ঢাকা ১২:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য জলাভূমি

  • আপডেট সময় : ০৫:৪০:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে

মো. অহিদুর রহমান : ‘আজ তিনি নবরূপী দানবের বংশে, মানুষ পাঠিয়েছেন মানুষের ধ্বংসে’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্বংস গল্পে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন। বাস্তুতন্ত্র, স্থানীয় ও আঞ্চলিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, মিঠাপানির আধার, ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরাট, কার্বন আধার, জলবায়ু অভিঘাত প্রশমন, অভিযোজন, জীবিকার উৎস, অর্থনৈতিক অবদান, পরিবেশ সুরক্ষাসহ মানুষের জীবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জলাভূমি প্রহরীর মতো কাজ করে। জলাভূমি পৃথিবীর কিডনির মতো কাজ করে।

প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য জলাভূমি রক্ষা করি’। ১৯৯৭ সালে প্রথম পালন হয় জলাভূমি দিবস। ১৯৯৮ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘জীবনে পানির গুরুত্ব ও পানি সরবরাহে জলাভূমির ভূমিকা’; ১৯৯৯ সালে ‘মানুষ ও জলাভূমি: গুরুত্বপূর্ণ লিংক’। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বে জলাভূমি উদ্যাপন করা হচ্ছে। ২০০১ সালে ‘একটি জলাভূমি বিশ্ব- নতুন আবিষ্কৃত বিশ্ব’; ২০০২ সালে ‘জলাভূমি-জল-জীবন ও সংস্কৃতি’; ২০০৩ সালে ‘জলাভূমি নেইÑজল নেই’; ২০০৪ সালে ‘পর্বত থেকে সমুদ্র- কাজ করছে জলাভূমি’; ২০০৫ সালে ‘জলাভূমি- বৈচিত্র্যময় সম্পদ: হারাবেন না’; ২০০৬ সালে ‘ঝুঁকিতে জীবিকা’; ২০০৭ সালে ‘আগামীর জন্য মাছ’; ২০০৮ সালে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি- স্বাস্থ্যকর মাছ’; ২০০৯ সালে ‘আপস্ট্রিম-ডাউনস্ট্রিম জলাভূমি সকলকে যুক্ত করে’; ২০১০ সালে ‘জলাভূমির যত্ন নেওয়া জলাভূমির পরিবর্তনের উত্তর’; ২০১১ সালে ‘জল ও জলাভূমির জন্য বন’; ২০১২ সালে ‘জলাভূমি পর্যটন: একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা’; ২০১৩ সালে ‘জলাভূমি জলের যত্ন নেয়’; ২০১৪ সালে ‘জলাভূমি ও কৃষি বৃদ্ধির অংশীদার’; ২০১৫ সালে ‘আমাদের ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি’; ২০১৬ সালে ‘ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি: টেকসই জীবিকা’; ২০১৭ সালে ‘দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের জন্য জলাভূমি’; ২০১৮ সালে ‘একটি শহরের ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি’; ২০১৯ সালে ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’; ২০২০ সালে ‘জলাভূমি এবং প্রাণবৈচিত্র্য’; ২০২১ সালে ‘জলাভূমি এবং পানি’; ২০২২ সালে ‘মানুষ এবং প্রকৃতির জন্য জলাভূমি অ্যাকশন’; ২০২৩ সালে ‘এখন জলাভূমি পুনরুদ্ধারের সময়’; আর ২০২৪ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমি এবং মানবকল্যাণ।

তরল মহাসড়ক হাওরের জলপথ। জল, মাছ, হিজল-করচ, জলজ খাবার, পাখি, ধান, গান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আফাল, ঢেউ, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি লোকসংস্কৃতি, প্রাণের বৈচিত্র্যে ভরপুর বাউলের পদচারণে গড়ে ওঠা এক জলসংস্কৃতির জীবনের নাম হাওর। হাওর জলাভূমি এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষিপ্রতিবেশ এলাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগজুড়ে হাওর জলাভূমি অঞ্চল। প্রাণের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এ বিস্তৃত জলাভূমি। হাওরের বৈচিত্র্যে, বৈভবে গড়ে উঠেছে। আমাদের সেই চেরাপুঞ্জির কয়েক কিলোমিটার ভাটিতেই হাওরের অবস্থান। পাহাড় থেকে সৃষ্ট প্রায় ৩২টি আন্তঃরাষ্ট্রীয় নদীর মাধ্যমে উজান থেকে নেমে আসা পানি ও মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে এ অঞ্চলে প্রচুর পানি আসে। হাওরের বৈচিত্র্যময় ধান, নানা জাত ও স্বাদের মাছ, প্রকৃতির শোভা হিজল-করচ, হাওরের পাখি, শাপলাশালুক, ঢেপ, কেউরালি, পানিফল, কলমি, হেলেঞ্চাসহ জলজ খাবার, হাওরাঞ্চলের সুরস্রষ্টা রাধারমণ, হাছনরাজা, শাহ আবদুল করিম, শিতালং শাহ, দুরবিন শাহ, উকিল মুন্সি, আবদুর রশীদ, মিরাজ আলী, জালাল খাঁর মতো কারিগরদের জ্ঞান ও সুরের মূর্ছনায় বাঙালির মন আর মনন গঠনে অবদান রেখে চলেছে নিরন্তর। যা একই সঙ্গে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধিশালী।

হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশি পাখি। এছাড়া ১৪১ প্রজাতির বন্য প্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্নপ্রায়। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সংরক্ষিত জলাভূমি। একে দেশের অন্যতম মাদার ফিশারিজ বলা হয়। যাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে নানা জাতের পাখি। শীতে এখানে সরালি, পাতিসরালি, লেজাহাঁস, রাজ সরালি, বেলেহাঁস, ফুলুরি হাঁস, বালিহাঁস, পাতি তিলাহাঁস, নীল মাথা হাঁস, লেঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পানকৌড়ি, ধূসর বক, ময়ুর লেঞ্জা, পিয়াং হাঁস, জলপিপি, মেঠোমাথা, পাতি পানমুরগি, শঙ্খচিল, শামুক ভাঙা, সাদা পাখি, কানিবক, পলাশিকুড়া, গুটি ঈগল, ঈগল, ফিশ ঈগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির স্থলচর, জলচর, উভচর পাখির আগমন ঘটে। দেশের মোট জলজ উদ্ভিদের ৫০ শতাংশই রয়েছে হাকালুকিতে।

বাংলাদেশকে বলা হয় জলাভূমির দেশ। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন আমাদের জলাভূমিগুলো। দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলার জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠাপানির টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারিসারি হিজল-করচশোভিত, পাখিদের কলকাকলিমুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারি। হিজল-করচের দৃষ্টিনন্দন সারি হাওরকে করেছে মোহনীয়। এছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলী, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসীসহ ২০০ প্রজাতির বেশি গাছগাছালি রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। নদী, খাল-বিল, হাওর, জলাভূমি বিলুপ্তির ফলে কমছে প্রাকৃতিক মাছের বৈচিত্র্য। মানুষ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে চাষকৃত মাছের ওপর, প্রাকৃতিক মাছের ওপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলো দিনদিন ঝুঁকির মাঝে পড়ে যাচ্ছে। পেশা হারিয়ে বেমানান হয়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে। মূলত প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় প্রতিবেশ, সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সামাজিক বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। সামাজিক এ বৈচিত্র্যে জন্ম হয়েছে ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকে। ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্ম হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য থেকে। তাই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ছাড়া মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নেত্রকোণার মানুষকে এগিয়ে আসতে।

অনেক নদী মৃতপ্রায়। যেগুলো চলমান সেগুলো দখল-দূষণে বিপন্ন। ভূপৃষ্ঠের পানির একটি বড় উৎস জলাভূমিগুলো। সার্বিকভাবে জলাভূমি কমছে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জলাভূমিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, জলাভূমিগুলো দেশের মোট জমির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত। তবে জলাভূমির আয়তন কমে এখন তা মোট জমির প্রায় ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমিতে প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জলাভূমি বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিনিষ্কাশন ও সেচের উন্নয়নের কারণে হারিয়ে গেছে। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ায় ভূপৃষ্ঠের পানির মজুদও হারিয়ে যাচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে জলাভূমির বাস্তুসংস্থান ও প্রাণবৈচিত্র্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘স্টেট অব ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী গত দুই দশকে জনপ্রতি সুপেয় পানির সহজপ্রাপ্ততা এক পঞ্চমাংশ কমেছে। জাতিসংঘের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বের ১৮০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জলাভূমির আন্তর্জাতিক উপযোগিতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল এবং জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১৯৭৫ সালে সেই চুক্তি কার্যকর হয়। জলাভূমিসংক্রান্ত সম্মেলনে স্বাক্ষর গ্রহণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ দিবসটি পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত ১৭১টি দেশ জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি অনুমোদন করেছে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে।

১৭ শতক থেকে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ জলাভূমির অস্তিত্বের বিপর্যয় ঘটে চলেছে। বনভূমির চেয়ে তিনগুণ হারে জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হারিয়ে যাওয়া থেকে জলাভূমি রক্ষা এবং সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করায় জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে সচেষ্ট হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী-নালা, বিল, হাওর-বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশ ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রাণ এ জলাভূমি। জলাভূমি রক্ষা করে আমরা বাঁচি। পৃথিবী বাঁচাই।

লেখক: পরিবেশ কর্মী

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দেশ নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র করছেন শেখ হাসিনা: ফখরুল

ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য জলাভূমি

আপডেট সময় : ০৫:৪০:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মো. অহিদুর রহমান : ‘আজ তিনি নবরূপী দানবের বংশে, মানুষ পাঠিয়েছেন মানুষের ধ্বংসে’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্বংস গল্পে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন। বাস্তুতন্ত্র, স্থানীয় ও আঞ্চলিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, মিঠাপানির আধার, ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরাট, কার্বন আধার, জলবায়ু অভিঘাত প্রশমন, অভিযোজন, জীবিকার উৎস, অর্থনৈতিক অবদান, পরিবেশ সুরক্ষাসহ মানুষের জীবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জলাভূমি প্রহরীর মতো কাজ করে। জলাভূমি পৃথিবীর কিডনির মতো কাজ করে।

প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য জলাভূমি রক্ষা করি’। ১৯৯৭ সালে প্রথম পালন হয় জলাভূমি দিবস। ১৯৯৮ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘জীবনে পানির গুরুত্ব ও পানি সরবরাহে জলাভূমির ভূমিকা’; ১৯৯৯ সালে ‘মানুষ ও জলাভূমি: গুরুত্বপূর্ণ লিংক’। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বে জলাভূমি উদ্যাপন করা হচ্ছে। ২০০১ সালে ‘একটি জলাভূমি বিশ্ব- নতুন আবিষ্কৃত বিশ্ব’; ২০০২ সালে ‘জলাভূমি-জল-জীবন ও সংস্কৃতি’; ২০০৩ সালে ‘জলাভূমি নেইÑজল নেই’; ২০০৪ সালে ‘পর্বত থেকে সমুদ্র- কাজ করছে জলাভূমি’; ২০০৫ সালে ‘জলাভূমি- বৈচিত্র্যময় সম্পদ: হারাবেন না’; ২০০৬ সালে ‘ঝুঁকিতে জীবিকা’; ২০০৭ সালে ‘আগামীর জন্য মাছ’; ২০০৮ সালে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি- স্বাস্থ্যকর মাছ’; ২০০৯ সালে ‘আপস্ট্রিম-ডাউনস্ট্রিম জলাভূমি সকলকে যুক্ত করে’; ২০১০ সালে ‘জলাভূমির যত্ন নেওয়া জলাভূমির পরিবর্তনের উত্তর’; ২০১১ সালে ‘জল ও জলাভূমির জন্য বন’; ২০১২ সালে ‘জলাভূমি পর্যটন: একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা’; ২০১৩ সালে ‘জলাভূমি জলের যত্ন নেয়’; ২০১৪ সালে ‘জলাভূমি ও কৃষি বৃদ্ধির অংশীদার’; ২০১৫ সালে ‘আমাদের ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি’; ২০১৬ সালে ‘ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি: টেকসই জীবিকা’; ২০১৭ সালে ‘দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের জন্য জলাভূমি’; ২০১৮ সালে ‘একটি শহরের ভবিষ্যতের জন্য জলাভূমি’; ২০১৯ সালে ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’; ২০২০ সালে ‘জলাভূমি এবং প্রাণবৈচিত্র্য’; ২০২১ সালে ‘জলাভূমি এবং পানি’; ২০২২ সালে ‘মানুষ এবং প্রকৃতির জন্য জলাভূমি অ্যাকশন’; ২০২৩ সালে ‘এখন জলাভূমি পুনরুদ্ধারের সময়’; আর ২০২৪ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমি এবং মানবকল্যাণ।

তরল মহাসড়ক হাওরের জলপথ। জল, মাছ, হিজল-করচ, জলজ খাবার, পাখি, ধান, গান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আফাল, ঢেউ, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি লোকসংস্কৃতি, প্রাণের বৈচিত্র্যে ভরপুর বাউলের পদচারণে গড়ে ওঠা এক জলসংস্কৃতির জীবনের নাম হাওর। হাওর জলাভূমি এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষিপ্রতিবেশ এলাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগজুড়ে হাওর জলাভূমি অঞ্চল। প্রাণের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এ বিস্তৃত জলাভূমি। হাওরের বৈচিত্র্যে, বৈভবে গড়ে উঠেছে। আমাদের সেই চেরাপুঞ্জির কয়েক কিলোমিটার ভাটিতেই হাওরের অবস্থান। পাহাড় থেকে সৃষ্ট প্রায় ৩২টি আন্তঃরাষ্ট্রীয় নদীর মাধ্যমে উজান থেকে নেমে আসা পানি ও মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে এ অঞ্চলে প্রচুর পানি আসে। হাওরের বৈচিত্র্যময় ধান, নানা জাত ও স্বাদের মাছ, প্রকৃতির শোভা হিজল-করচ, হাওরের পাখি, শাপলাশালুক, ঢেপ, কেউরালি, পানিফল, কলমি, হেলেঞ্চাসহ জলজ খাবার, হাওরাঞ্চলের সুরস্রষ্টা রাধারমণ, হাছনরাজা, শাহ আবদুল করিম, শিতালং শাহ, দুরবিন শাহ, উকিল মুন্সি, আবদুর রশীদ, মিরাজ আলী, জালাল খাঁর মতো কারিগরদের জ্ঞান ও সুরের মূর্ছনায় বাঙালির মন আর মনন গঠনে অবদান রেখে চলেছে নিরন্তর। যা একই সঙ্গে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধিশালী।

হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশি পাখি। এছাড়া ১৪১ প্রজাতির বন্য প্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্নপ্রায়। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সংরক্ষিত জলাভূমি। একে দেশের অন্যতম মাদার ফিশারিজ বলা হয়। যাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে নানা জাতের পাখি। শীতে এখানে সরালি, পাতিসরালি, লেজাহাঁস, রাজ সরালি, বেলেহাঁস, ফুলুরি হাঁস, বালিহাঁস, পাতি তিলাহাঁস, নীল মাথা হাঁস, লেঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পানকৌড়ি, ধূসর বক, ময়ুর লেঞ্জা, পিয়াং হাঁস, জলপিপি, মেঠোমাথা, পাতি পানমুরগি, শঙ্খচিল, শামুক ভাঙা, সাদা পাখি, কানিবক, পলাশিকুড়া, গুটি ঈগল, ঈগল, ফিশ ঈগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির স্থলচর, জলচর, উভচর পাখির আগমন ঘটে। দেশের মোট জলজ উদ্ভিদের ৫০ শতাংশই রয়েছে হাকালুকিতে।

বাংলাদেশকে বলা হয় জলাভূমির দেশ। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন আমাদের জলাভূমিগুলো। দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলার জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠাপানির টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারিসারি হিজল-করচশোভিত, পাখিদের কলকাকলিমুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারি। হিজল-করচের দৃষ্টিনন্দন সারি হাওরকে করেছে মোহনীয়। এছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলী, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসীসহ ২০০ প্রজাতির বেশি গাছগাছালি রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। নদী, খাল-বিল, হাওর, জলাভূমি বিলুপ্তির ফলে কমছে প্রাকৃতিক মাছের বৈচিত্র্য। মানুষ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে চাষকৃত মাছের ওপর, প্রাকৃতিক মাছের ওপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলো দিনদিন ঝুঁকির মাঝে পড়ে যাচ্ছে। পেশা হারিয়ে বেমানান হয়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে। মূলত প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় প্রতিবেশ, সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সামাজিক বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। সামাজিক এ বৈচিত্র্যে জন্ম হয়েছে ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকে। ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্ম হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য থেকে। তাই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ছাড়া মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নেত্রকোণার মানুষকে এগিয়ে আসতে।

অনেক নদী মৃতপ্রায়। যেগুলো চলমান সেগুলো দখল-দূষণে বিপন্ন। ভূপৃষ্ঠের পানির একটি বড় উৎস জলাভূমিগুলো। সার্বিকভাবে জলাভূমি কমছে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জলাভূমিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, জলাভূমিগুলো দেশের মোট জমির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত। তবে জলাভূমির আয়তন কমে এখন তা মোট জমির প্রায় ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমিতে প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জলাভূমি বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিনিষ্কাশন ও সেচের উন্নয়নের কারণে হারিয়ে গেছে। জলাভূমিগুলো হারিয়ে যাওয়ায় ভূপৃষ্ঠের পানির মজুদও হারিয়ে যাচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে জলাভূমির বাস্তুসংস্থান ও প্রাণবৈচিত্র্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘স্টেট অব ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী গত দুই দশকে জনপ্রতি সুপেয় পানির সহজপ্রাপ্ততা এক পঞ্চমাংশ কমেছে। জাতিসংঘের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বের ১৮০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জলাভূমির আন্তর্জাতিক উপযোগিতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল এবং জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১৯৭৫ সালে সেই চুক্তি কার্যকর হয়। জলাভূমিসংক্রান্ত সম্মেলনে স্বাক্ষর গ্রহণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ দিবসটি পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত ১৭১টি দেশ জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি অনুমোদন করেছে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে।

১৭ শতক থেকে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ জলাভূমির অস্তিত্বের বিপর্যয় ঘটে চলেছে। বনভূমির চেয়ে তিনগুণ হারে জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হারিয়ে যাওয়া থেকে জলাভূমি রক্ষা এবং সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করায় জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে সচেষ্ট হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী-নালা, বিল, হাওর-বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশ ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রাণ এ জলাভূমি। জলাভূমি রক্ষা করে আমরা বাঁচি। পৃথিবী বাঁচাই।

লেখক: পরিবেশ কর্মী