ওমর শেহাব : সম্প্রতি আংশিক বাতিলকৃত শিক্ষাক্রম ২০২২ এর দুটি বড় সমস্যার কথা আমি এর আগে একটি পত্রিকায় লিখেছিলাম। প্রথমটি ছিল অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা ঠিক মতো আমলে নিতে না পারা আর দ্বিতীয়টি হলো শিক্ষকদের গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নেওয়া। এরপর অর্ন্তবর্তী সরকার আবার ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের বইগুলোকেই একটু পরিবর্তন করে ২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে দিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি শিক্ষা উপদেষ্টা জানিয়েছেন তিনি নিজেও বলতে পারবেন না কবে বাচ্চারা হাতে সব বই পাবে।
তবে আজকের লেখা অন্য একটি বিষয়ে, ঠিক সময়ে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া নয়।
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তার সহকর্মী শিক্ষকদের বলেছেন বেতন ভালো না লাগলে চাকরি ছেড়ে দিতে। সেটিও আরেকদিনের জন্য তুলে রাখলাম।
আমি শিক্ষাক্রম ২০২২ এর সাথে জড়িত থাকার কারণে এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি কিছতা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি আতংকের সাথে লক্ষ্য করছি, আমাদের সময় সামাজিক গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে যেমন মানুষকে খেপিয়ে তোলা হয়েছিল, এবারও তাই হচ্ছে। বর্তমানে যারা পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের সাথে জড়িত তাদেরই কেউ কেউ কীভাবে এই বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটি আমি আগের একটি লেখায় বলেছি। তবে সে সময় যারা ভুল তথ্য ছড়িয়েছিলেন তারা এবারের অনলাইন উষ্মার গ্রাহক প্রান্তে আছেন।
একটি ব্যাপার অবশ্য ব্যতিক্রম। আমরা যখন কাজ করেছি তখন এর সাথে জড়িতদের সবাই মোটামুটি কীভাবে কাজ করতে হবে সে ব্যাপারে একতাবদ্ধ ছিলেন। আমি বিভিন্ন মিটিংয়ে সবসময় সবার মধ্যে এক ধরনের দিন বদলে দেওয়ার উদ্দীপনা দেখতে পেয়েছি। তবে মনে রাখতে হবে আমি ছিলাম জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উদ্যোগগুলোতে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কাজগুলোতে নয়। যেহেতু প্রশিক্ষানার্থী শিক্ষকদের অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের হুমকি ধামকির খবর ঠিকই পেতাম। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ছিল একেবারেই ভিন্ন। সবার মধ্যে একটি অন্য ধরনের একতা ছিল। এবার মনে হচ্ছে সেখানেই একটি গলদ রয়ে গেছে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আমরা উদ্বেগজনক প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছি। এর অর্থ হলো বোর্ডের নেতৃত্ব সবার মধ্যে একইরকম উৎসাহ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা কেউ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করলে তার প্রতি বৈরি আচরণ করছেন। একটু মনে করিয়ে দিতে চাই আগের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময় অভিভাবকদের উদ্বেগ আমলে নেওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে আমি এই পাতাতেই গত জানুয়ারিতে স্বনামে লিখেছিলাম যার জন্য আমাকে পরবর্তী কোনো সভাতেই কোনো কথা শুনতে হয়নি, উপরন্তু আমাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। সেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আমরা কি জানতে পেরেছি?
একটি অনলাইন দৈনিকে এসেছে ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী সব অংশীজন কাজ করলে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না কাউকে।‘ এ রকম আমাদের সময় খুব একটা দেখিনি। আমাদের সময় পরিকল্পনার পর্যায়ে সবাই চমৎকারভাবে কাজ করেছিলেন বলেই ২০১৯ সালের শেষের দিকে একটি চমৎকার রুপরেখা প্রকাশ করা হয়েছিল (আমার মতে অবশ্য একটি ঘাটতি ছিল- সেটি হলো শিক্ষকদের দৈনন্দিন শ্রমবন্টনের কোনো প্রাক্কলন না থাকা)।
প্রতিবেদনটির সারমর্ম হলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে একজন ব্যক্তি নাকি অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি অন্যদেরকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছেন না। সব বিষয়ের বইতেই তিনি নাকি নাক গলাচ্ছেন। শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে নাকি তার বিশেষ ‘খাতির’ আছে। আবার দফতরের গাড়ি সুবিধারও নাকি তিনি অপব্যবহার করছেন। আশা করি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এসবের তদন্ত করবে।
একই রকম অভিযোগ করেছেন গতবার শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কারাগারে যাওয়া একজন অভিভাবক আবুল হাসনাত কবীর। তিনি বলেছেন, ‘বই পরিমার্জনের কথা বলা হলেও এটা খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হয়নি। এই স্বল্প পরিবর্তনের জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই। আমি সরাসরি বলেছি এনসিটিবিকে। বই নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তাহলে তারা কেন এখানে আসলেন? কোন শ্রেণির বইয়ে কোন কন্টেন্ট যাবে এটা নিয়েও তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই। এক্ষেত্রে বাড়তি যে অর্থ ব্যয় হলো সেটার দায় নেবে কে?’ এর অর্থ হলো হয়, অভিযোগটি সত্যি অথবা ভেতরে কেউ একজন সেই ব্যক্তির ওপর ক্ষেপে আছেন।
যাই হোক, এটির মাধ্যমে আমরা অভিভাবকদের কাছে কি বার্তা দিচ্ছি? আমরা বার্তা দিচ্ছি যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নেতৃত্ব সংস্কার প্রক্রিয়াটিতে শৃঙ্খলা আনতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এ কারণে পত্রিকায় কী সংস্কার হচ্ছে এটি নিয়ে খবর আসছে না, খবর আসছে কে কার উপর মাতবরি করছে বা করতে না পেরে রেগে আছে। এরপর যদি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষার মান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হন তাহলে কি তাদের দোষ দেওয়া যাবে? গাড়ির ব্যাপারটি অবশ্য আমার দৃষ্টি কেড়েছে। বিদেশে থাকার কারণে আমি বেশিরভাগ মিটিং করেছি অনলাইনে, আমার যখন গভীর রাত। কিন্তু দেশে থাকতে কয়েকবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সভায় গিয়েছি। যেহেতু পুরো কাজটিই বিনে পয়সায় করেছি, খামাখা যাতায়াতের খরচ চাওয়ার কথা মাথায় আসেনি (একবার খালি দশহাজার টাকা পেয়েছিলাম একটি পাঁচদিনব্যাপী আবাসিক কর্মশালার জন্য)। আবার কখনও যদি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কোনো কমিটিতে থাকি তাহলে বোঝার চেষ্টা করবো গাড়ি কে পায় ও কেন পায়!
একই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘কয়েক দশক থেকে বই ছাপানোর কাজ করেন এমন একজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এনসিটিবির বেশিরভাগ লোক অযোগ্য। তাদের বাস্তবিক অভিজ্ঞতার অভাবে অযথা ভুল খোঁজেন। আবার যিনি যে কাজের উপযুক্ত নয় তাকে দিয়ে সে কাজ করালে ভুল বেশি হবে। কিন্তু যারা অভিজ্ঞ, তাদের মূল্যায়ন নেই। বই ছাপানোর কাজে বিলম্ব হওয়ার পেছনে এটাই আসল কারণ। আমার কাছে যে-সব তথ্য আছে, তাতে দেখেছি অন্য বছরের তুলনায় এবার ভুলের সম্ভাবনাও বেশি থাকছে। বছর শুরু হলেই আপনারা সেটা দেখবেন।’
প্রিয় পাঠক, একজন অভিভাবকের কথা কল্পনা করুন যার ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর সামর্থ্য নেই, নামীদামী হাইফাই বিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য নেই। তিনি যখন এসব কথাবার্তা পত্রিকায় দেখবেন তার কেমন অনুভূতি হবে? তিনি দেখবেন, সংস্কারের সাথে জড়িতরা একে-অপরের ব্যাপারে প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন, প্রকাশকরা আগে থেকেই বলে দিচ্ছেন বইগুলো খারাপ হতে যাচ্ছে। একটি অক্ষম ক্রোধ বুকের ভেতরে দিনদিন বাড়তে দেওয়া ছাড়া তার আর কিছু করার আছে? আমি যেই শিক্ষাক্রমের সাথে জড়িত ছিলাম সেখানেও ঠিক একই সমস্যা ছিল। অন্য কিছু কারণে অভিভাবকদের ভিতরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল যেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিগত সরকার পাত্তা দেয়নি। এখন তারা তার ফলাফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
আপনি যদি এতটুকু পড়েই বিচলিত হয়ে যান, তাহলে আপনার জন্য আমার দুঃসংবাদ আছে। এই লেখার শিরোনামে আমি বলেছি পুরনো নাটক ফিরে এসেছে। এতক্ষণ যা বললাম তা হলো নাটকের প্রথম অংক। একজন বিশেষজ্ঞের উপর শুধু বোর্ডের ভেতরের নয়, বাইরের অনেকেও ক্ষেপে আছে। এই অনেকেই কিন্তু আংশিক বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমে তার পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছিলেন। তবে ইদানীং সামাজিক গণমাধ্যমে তারা তার বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করছেন সেটি আমার কাছে ভারি অন্যায় মনে হচ্ছে। সেসব আক্রমণে তার ব্যক্তিজীবন ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ঠিক যেমন এর আগে একই প্রক্রিয়ায় জড়িত অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও অধ্যাপক সামিনা লুৎফার বিরুদ্ধে শায়খ আহমাদুল্লাহর অনুসারীরা হুমকি ধামকি দেওয়ায় সরকার প্রথম কমিটি ঘোষণা করেই আবার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।
আমি বুঝি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও এক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক রাজনীতি এই দুটি ধারার মধ্যে চর দখলের লড়াই চলছে। কাজেই এর ছাপ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটিতেও পড়বে। কিন্তু এটি জাতীয় সমস্যা এই অজুহাত যথেষ্ট নয়। কেন আমি একই নাটকের পুনরাবৃত্তি বলছি? আমরা যখন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সাথে জড়িত ছিলাম তখন অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একইভাবে (উপরেরই কয়েকজন) অপপ্রচার করেছিলেন। আমরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যক্তিগত পরিসরে সেসব অভিযোগ খণ্ডনের চেষ্টা করেছি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ছিল অনুপস্থিত। অথচ এটি তাদেরই প্রকল্প! এবার পাশার দান উল্টে গেছে। কিন্তু যথারীতি তারা অনলাইনে তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এসব প্রচারণার প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তাদের পাশে একই পরিসরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কোথায়? তাদের সাথে আমার দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু একটি ব্যাপারটি সত্য যে যখন যিনি দায়িত্বে থাকবেন তাকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে।
এখন পুরো পৃথিবী চলে গেছে অনলাইনে। মানুষ তাদের খবর পায়, সত্য-মিথ্যা যাই হোক, ফেসবুক, ইউটিউব, আর টিকটক থেকে। এইসব জায়গায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উপস্থিতি কোথায়? জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তা নটা-পাঁচটা অফিস করেন বলে তাদের বিরুদ্ধে যারা অনলাইনে অপপ্রচার চালায় তারাও ঠিক সেই সময়টাতেই অপপ্রচার চালায় তা তো নয়। তাহলে কেন তাদের একটি দফতর থাকবে না যেটি দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা অনলাইনের আসা যেকোনও দাবির সত্যতা যাচাই করে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবে? এটির জন্য কত টাকা লাগে?
সারাদিন কাজ করে বাসায় ফিরে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত অভিভাবক যদি অনলাইনে দেখেন তাদের সন্তানদের পড়ানোর পরিকল্পনা সরকার ঠিকমতো করছে না আর সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য নেই, তাহলে সেটি শুধু ব্যর্থতাই নয়; এটি অভিভাবকদের প্রতি এক ধরনের অবহেলা। আর এটি যদি দিনের পর দিন চলতে থাকে, তাহালে অবহেলা থেকে এটি হয়ে যায় যে ঔদ্ধত্য। গত জানুয়ারিতে আমি একটি পত্রিকায় লিখেছিলাম, ‘পৃথিবীর যে কোনো সরকারই সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়ে কাজ করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই কাজ করা আরও কঠিন। আমি লিখে দিতে পারি, এই দেশের প্রত্যেকটি মানুষ এই বাস্তবতা বোঝেন। কাজেই সরকার যখন একটি নতুন উদ্যোগ নেয়, এতে প্রাথমিক ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি থাকে, সবাই বোঝেন যে এতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। কিন্তু মানুষ কষ্ট পান, যখন দেখেন কোথাও অবহেলা করা হচ্ছে, অথবা তাদের কথা কেউ শুনছেন না কিংবা চুরিচামারি করে তাদের করের টাকা শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।’ কেন আবার একই কথাই লিখতে হলো?
লেখক: তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী, আইবিএম থমাস জে. ওয়াটসন রিসার্চ সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র