নিজস্ব প্রতিবেদক: যেকোনো সময়ের তুলনায় গত কয়েক মাস ধরে দাবি আদায়ের বিক্ষোভ-আন্দোলনের শহরে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় নানান দাবি নিয়ে অনেক সংগঠন, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আন্দোলনে নামতে দেখা গেছে। এসব আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় অনেক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। মাঝে কিছুদিন শান্ত থাকলেও ফের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন বিভিন্ন পেশাজীবীরা ও শিক্ষার্থীরা। এতে নতুন করে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরিসহ পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে জড়িয়ে অনেকে আহত হয়েছেন। আর এসব আন্দোলন ঘিরে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীবাসী। এসব কারণে তীব্র যানজট মুখোমুখি ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ মাসে কেবল ঢাকায় কমপক্ষে ১৩৬টি বিক্ষোভ হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিক্ষোভের ফলে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য এসব বিক্ষোভ দমাতে সরকার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি।
গত ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড় অবরুদ্ধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। শুধু সায়েন্সল্যাবই নয় এসময় পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার ও মিরপুর টেকনিক্যাল মোড়ও অবরোধ করে তারা। এতে চতুর্মুখী সড়কে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। চরম ভোগান্তিতে পড়তে দেখা যায় রাজধানীতে চলাচল করা নানান শ্রেণি-পেশার মানুষদের।
আর এ ঘটনা থেকেই ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত চলা এই ঘটনা উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাংবাদিক ও কয়েকজন পথচারীসহ অনেকে আহত হয়েছেন।
এছাড়া ২৬ জানুয়ারি দুপুরে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের ঘোষণাসহ ছয় দফা দাবিতে সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নেয় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোট। অবস্থান কর্মসূচি থেকে স্মারকলিপি দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করলে শাহবাগে মোড়ে লাঠিপেটা করে পুলিশ। পাশাপাশি জলকামান ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। আন্দোলন করা শিক্ষকদের মঙ্গলবারও শাহবাগ এলাকায় অবস্থান করতে দেখা গেছে।
তার আগের দিন গত ২৪ জানুয়ারি দশম গ্রেড বেতন স্কেলের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরের পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে পদযাত্রা শুরু করেন তারা। শাহবাগ থানার সামনে এলে পদযাত্রাটিতে বাধা দেয় পুলিশ। সর্বশেষ গতকাল সোমবার মধ্যে রাত থেকে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
এই কর্মবিরতির কারণে ট্রেন না ছাড়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে যাত্রীরা মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী রেলস্টেশনে ভাঙচুর চালান। স্টেশনে যাত্রীদের বসার জন্য থাকা চেয়ারগুলো ভাঙচুর করেন। এ সময় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা স্টেশনের ভেতরের বিভিন্ন রুমের দরজা ধাক্কাধাক্কি করেন।
জানা যায়, মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক-সুবিধা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন রানিং স্টাফরা। গত বুধবার চট্টগ্রামে পুরনো রেলস্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করে ২৭ জানুয়ারির মধ্যে দাবি মানার শর্ত দেয় রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন। অন্যথায় ২৮ জানুয়ারি থেকে রেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় তারা।
সম্প্রতি ছোট-খাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সংঘাত বেড়েছে। আকস্মিক সৃষ্টি হওয়া এসব সংঘাতের ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনটির এক বার্তায় বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মুহাম্মদ রাকিবসহ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ নির্মম হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ আরও ভালো রাখতে সরকারকে আরও বেশি সক্রিয় ও উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেন তারা।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এসব আন্দোলন ও বিক্ষোভ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। সারাদেশ রেল চলাচল বন্ধ নিয়ে আহম্মেদ আবু জাফর নামে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘রেলপথ একটি রাষ্ট্রীয় গণপরিবহন; এটি বন্ধ রেখে আন্দোলন বেমানান।’ একই বিষয় নিয়ে মারুফ মল্লিক নামে আরেকজন তার ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ওয়ালে লেখেন, ‘রেলের স্টাফরা সাতদিন আগেই ঘোষণা করেছিলেন তারা দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘট করবেন। এই সাতদিন সরকার আলোচনার উদ্যোগ নেয়নি কেন? ’
ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত কোর কমিটির বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে ডিএমপি কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী জানান, ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ঘটনা পুলিশ ধৈর্য সহকারে মোকাবিলা করেছে। পুলিশ মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি। সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার সেল ব্যবহার করেছে। যে কারণে রক্তক্ষয়ী কোনও ঘটনা ঘটেনি।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে আমাদের প্রচেষ্টার কোনও ঘাটতি নেই। সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে, অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে পুলিশ কাজ করছে। কারও উসকানিতে কোনও ধরণের বিশৃঙ্খলা যেন সৃষ্টি না হয়। সে দিকেও আমরা সতর্ক রয়েছি।
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক দাবিতে হওয়া এসব আন্দোলনের ফলে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি এবং জনদুর্ভোগে পড়া নগরবাসীর মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।