বাণিজ্য ডেস্ক : অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মানুষের আয় ও ব্যয় নির্বাহের ওপর চাপ পড়েছে। চাপ কমিয়ে অর্থনীতিকে মোটামুটি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। ’ বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের মতামত ব্যক্ত করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু জিনিস করতে গেলে বাইরে থেকে বলা যত সহজ, এই করে ফেলেন এই করা যাবে- বাস্তবে অতটা সহজ নয়। ভেতর থেকে বোঝা যায় যে একটা সমস্যার সমাধান করতে গেলে আরেকটা সমস্যা সামনে এসে পড়ে। সরলীকরণ করে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না।’
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ে জানতে চাইলে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মূল্যস্ফীতি আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবং এই মূল্যস্ফীতি বেশ কয়েক বছর যাবত, দুই-তিন বছর ধরে চলছে। তবে এখন এটা ধারাবাহিকভাবে কমার দিকে। আগের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নন ফুডের দাম একটু কমেছে। খাদ্যের দামও একটু কমেছে। তবে আমি বলবো না যে একেবারে সন্তোষজনকভাবে কমে গেছে। মানুষের আয় ও ব্যয় নির্বাহের ওপর চাপ পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বিভিন্ন কারণে হয় যেমন- চাহিদা ও সরবরাহজনিত কারণ। সেই চাহিদা ও সরবরাহটা আবার শুধু দেশীয় কারণেই নয় বৈশ্বিক কারণেও হয়। অতএব এই দুইটা মিলে আমরা চাপ অনুভব করছি। আমরা আসার পরে জিনিসটা একটু বেশি অনুভূত হচ্ছে। কারণ জুলাই-আগস্ট মাসের বিপ্লবের পর অনেক কিছু বন্ধ ছিল বহুদিন। ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল, যার ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) পড়েছে ব্যবসার ওপর। বিশেষ করে সরবরাহের ওপর। আর ওদিকে মোটমুটি কৃষি এবং অন্যান্য জিনিস নরমালই (স্বাভাবিক) ছিল। সেই প্রেক্ষিতে আমরা মূল্যস্ফীতি কমাতে নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছি, যদিও সেগুলো সাফিসিয়েন্ট (যথেষ্ট) না তবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমানো গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় দিক হলো সরবরাহ। নানাবিধ কারণে সমস্যা দেখা দিল। হঠাৎ করে বন্যা হলো, এতে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলো কুমিল্লা-নোয়াখালী এসব অঞ্চলে, তারপরে আবার ময়মনসিংহে অতিবৃষ্টি হলো। মুন্সিগঞ্জেও অতিবৃষ্টি হলো। তখন ভেজিটেবল সরবরাহে সমস্যা হলো। তবে সৌভাগ্যক্রমে আবার এখন ভেজিটেবল সরবরাহ আসছে। কিন্তু চালের ব্যাপারটা বন্যার কারণে ক্ষতি হয়েছে। আমরা এখন যেটা চেষ্টা করছি যেভাবে পারি বাইরে থেকে চাল আমদানি করছি, বিভিন্ন দেশ থেকে। চাল,ডাল, মসুর এসবের সরবরাহজনিত চাপটা একটু কমানোর চেষ্টা করছি। ওএমএস আছে টিসিবির মাধ্যমে ও ট্রাক সেলটা বন্ধ ছিল যেটা আবার চালু হতে যাচ্ছে। ’
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘ট্রাক সেলটা বন্ধ করেছিলাম কারণ হলো ট্রাক সেলে যেগুলো দেওয়া হতো সেগুলোর দাম বাজারে মোটমুটি সাশ্রয়ী ছিল। তবে সেটা আবার চালু করা হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রোজার আগেই চালু করবো। রোজার মধ্যে কোনোভাবেই ট্রাকসেল বন্ধ রাখা যাবে না। ট্রাক সেলটা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ এবং বড় শহর শহরে চালু করবো। এটা করাতে মূল্যস্ফীতি যে কমছে ঠিক তাও না, তবু চাপ আছে। ’
চাঁদাবাজি একটা কারণ মনে করে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ‘সেটা একটা মূল কারণ। দেখুন, সরবরাহ যে একেবারে কম তা কিন্তু নয়। এখনও কিন্তু আমাদের বাফার স্টক আছে। কালকেই দুইটা দেশ থেকে জাহাজ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে, আবার ভিয়েতনাম থেকে আসবে। পাকিস্তান থেকে চাল আসছে। আমরা মসুরের ডাল, গম এমনকি রাশিয়া থেকে গম আনছি। মোটামুটি সরবরাহটা ঠিক আছে। চালের দামটা এত বাড়ার কথা না। মোটামুটি ফসল উৎপাদনও কিন্তু খারাপ হয়নি। সমস্যাটা হচ্ছে কী উৎপাদকের কাছে থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেকগুলো লোক জড়িয়ে যায়। সেই মহাস্থানগড়ের মোকাম থেকে নওগাঁর চাল ঢাকায় আনতে জায়গায় জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। সোজাকথা পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে চাঁদাবাজিও বড় একটা কারণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের মতো না। রাজনৈতিক সরকারের নিজস্ব লোক আছে, কর্মী আছে। স্থানীয় পর্যায়ে তারা রাজনীতি করে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি আয় পায়। কিন্তু আমরাতো সরকারের কর্মচারী। আমাদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের লোকজন যায় কিন্তু তারা তো সংখ্যায় কয়েকজন। মানুষকে কনভেন্স করার ম্যাকানিজম আমাদের নেই। আর আমরাও কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছি না। আর প্রত্যেকটা জায়গায় লোকাল (স্থানীয়) কিছু লোকজন আছে তাদের চাঁদা দিতেই হয়। লোকাল মানে কারওয়ান বাজারে যারা থাকে, পুরান ঢাকা, শ্যামবাজারে যারা আছে। এসব জায়গার কিছু লোকাল লোকজন অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করে। এতে করে কৃষকদের পাশাপাশি ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদেরকে পণ্যটি কিন্তু চার-পাঁচগুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দুই দিকেই কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে। চালের দামটা একেবারে যে কমে গেছে তা না। সরু চালের দামটা একটু বেড়েছে কিন্তু মোটা চাল ও মধ্যম দামের চালের দাম বাড়ায় সেটার প্রভাব কিন্তু মূল্যস্ফীতিতে পড়ে। ’ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের একটা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে, মানুষ একটু স্বস্তি পেতে চাচ্ছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার বাজেটের ওপর প্রেসার(চাপ) পড়ছে। ডেফেনেটলি (সুস্পষ্টভাবে) একটা প্রেসার। কারণ মানুষের বাড়তি আয়ের স্কোপতো তেমন নেই। আর ব্যবসা-বাণিজ্য যে বিরাটভাবে হচ্ছে বা বড় বড় প্রজেক্ট হচ্ছে বা কর্মসংস্থান হচ্ছে সেরকমতো নয়, কমে গেছে। আর দ্বিতীয়ত হলো আমাদের জ্বালানির ওপর প্রেসার (চাপ) পড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি সাশ্রয়ী করতে। ঘর ভাড়া বা অন্যান্য জিনিস যে কমেছে তাতো নয়। আরেকটা জিনিস হলো জুলাই-আগস্টের পরে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী বা বড় বড় ব্যবসা যারা নিয়ন্ত্রণ করতো তারা পালিয়ে গেছে। তাদের ব্যবসাগুলো অন্যরা চালাচ্ছে, কিন্তু খুব দক্ষতার সঙ্গে যে চালাচ্ছে তাতো না। আমরা খালি দেখি বড় বড় ব্যবসার লোকজন। কিন্তু অনেক মধ্য ব্যবসায়ী ও ছোট ছোট ব্যবসায়ী যাদের নাম পত্রিকায় আসে না। তারা কিন্তু ভয়ে ব্যবসা গুটিয়ে বসে আছে। কারণ ভাবে যে, হঠাৎ আমি ব্যবসা করবো আমাকেতো কিছুদিন আগেও দেখেছে আমি কীভাবে ব্যবসাটা করেছি। অন্যদের বঞ্চিত করে আমি ব্যবসাটা পেয়েছি, লাভ বেশি করেছি। তারা কিন্তু গুটিয়ে আছে। এতে হচ্ছেটা কী লোকজনের কর্মসংস্থানটা হচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যটা হলে মানুষের আয় বাড়ে। আয়ের পরিধিটা বাড়ে। ওটা আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা এখন চিন্তা করছি হয়তো মেগা প্রজেক্ট বেশকিছু করবো না, তবে স্থানীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন করবো। এর মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ’দেশে শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতার স্বাভাবিকতা নেই। উৎপাদনশীল খাতে ইউনিট বেড়েছে কিন্তু প্রবৃদ্ধি আসেনি। এতে অর্থনীতিবিদ বা অনেকেই মনে করেন শিল্পখাতের এই অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে বলে মনে করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আগে থেকেই এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সময়ের সাথে ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলাদেশ বেশি ডেভেলপ করে নাই। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেস কিন্তু অনেক কম। আমাদের শিল্পকারখানার প্রত্যেকটি খাতে সমানভাবে ডেভেলপ হয়নি। এর মধ্যে সম্প্রতি প্রোডাকশন খাতের কোথাও কোথাও কিছুটা উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। এ জন্যই প্রবৃদ্ধিটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ও বিজনেস সেক্টরে কম। এগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসাই আমাদের জন্য আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই জায়গাটা ধরে ধরে ঠিক করে দেশের ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করতে হবে। এই খাতে বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকে অর্থের অভাব। লিকুইডিটি প্রবলেম। অর্থের অভাবে আয়ের জায়গাটা গতি পাচ্ছে না। এখনো সিলেক্টভি ওয়েতে কিছু কিছু জায়গায় অর্থ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এখন অর্থায়নটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ পুনর্গঠন প্রয়োজন। তাহলেই অনেক কিছুতেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। এছাড়া আমরা বিদ্যুৎখাতের জায়গাটা মোটামুটি ঠিক রাখতে পারছি। তবে গ্যাস নিয়ে সমস্যা রয়েছে। অল্টারনেটিভ এনার্জির জন্যও আমরা চেষ্টা করছি। এতে হয়তো ব্যবসায়ীদের কিছুটা সাশ্রয়ী হবে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা সময় মতো ঋণটা পরিশোধ করতে না পারায়, পরবর্তী লোনটা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়ছে। এখানে আমরা প্ল্যান নিয়ে কাজ করছি। আর এক্ষেত্রে আমাদের অর্থের চ্যালেঞ্জটা একটু বেশি। আশা করা যায় একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গতিশীলতা আসবে। –
চাপ কমিয়ে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি : ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ