ঢাকা ০৪:১৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মাধ্যমিক শিক্ষা : বিদ্যমান সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

  • আপডেট সময় : ০৫:২০:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ১৭ বার পড়া হয়েছে

সৈয়দ মো. ডসয়াম : একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর এ জন্য সুশিক্ষিত ও কর্মঠ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্তমেধা ও অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের আজকের আলোচনা শিক্ষার এই দ্বিতীয় স্তরের বিদ্যমান সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে আলোচিত মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধান ইস্যু ও চ্যালেঞ্জগুলো কী তা একনজরে দেখা যাক-

মাধ্যমিক শিক্ষার আমূল সংস্কার সাধন; কারিকুলাম আধুনিকীকরণ; মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই আরও উন্নত, নির্ভুল, আকর্ষণীয় করা এবং ভাষাগত দিক আরও সহজীকরণ; পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ও গাইড বই বন্ধ করা; পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন; শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে যথাযথ ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ; শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধিকরণ; মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি। এ চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণ করা গেলে আমরা মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত উভয়ক্ষেত্রেই মান অর্জন করতে সক্ষম হবো বলে মনে করছি। আর এই গুণগত মান বৃদ্ধি যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন বলতে এর গুণগত মান নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। শিক্ষার গুণগতমান

আন্তর্জাতিকভাবে তুল্য মানকে নির্দেশ করে। শিক্ষার মান উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানগুলো হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাক্রম, শিখন—শিক্ষণ পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন, শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ এবং ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ। ধারাবাহিকভাবে এসব উপাদানের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমানের টেকসই উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব। এক্ষেত্রে সব অংশীজনদের ভূমিকাই সমান গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জনমিতিক সুফল পেতে হলে পুরো জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। আর এজন্য শিক্ষার আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। আর এই আধুনিকায়ন শুরু হতে হবে একটি কার্যকর যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে যা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি বিষয় ও প্রস্তুতি অপরিহার্য যার মধ্যে জাতির শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির আধুনিকায়ন করে বিশ্বমানের করতে হবে। এ লক্ষ্যে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানসহ টেকনিক্যাল বিষয়গুলোয় দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে অনেক পিছিয়ে। তাই শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে রাষ্ট্র, শিক্ষক অথবা শিক্ষার্থী প্রত্যেকেরই গবেষণাভিত্তিক শিক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষায় আনন্দের সংযোগ ঘটাতে হবে।

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত সম্ভাবনার যুগ; যেখানে ইন্টারনেটের কল্যাণে তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একেকটি মুঠোফোন একেকটি গ্রন্থাগারও বটে; যা আমাদের হাতেই রয়েছে। কিন্তু তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষা কি তা উৎসাহিত করে? আমাদের শিক্ষার সংকটের মূলে আছে শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সমাজ শিক্ষাকে একটি সুযোগ বলে ভাবে, অধিকার হিসেবে ভাবে না। অথচ শিক্ষা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার।

শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কতগুলো সমস্যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে। যা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও অন্তরায়। এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ নামক ভালো ফলাফল প্রাপ্তি অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের সন্তানদের ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তায়। কিন্তু শিক্ষক, অভিভাবকরা পরীক্ষার অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। শিশুদের জ্ঞানচর্চা নয় বরং ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা এবং অপ্রাপ্তির হতাশা শিশুদের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। পরীক্ষাগুলোয় বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি।

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক্স গেজেটের ব্যবহারকে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে সম্ভাবনা হিসেবে দেখি। কিন্তু কোভিড ১৯ পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত ডিভাইসটি তাদের বই বিমুখ করেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় গেমস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসক্তির কারণে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় নিজের সৃজনশীল শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থী নোট বই মুখস্থ করে যাতে অভিভাবকরাও অনেকাংশে দায়ী। যা প্রায়োগিক জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট শিক্ষক ও কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে। শৈশবে পড়ালেখায় মনোযোগী না হওয়ার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। সেখানে মাতৃভাষা বাংলা পড়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় শিক্ষার্থীরা বাংলায় খারাপ করছে। প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের সংখ্যা আমাদের নেহাত কম নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি না থাকায় তত্ত্বীয় ক্লাসের পরে আর ব্যবহারিক ক্লাস হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের নানা বিষয় হাতেকলমে শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

তাছাড়া শিক্ষা উপকরণের অভাব ও অপ্রতুলতা, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ, মাল্টিমিডিয়ার সুযোগ সমৃদ্ধ শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা, দুর্বল ও গ্রামীণ অবকাঠামো, শিক্ষকদের স্বল্প বেতন ও পদমর্যাদা, অভাব-আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এটা সবারই জানা, এখানে একজন শিক্ষক যে পদে যোগদান করেন, ওই পদেই শেষে তিনি অবসরে যান! শিক্ষাক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই! আমরা সবাই শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে নানা কথা বলি, অথচ শিক্ষকের মানোন্নয়ন নিয়ে সবাই যেন নীরব! কিন্তু কেন এই নীরবতা? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, উচ্চ পর্যায়ে উপনীত সম্মানিত ব্যক্তিরা বোধ হয় মাধ্যমিক স্তরকে বাদ দিয়েই শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছিলেন!

সামাজিক ও আর্থিকভাবে শিক্ষকদের অবস্থার উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে আগামী প্রজন্ম কাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করবে তা কী আমরা ভেবে দেখেছি? অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন, একদিন তিনি ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও? কেউ সেদিন হাত তুললো না! এই পেশাকে আকর্ষণীয় ও সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে না পারার কারণে আজ উচ্চ বা একই বেতন স্কেলে বা কখনো কখনো নিম্নবেতন স্কেলের মেধাবীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন! এটা কি জাতির জন্য শুভ লক্ষণ? বর্তমানে শিক্ষকতার এই মহান পেশাটির সামাজিক তেমন মর্যাদা নেই, নেই আর্থিক নিরাপত্তাও। ফলে এই পেশাটি বর্তমানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই পেশায় প্রায় পদোন্নতি বিহীন অবসর অর্থাৎ এখানে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসতে চান না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও প্রাক্তন সচিব প্রয়াত ড. আকবর আলী খান বলেছিলেন, সার্ভিসের ক্ষেত্রে একজন চাকরিজীবীর বড় একটি অধিকারের বিষয় হলো—পদোন্নতি।

একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ না থাকলে একজন চাকরিজীবী তার কর্মক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করতে পারেন না! এ সুযোগ তৈরি করতে পারলে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাবে—আর্থিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিত হবে। আর এই দুটি বিষয়ের নিশ্চয়তা পেলে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তার জীবনের ব্রত করতে দ্বিধাবোধ করবেন না বলে আমরা মনে করি।

আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষা সেই ঔপনিবেশিক ধারাতেই রয়ে গেছে, ফলে আমরা শিক্ষাকে এখনো আশানুরূপ মানে নিয়ে যেতে পারিনি! বিশেষ করে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনো পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে। মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও কিছু দুর্বল ও পশ্চাৎপদ দিক হচ্ছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতে রয়েছে বিশাল তারতম্য কমিয়ে ১: ৩০/৪০(সর্বোচ্চ) পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে, এজন্য পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজারের কাছাকাছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা পরিদর্শন ও মনিটরিং এককভাবে মাউশি’র অল্পসংখ্যক কর্মকর্তার পক্ষে সত্যিই অসম্ভব! অর্থাৎ দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থা একই সঙ্গে যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব, শিক্ষা প্রশাসনের ওপেন সিক্রেট দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জাতীয় বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দের অপ্রতুলতা! শিক্ষা ক্ষেত্রের আধুনিকায়ন তথা উন্নয়নে বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের আধুনিকায়ন এবং বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি করতে মাধ্যমিক স্তরকে যেভাবে সাজাতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় বাজেটে এর বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ না থাকলে সে শিক্ষা ফলপ্রসূ হয় না। তাই শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ ঘটাতে হবে।

কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। স্কুল পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের যদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয় তাহলে এই জাতি অনেক অসাধ্যকে সাধন করে ফেলবে খুব সহজে। এজন্য প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ। আর শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্ত বৈষম্য দূর করতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সময় উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।

শিক্ষকদের বুনিয়াদি ও বিষয় জ্ঞানের পারদর্শী করতে না পারলে মানসম্মত শিক্ষা কখনো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার দুর্বল ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব প্রশিক্ষণের পরে শিক্ষকবৃন্দ উচ্চতর স্কেল প্রাপ্য হন তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নির্দিষ্ট সময় পর পর সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসাথে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ। শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হলেও শিক্ষায় অর্থায়ন হতাশাব্যঞ্জক। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষার মান উন্নয়নের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।

উন্নত দেশের বিদ্যালয়গুলোয় মধ্যাহ্ন টিফিন বা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে সর্বত্র মধ্যাহ্ন টিফিনের ব্যবস্থা নেই। এতে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাসগুলোতে মনোযোগী হতে পারে না। টিফিন বা স্কুল মিল প্রোগ্রাম চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন সম্ভব।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাস্তবমুখী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি আন্তরিক না হয়। শেষ করছি সম্ভাবনার কথা বলে, আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের সম্ভাবনা, সবার হাতের নাগালে তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সম্ভাবনা। আর এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়েই আমরা আমাদের আগামীর বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারবো অনেক দূর। শিক্ষাই হলো মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। আর দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মব বন্ধ না করলে ডেভিল হিসেবে ট্রিট করবো: উপদেষ্টা মাহফুজ

মাধ্যমিক শিক্ষা : বিদ্যমান সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আপডেট সময় : ০৫:২০:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সৈয়দ মো. ডসয়াম : একবিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর এ জন্য সুশিক্ষিত ও কর্মঠ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্তমেধা ও অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের আজকের আলোচনা শিক্ষার এই দ্বিতীয় স্তরের বিদ্যমান সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে আলোচিত মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধান ইস্যু ও চ্যালেঞ্জগুলো কী তা একনজরে দেখা যাক-

মাধ্যমিক শিক্ষার আমূল সংস্কার সাধন; কারিকুলাম আধুনিকীকরণ; মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই আরও উন্নত, নির্ভুল, আকর্ষণীয় করা এবং ভাষাগত দিক আরও সহজীকরণ; পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ও গাইড বই বন্ধ করা; পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন; শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে যথাযথ ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ; শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধিকরণ; মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি। এ চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণ করা গেলে আমরা মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত উভয়ক্ষেত্রেই মান অর্জন করতে সক্ষম হবো বলে মনে করছি। আর এই গুণগত মান বৃদ্ধি যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন বলতে এর গুণগত মান নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। শিক্ষার গুণগতমান

আন্তর্জাতিকভাবে তুল্য মানকে নির্দেশ করে। শিক্ষার মান উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানগুলো হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাক্রম, শিখন—শিক্ষণ পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন, শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ এবং ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ। ধারাবাহিকভাবে এসব উপাদানের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমানের টেকসই উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব। এক্ষেত্রে সব অংশীজনদের ভূমিকাই সমান গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জনমিতিক সুফল পেতে হলে পুরো জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। আর এজন্য শিক্ষার আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। আর এই আধুনিকায়ন শুরু হতে হবে একটি কার্যকর যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে যা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি বিষয় ও প্রস্তুতি অপরিহার্য যার মধ্যে জাতির শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির আধুনিকায়ন করে বিশ্বমানের করতে হবে। এ লক্ষ্যে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানসহ টেকনিক্যাল বিষয়গুলোয় দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে অনেক পিছিয়ে। তাই শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে রাষ্ট্র, শিক্ষক অথবা শিক্ষার্থী প্রত্যেকেরই গবেষণাভিত্তিক শিক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষায় আনন্দের সংযোগ ঘটাতে হবে।

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত সম্ভাবনার যুগ; যেখানে ইন্টারনেটের কল্যাণে তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একেকটি মুঠোফোন একেকটি গ্রন্থাগারও বটে; যা আমাদের হাতেই রয়েছে। কিন্তু তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষা কি তা উৎসাহিত করে? আমাদের শিক্ষার সংকটের মূলে আছে শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সমাজ শিক্ষাকে একটি সুযোগ বলে ভাবে, অধিকার হিসেবে ভাবে না। অথচ শিক্ষা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার।

শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কতগুলো সমস্যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে। যা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও অন্তরায়। এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ নামক ভালো ফলাফল প্রাপ্তি অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের সন্তানদের ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তায়। কিন্তু শিক্ষক, অভিভাবকরা পরীক্ষার অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। শিশুদের জ্ঞানচর্চা নয় বরং ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা এবং অপ্রাপ্তির হতাশা শিশুদের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। পরীক্ষাগুলোয় বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি।

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক্স গেজেটের ব্যবহারকে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে সম্ভাবনা হিসেবে দেখি। কিন্তু কোভিড ১৯ পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত ডিভাইসটি তাদের বই বিমুখ করেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় গেমস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসক্তির কারণে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় নিজের সৃজনশীল শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থী নোট বই মুখস্থ করে যাতে অভিভাবকরাও অনেকাংশে দায়ী। যা প্রায়োগিক জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট শিক্ষক ও কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে। শৈশবে পড়ালেখায় মনোযোগী না হওয়ার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। সেখানে মাতৃভাষা বাংলা পড়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় শিক্ষার্থীরা বাংলায় খারাপ করছে। প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের সংখ্যা আমাদের নেহাত কম নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি না থাকায় তত্ত্বীয় ক্লাসের পরে আর ব্যবহারিক ক্লাস হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের নানা বিষয় হাতেকলমে শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

তাছাড়া শিক্ষা উপকরণের অভাব ও অপ্রতুলতা, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ, মাল্টিমিডিয়ার সুযোগ সমৃদ্ধ শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা, দুর্বল ও গ্রামীণ অবকাঠামো, শিক্ষকদের স্বল্প বেতন ও পদমর্যাদা, অভাব-আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এটা সবারই জানা, এখানে একজন শিক্ষক যে পদে যোগদান করেন, ওই পদেই শেষে তিনি অবসরে যান! শিক্ষাক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই! আমরা সবাই শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে নানা কথা বলি, অথচ শিক্ষকের মানোন্নয়ন নিয়ে সবাই যেন নীরব! কিন্তু কেন এই নীরবতা? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, উচ্চ পর্যায়ে উপনীত সম্মানিত ব্যক্তিরা বোধ হয় মাধ্যমিক স্তরকে বাদ দিয়েই শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছিলেন!

সামাজিক ও আর্থিকভাবে শিক্ষকদের অবস্থার উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে আগামী প্রজন্ম কাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করবে তা কী আমরা ভেবে দেখেছি? অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন, একদিন তিনি ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও? কেউ সেদিন হাত তুললো না! এই পেশাকে আকর্ষণীয় ও সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে না পারার কারণে আজ উচ্চ বা একই বেতন স্কেলে বা কখনো কখনো নিম্নবেতন স্কেলের মেধাবীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন! এটা কি জাতির জন্য শুভ লক্ষণ? বর্তমানে শিক্ষকতার এই মহান পেশাটির সামাজিক তেমন মর্যাদা নেই, নেই আর্থিক নিরাপত্তাও। ফলে এই পেশাটি বর্তমানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই পেশায় প্রায় পদোন্নতি বিহীন অবসর অর্থাৎ এখানে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসতে চান না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও প্রাক্তন সচিব প্রয়াত ড. আকবর আলী খান বলেছিলেন, সার্ভিসের ক্ষেত্রে একজন চাকরিজীবীর বড় একটি অধিকারের বিষয় হলো—পদোন্নতি।

একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন সাপেক্ষে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ না থাকলে একজন চাকরিজীবী তার কর্মক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করতে পারেন না! এ সুযোগ তৈরি করতে পারলে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাবে—আর্থিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিত হবে। আর এই দুটি বিষয়ের নিশ্চয়তা পেলে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তার জীবনের ব্রত করতে দ্বিধাবোধ করবেন না বলে আমরা মনে করি।

আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষা সেই ঔপনিবেশিক ধারাতেই রয়ে গেছে, ফলে আমরা শিক্ষাকে এখনো আশানুরূপ মানে নিয়ে যেতে পারিনি! বিশেষ করে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনো পশ্চাৎপদই রয়ে গেছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে। মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও কিছু দুর্বল ও পশ্চাৎপদ দিক হচ্ছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতে রয়েছে বিশাল তারতম্য কমিয়ে ১: ৩০/৪০(সর্বোচ্চ) পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে, এজন্য পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজারের কাছাকাছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা পরিদর্শন ও মনিটরিং এককভাবে মাউশি’র অল্পসংখ্যক কর্মকর্তার পক্ষে সত্যিই অসম্ভব! অর্থাৎ দুর্বল পরিদর্শন ব্যবস্থা একই সঙ্গে যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব, শিক্ষা প্রশাসনের ওপেন সিক্রেট দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জাতীয় বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দের অপ্রতুলতা! শিক্ষা ক্ষেত্রের আধুনিকায়ন তথা উন্নয়নে বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের আধুনিকায়ন এবং বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি করতে মাধ্যমিক স্তরকে যেভাবে সাজাতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় বাজেটে এর বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ না থাকলে সে শিক্ষা ফলপ্রসূ হয় না। তাই শিক্ষার সঙ্গে কর্মের সংযোগ ঘটাতে হবে।

কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। স্কুল পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের যদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয় তাহলে এই জাতি অনেক অসাধ্যকে সাধন করে ফেলবে খুব সহজে। এজন্য প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ। আর শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্ত বৈষম্য দূর করতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সময় উপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।

শিক্ষকদের বুনিয়াদি ও বিষয় জ্ঞানের পারদর্শী করতে না পারলে মানসম্মত শিক্ষা কখনো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার দুর্বল ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব প্রশিক্ষণের পরে শিক্ষকবৃন্দ উচ্চতর স্কেল প্রাপ্য হন তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নির্দিষ্ট সময় পর পর সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসাথে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ। শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হলেও শিক্ষায় অর্থায়ন হতাশাব্যঞ্জক। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। শিক্ষার মান উন্নয়নের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।

উন্নত দেশের বিদ্যালয়গুলোয় মধ্যাহ্ন টিফিন বা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে সর্বত্র মধ্যাহ্ন টিফিনের ব্যবস্থা নেই। এতে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাসগুলোতে মনোযোগী হতে পারে না। টিফিন বা স্কুল মিল প্রোগ্রাম চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন সম্ভব।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাস্তবমুখী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি আন্তরিক না হয়। শেষ করছি সম্ভাবনার কথা বলে, আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের সম্ভাবনা, সবার হাতের নাগালে তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সম্ভাবনা। আর এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়েই আমরা আমাদের আগামীর বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারবো অনেক দূর। শিক্ষাই হলো মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। আর দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়