, সয়াবিন সরবরাহে কোনও সমস্যা নেই। তাহলে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অসৎ উদ্দেশ্যে কেউ সয়াবিন তেল মজুত করছে কি না আমরা এখন তা খতিয়ে দেখবো। উল্লেখ্য, দেশে প্রতিবছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন তেল দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ২০ থেকে ২১ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন। ট্যারিফ কমিশন সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৫ টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে।
এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮০ টন ও পামতেল ৭ লাখ ১১ হাজার ৪৪৪ টন। এর মধ্যে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। এছাড়া, গত জানুয়ারিতে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন। গত এক বছরে এত বেশি সয়াবিন বীজ আমদানি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আরও ৪ লাখ ২১ হাজার ৯৬৬ টন তেল আমদানি পাইপলাইনে রয়েছে। রমজান শুরু হতে এখনও যে সময় বাকি আছে, তার আগেই পাইপলাইনে থাকা ভোজ্যতেল চলে আসবে। এ পরিস্থিতিতে সয়াবিনের কোনও সংকট হওয়ার কথা নয়। এছাড়া, ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে গত ১৬ ডিসেম্বর সয়াবিন, পামঅয়েল আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিয়ে কারসাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন।
রমজানকে কেন্দ্র সরবরাহ আরও বাড়ানো হবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দর যে হারে বেড়েছে, সেই হারে দেশে এখনও সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়নি। কোম্পানিগুলো অনেকটা লোকসানেই বিক্রি করছে। কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দাম কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তা মানছে না। কতদিন এভাবে চালানো যাবে তা নিয়ে কোম্পানিগুলোই সন্দিহান বলে জানিয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে কাওরান বাজারের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী তোফাজ্জেল হোসেন জানিয়েছেন, আমদানিকারকরা বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। তারা ঠিকমতো সরবরাহ করছে না। সয়াবিনের সরবরাহ নিতে চাইলে নানান শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এতে বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে চাপা সংকট তৈরি হচ্ছে। এতে রমজানকে সামনে রেখে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।