নিজস্ব প্রতিবেদক: ভাষার মাসের প্রথম দিনে পর্দা উঠল বইপ্রেমী মানুষের প্রাণের মেলার; অপেক্ষা ঘুচল লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বিকালে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৫’ উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’।
সেইসঙ্গে মেলার রঙ, প্রতিপাদ্য আর দৃশ্যপটেও এসেছে পরিবর্তন। আর গণআন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে আছে ‘জুলাই চত্বর’। বইমেলা সেজেছে লাল-কালো আর সাদা রঙে; ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিপ্লব, শোক আর আশার প্রদীপ।
এ অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বিতরণ করেন সরকারপ্রধান।
পুরস্কার প্রাপ্তরা হলেন- কবিতায় মাসুদ খান, নাটক ও নাট্যসাহিত্য: শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ/গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, অনুবাদে জি এইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ।
বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিকাল ৩টার দিকে বাংলা একাডেমিতে প্রবেশ করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে উদ্বেধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। ফেরদৌস আরার পরিচালনায় পরিবেশন করা হয় অমর একুশের গান।
পরে ফিতা কেটে বইমেলা উদ্বেধন করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম এসময় সরকারপ্রধানের সঙ্গে ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বাংলা একাডেমি চত্বর ত্যাগ করার পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় মেলা প্রাঙ্গণ। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ প্রবেশ করেন মেলার মাঠে। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের দেখা যায় স্টল গোছাতে।
‘জুলাই চত্বর’: ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে শুরু হওয়া মেলায় ভাষা শহীদ ও ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে এবারের আয়োজনে।
আয়োজকরা বলছেন, এবারের মেলার রঙ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লাল, কালো ও সাদা। বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে লাল, শোকের প্রতীক হিসেবে কালো এবং আশার প্রদীপ হিসেবে সাদা।
জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবারের বইমেলার প্রেক্ষাপটটাও ভিন্ন। গণআন্দোলন ফুটিয়ে তুলতে বইমেলায় থাকছে ‘জুলাই চত্বর’।
বেড়েছে পরিসর: ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলবে মেলা। এবার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে শতাধিক, বেড়েছে আয়তনও। বইমেলার সদস্য সচিব সরকার আমিনের ভাষ্য, অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও আয়তনের দিক থেকে এবার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বইমেলা হচ্ছে। শতাধিক নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। বইয়ের মান বিবেচনায় নিয়েই নতুন প্রকাশনী সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, এবার অনেক নতুন প্রকাশনী মেলায় যুক্ত হয়েছে। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব নিয়ে তাদের বরাদ্দ দিয়েছি এবং মান বিবেচনায় নতুন প্রকাশনীকে স্টল দেয়া হয়েছে।
এবারের বইমেলায় ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৮৪ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতবছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি, আর ইউনিট ছিল ৯৪৬টি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে ৩৬টি। গত বছরও প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি ছিল।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায় করা হয়েছে। সেখানে ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শিশু চত্বরে ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১২০ ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর শিশু চত্বরে ৬৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৯ ইউনিট দেওয়া হয়েছিল।
মেলার সূচি: প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার ও সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ৮ ফেব্রুয়ারি ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত থাকবে ‘শিশুপ্রহর’। অমর একুশ উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতা থাকছে। উদ্যানে থাকবে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।
১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
কোথায় কী: বাংলা একাডেমি বলছে, এবার সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতই রাখা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে মেলার বের হওয়ার পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির গেইটের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে। টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্ল্যান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট চারটি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ থাকবে।
খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সীমানা ঘেঁষে রাখা হয়েছে। নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবাও থাকছে। মন্দির গেইটের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে শিশু চত্বর, যাতে শিশুরা অবাধে চলতে-ফিরতে পারে।
বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির তিনটি প্যাভিলিয়ন ও শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার জন্য একটি স্টল থাকবে। এবারের বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ৪৩টি ও পুনর্মুদ্রিত ৪১টি বই। বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে আর্চওয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকছে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
মেলার বইয়ে পুলিশের অনুমোদন লাগবে, এমন কথা হয়নি: অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপিতে পুলিশের অনুমোদন লাগবে- এমন কোনো ‘সিদ্ধান্ত বা ‘পরামর্শ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
শনিবার ডিএমপি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, উসকানিমূলক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের পক্ষ থেকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করা হয়েছিল।
ডিএমপি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে, গত ৩১ জানুয়ারি বইমেলা উপলক্ষে ডিএমপি কর্তৃক গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং আয়োজন করা হয়। সেখানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের আলোকে মেলায় প্রকাশিত বই যাচাই-বাছাই সম্পর্কে বাংলা একাডেমির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বা কোনো উসকানিমূলক বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রকাশিতব্য বই আগামীতে পুলিশ কর্তৃক ভেটিং বা অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি বা বলা হয়নি।
ডিএমপি বলছে, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, লেখনীর মতো সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে আমরা সবসময় উৎসাহ দিই। মুক্ত মনের চর্চা ও বিকাশের পরিবেশকে আমরা স্বাগত জানাই। এ বিষয়ে ‘অহেতুক’ ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রচার হতে বিরত থাকার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
ডিএমপির নির্দেশনা: বইমেলা ঘিরে বেশকিছু নির্দেশনা তুলে ধরেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বইমেলার কারণে বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় রাস্তা বন্ধ অথবা রোড ডাইভারশন দেওয়া হবে।
ডাইভারশন পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে- টিএসসি/রাজু ভাস্কর্য ক্রসিং, তিন নেতার মাজার ও হাকিম চত্বর। পার্কিং স্থান- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মুহসীন হল মাঠ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে, ফুলার রোডে (এক লেনে) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে। শাহবাগ ক্রসিং থেকে টিএসসি হয়ে গাড়িযোগে মেলায় আগত দর্শনার্থীরা বইমেলার টিএসসি প্রবেশ গেইটের সামনে নামবেন এবং গাড়ি রাজু ভাস্কর্য ইউটার্ন-লেফটটার্ন করে বইমেলা সংশ্লিষ্ট পার্কিং স্থান অথবা গন্তব্যে যাবেন। নীলক্ষেত/ভিসি বাংলো ক্রসিং হতে টিএসসি হয়ে গাড়িযোগে মেলায় আসা দর্শনার্থীরা হাকিম চত্বর নেমে পায়ে হেটে মেলায় প্রবেশ করবেন এবং গাড়ি হাকিম চত্বর ইউটার্ন-রাইটটার্ন করে বইমেলা সংশ্লিষ্ট পার্কিং স্থান অথবা গন্তব্যে যাবেন।
হাই কোর্ট ও শহিদুল্লাহ হল ক্রসিং হতে দোয়েল চত্বর ক্রসিং হয়ে বাংলা একাডেমি অভিমুখে গাড়িযোগে মেলার দর্শনার্থীরা তিন নেতার মাজারের পাশে নামবেন এবং গাড়ি ইউটার্ন করে বইমেলা সংশ্লিষ্ট পার্কিং স্থান অথবা গন্তব্যে যাবেন।