নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিন বাসায় ছিলেন বলেই আদালতের কাছে দাবি করেছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী। আদালতের কাছে নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘মাননীয় আদালত, ৫ আগস্ট তো আমি বাসায় ছিলাম। আমি কোনো খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। আমি তো প্রমাণ করে দিতে পারব ৫ আগস্ট আমি বাসায় ছিলাম। আমাকে রিমান্ডে দেওয়ার আবেদন নাকচ করা হোক।’
একপর্যায়ে শমসের মবিন চৌধুরী আদালতকে বলেন, ‘আমি তো ১৫ বছর বিএনপির রাজনীতি করেছি মাননীয় আদালত।’
শমসের মবিন চৌধুরীর এ বক্তব্যের পর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী তাঁর রিমান্ডের যুক্তি তুলে ধরে বলেন, শমসের মবিন চৌধুরী পল্টিবাজ নেতা। তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের একজন হলেন শমসের মবিন চৌধুরী।
উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরীকে যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
পিপির সঙ্গে শমসের মবিনের বিতর্ক: যাত্রাবাড়ী থানায় করা পারভেজ মিয়া হত্যা মামলায় শমসের মবিন চৌধুরী, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও জুনাইদ আহ্মেদ পলককে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে পুলিশ। সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে রাষ্ট্রপক্ষে রিমান্ডের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি কথা বলার সময় শমসের মবিন চৌধুরী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর বাঁ হাতে ছিল একটি ছড়ি। ডান হাত উঁচু করে বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি কিছু কথা বলতে চাই। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি তো ৫ আগস্ট বাসাতেই ছিলাম। আমি এর প্রমাণ দিতে পারব। আমি তো বিএনপির রাজনীতি করতাম।’
শমসের মবিন চৌধুরী যখন উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকেন, তখন একদল আইনজীবী বলতে থাকেন, ‘আপনি একজন পল্টিবাজ নেতা। আপনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী।’
শমসের মবিন চৌধুরী আদালতকে বলেন, ‘আমি একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি যুদ্ধ করেছি। আমি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমার এক পা হারিয়েছিলাম। আমি লাঠিতে ভর দিয়ে চলি।’ এ সময় তিনি বাঁ হাতে ধরা ছড়িটি উঁচু করে দেখান।
শমসের মবিন চৌধুরীর বক্তব্যের বিরোধিতা করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী।
পিপি ওমর ফারুক আদালতকে বলেন, শমসের মবিন চৌধুরী পল্টিবাজ নেতা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন সত্য। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ সুযোগ–সুবিধা পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমান সরকার চিকিৎসার জন্য তাঁকে জার্মানিতে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্রসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও চাকরি করেছেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে পল্টি মেরে চলে আসেন বিএনপিতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তাঁকে বিশ্ব বেইমান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
শমসের মবিন চৌধুরীকে নিয়ে পিপি ওমর ফারুক যখন কথা বলছিলেন, তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ হাসিনার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, জুনাইদ আহ্মেদ ও দীপু মনি তাঁর কথা শুনতে থাকেন। এরই মধ্যে একদল আইনজীবী আবারও তাঁকে ‘পল্টিবাজ’ নেতা হিসেবে গালমন্দ করতে থাকেন।
এ পর্যায়ে পিপি ওমর ফারুক আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপিতে থাকাকালে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি তাঁকে বিদেশি কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দিয়েছিল। তখন তিনি বিএনপির সঙ্গে বেইমানি করেন। তিনি তখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন। বিএনপি বিষয়টি জানার পর তাঁকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি আবার আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার কাছে গেলেন। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার কাছ থেকে যে কয়েকজন টাকা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন শমসের মবিন চৌধুরী। শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।’
পিপি আরও বলেন, ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচনে অংশ নিলেও শমসের মবিন চৌধুরী ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেননি।
এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শমসের মবিন চৌধুরী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো অপরাধ নয়। আমি ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। ভোটও দিয়েছিলাম। উনার (পিপি) কথা সঠিক নয়।’
এ সময় শমসের মবিন চৌধুরী হাতজোড় করে বিচারকের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি জানতাম না, আজ আমার মামলার শুনানির দিন রয়েছে। আমার আইনজীবীও সেটি জানেন না। যে কারণে আমার আইনজীবী আদালতে উপস্থিত নেই। আমি তো ৫ আগস্ট বাসাতেই ছিলাম। বাসায় আমি সেদিন টেলিভিশনে খবরাখবর দেখছিলাম। আমার চার দিনের যে রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে, সেটি বাতিল করার জোর আবেদন করছি।’
রিমান্ডের শুনানি শেষে শমসের মবিন চৌধুরীকে পুলিশ আদালতের দোতলা থেকে হাজতখানায় নেওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার হাতে এখন হাতকড়া।’
শমসের মবিন বেশ কয়েকবার ডান হাত উঁচু করে ধরে সাংবাদিকদের সেই হাতকড়া দেখাতে থাকেন। এ পর্যায়ে পুলিশ তাঁর ডান হাত ধরে রাখে।
গত বছরের ১৭ অক্টোবর তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর ২০১৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন তিনি। সবশেষ ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন হন তিনি। তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত নাজমুল হুদা। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
আনিসুল-সালমান পাশাপাশি, তবু কথা বলেননি তাঁরা: সকাল সাতটার পর প্রিজন ভ্যানে করে কারাগার থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায় আনা হয়, শমসের মবিন চৌধুরী, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, দীপু মনি, জুনাইদ আহ্মেদকে। এরপর তাঁদের প্রত্যেককে পরানো হয় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। মাথায় পরানো হয় হেলমেট।
সকাল ১০টার দিকে শমসের মবিন চৌধুরীসহ অন্যদের হাজতখানা থেকে বের করে আদালতের এজলাসকক্ষে নেওয়া হয়। প্রায় এক ঘণ্টা শমসের মবিন চৌধুরী, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, দীপু মনি, জুনাইদ আহ্মেদদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
কাঠগড়ায় আনিসুল হক আর সালমান এফ রহমান পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টা পাশাপাশি দুজন দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁরা কোনো কথা বলেননি। দীপু মনির সঙ্গে একবার কিছুক্ষণ কথা বলেন আনিসুল হক। তবে দীপু মনি আর জুনাইদ আহ্মেদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঠগড়ায়। দুজনেই বেশ কয়েকবার হাসিমুখেও কথা বলেন। তবে সালমান এফ রহমান কেবল তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। আদালতকক্ষে তাঁকে বিমর্ষ দেখা যায়। আনিসুল হকও তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। দীপু মনিও তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলেন।