রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় নতুন পদ্ধতিতে যানজট নিয়ন্ত্রণে রাস্তার মাঝে রশি টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিজয় সরণিতে যানজট নিরসনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। সিগন্যালে রশি টানিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। বিনা প্রচারে সিগন্যালের ইউটার্ন বন্ধ করে একমুখী যানচলাচলের ব্যবস্থা করায় বিড়ম্বনায় পড়েছেন যাত্রীরা।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিজয় সরণি সিগন্যালে রাস্তার মাঝখানে রশি টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে যানবাহনগুলো ট্রাফিক সিগন্যাল ভঙ্গ করতে না পারে। জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা যানবাহনগুলোকে বিজয় সরণি থেকে ডানে মোড় নিতে দেওয়া হচ্ছে না। মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি রুটের গাড়িগুলোকে প্রধান উপদেষ্টার অফিসের সামনে থেকে পুরাতন বিমানবন্দরে নতুন রাস্তা দিয়ে চলাচলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ফার্মগেট থেকে আসা যানবাহনগুলোকে ডানে বা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এসব গাড়িগুলো প্রধান উপদেষ্টার অফিসের সামনে দিয়ে ইউটার্ন নিতে বলা হচ্ছে।
ট্রাফিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে যানজট নিরসনে বিভিন্ন সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ট্রাফিক বিভাগ। বিভিন্ন সড়কে যানজট নিরসনে সুফলও পেয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার (২৫ জানুয়ারি) থেকে বিজয় সরণি সিগন্যালের দুটি সড়কে একমুখী যানচলাচলে বাধ্য করছে ট্রাফিক পুলিশ। তবে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।
রাজধানীর অন্যতম ট্রাফিক সিগন্যাল ঘেরা মোড় বিজয় সরণি। দূর কিংবা কাছের সংশ্লিষ্ট বিজয় সরণি সিগন্যাল পার হতে হয় অধিকাংশ রুটের যানবাহনকে। মোট ৮টি লেনে যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে অতীতে সব ধরনের চেষ্টাই বলা যায় এখানে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন করে শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সকাল থেকে সেখানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু করেছে ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশ।
‘নতুন নিয়মে’ ওই এলাকার সড়কে যান চলাচলের অবস্থা পর্যবেক্ষণে দুপুর ১টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশের হিমশিম অবস্থা। মাইকিং করেও যানবাহন চালকদের বোঝানো যাচ্ছে না নতুন নিয়মের কথা। এর মধ্যে আবার কথিত ভিআইপিদের নিয়মের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো যেকোনো সড়কে ঢুকে পড়ায় চাপে পড়ছে ট্রাফিক পুলিশের নতুন নিয়ম।
সরেজমিন দেখা যায়, মাইক হাতে অনবরত ট্রাফিক কনস্টেবল রাকিবুল ইসলাম বলে যাচ্ছেন, এখানে না, এখানে ইউটার্ন বন্ধ, সামনে থেকে (ফার্মগেট) ইউটার্ন করে আসুন। আবার অনেক গাড়ির চালক বিজয় সরণি মোড়ে এসে আটকে যাচ্ছেন রশি টানা দেখে। গ্লাস খুলে অনেক চালককে অবাক হতে দেখা যায়, জটিলতা বুঝতে কথা বলছেন দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। কেউ জানতে চাইছেন কেন বন্ধ, সামনে কোথায় ইউটার্ন করব? কাউকে কাউকে ধমকের সুরে কথা বলতে শোনা যায় ট্রাফিক শৃঙ্খলার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে।
শুরুর দিনটা আজ তবুও ভালো বলছেন মাঠপর্যায়ের দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে তারা এও বলছেন, আজ তো শনিবার। সড়কে যানবাহনের চাপ তুলনামূলক কম। নতুন নিয়ম বাস্তবায়নের অগ্নিপরীক্ষা বলতে পারেন কাল রোববার থেকে শুরু হবে। আজই মানতে, শুনতে চাইছেন না চালকরা। কাল যে কী হবে, আগাম টের পাওয়া যাচ্ছে।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ অ্যাভিনিউসহ বিভিন্নস্থানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগের নতুন পদ্ধতি চালুর কারণে যানজট কমেছে, সুফলও পাচ্ছেন জনসাধারণ। সেটা দেখে উৎসাহিত হয়ে বিজয় সরণি ক্রসিংয়ের চারপাশের রাস্তায় সৃষ্ট যানজট কমানোর লক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) যানবাহন চলাচল সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। যা শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে।
কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, খেজুর বাগান ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউগামী যানবাহন বিজয় সরণি মোড়ে ডানে মোড় নিতে পারবে না। এসব যানবাহন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) প্রবেশ গেটের আগে ডানে মোড় নিয়ে আগারগাঁও লিঙ্ক রোডে উঠবে এবং বিআইসিসি মোড় অথবা আগারগাঁও ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে। এই নতুন নিয়ম বাস্তবায়নে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে নগরবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরগেট থেকে ইনকামিং গাড়ি বিজয় সরণিতে এসে সোজা ও বামে ফ্লাইওভারের দিকে টার্ন করতে পারছে। তবে মাঝে ডানে উড়োজাহাজ ক্রসিংয়ের দিকে যাওয়ার পথ বন্ধ। অর্থাৎ রশি দিয়ে বরাবর চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আটকে দেওয়া হচ্ছে পথ। কিন্তু সমস্যা তৈরি করছে ফার্মগেট থেকে আসা যানবাহনের কোনোটা আবার যেতে পারছে না তেজগাঁও ফ্লাইওভারের দিকে। অধিকাংশ যানবাহনকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে ইউটার্ন করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও কিছু গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে রশির কাছে। এতে করে পেছনে সোজা ফার্মগেট থেকে জাহাঙ্গীর গেট বরাবর চলা যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে সামনে আটকে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনের কারণে।
আবার তেজগাঁও ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসা লেন ও উড়োজাহাজ ক্রসিংয়ের দিক থেকে আসা লেনের যানবাহন এক সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন তেজগাঁও ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসা ফার্মগেট অভিমুখি গাড়ি যেমন গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে, তেমনি উড়োজাহাজ ক্রসিং থেকে বামে যাওয়া জাহাঙ্গীর গেটগামী লেনে গতি ফিরছে।
কিন্তু সমস্যা যেটা হচ্ছে তা হলো- উড়োজাহাজ ক্রসিং থেকে ফার্মগেটের দিকে যাওয়ার গাড়িকে ট্রাফিক পুলিশকে আটকে রাখতে হচ্ছে। একহাতে আটকে রাখার সিগন্যাল ও আরেক হাতে সোজা যাওয়ার সিগন্যাল দিতে হচ্ছে পুলিশকে। একই সময় আবার তেজগাঁও ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসা যানবাহন উড়োজাহাজ ক্রসিং অভিমুখগামী যানবাহন দ্রুতগতিতে যাওয়া শুরু করলেও একই সময়ে ডানে জাহাঙ্গীরগেটগামী যানবাহন আটকে যাচ্ছে বিজয় সরণির মাঝ বরাবর সড়কে। সব মিলে নতুন নিয়ম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থার মধ্যে পড়েছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। এর মধ্যে সমস্যা তৈরি করছে ভিআইপির আগমন কিংবা কথিত ভিআইপির একরোখা আচরণে মাঝ বরাবর পর্যন্ত চলে আসায় কিংবা অ্যাম্বুলেন্সের উল্টো যাত্রায়। তাতে সব শৃঙ্খলা আগের মতোই বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিজয় সরণি মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল রাকিবুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে মাইকে চিৎকার করে বলে যাচ্ছি, এখানে রাইট (ডান) টার্ন বন্ধ, সামনে যান। ফার্মগেট থেকে ইউটার্ন করে আসুন। মাইকে একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দিকে। কিন্তু অনেকেই শুনতে চাইছেন না। বরং দাঁড়িয়ে কিংবা আটকে থেকে এক রকম জোরপূর্বক টার্ন নিতে চাইছেন। বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠানো হচ্ছে। অনেকে রাগ দেখাচ্ছেন, অনেকে বকছেন, অনেকে আবার নীরবে চলে যাচ্ছেন। এতে করে যে লক্ষ্য নিয়ে এই নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়নের চেষ্টাই সেই সড়কের গতিটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আরিফুজ্জামান বলেন, সুবিধা বিবেচনায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখানে নতুন পদ্ধতি চালু করেছেন। সেটা বাস্তবায়নে চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখতেই পাচ্ছেন কি কি সমস্যা হচ্ছে। জানি না কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব। আজ প্রথম দিন তাও ভালোই হচ্ছে। কিন্তু কালকে কি হবে সেটা বলা মুশকিল। কারণ রোববার। সড়কের চাপ কাল (রোববার) পুরোদমে হবে।
মোটরসাইকেল চালক ইকবাল বলেন, আমাকে এখানে দাঁড়াতে বা টার্ন করতে দেওয়া হয়নি। টার্ন হলেও সেকেন্ডেই পার হতে পারতাম। কিন্তু ফার্মগেট হয়ে ইউটার্ন করে যখন আমি উড়োজাহাজ ক্রসিংয়ের দিকে যাচ্ছি সামনে সোজা পথের যানবাহনে আমার লেফট টার্নের লেন বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে আমাকে অন্তত ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এটা ফলপ্রসূ হবে যদি সড়ক সচল থাকে।
সেখানকার দায়িত্বরত আরেক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ অ্যাভিনিউয়ের মতো অবস্থা এখানে নয়। কারণ ওই দুই জায়গায় বিকল্প সড়ক ছিল। ইউটার্ন করার মতো বড় বা পর্যাপ্ত প্রশস্তের সড়ক আছে। এখানে বিকল্প পদ্ধতি বাস্তবায়নে বিকল্প সড়ক নেই। দুটো লেন একসঙ্গে চালু রাখলেও বাকি দুটো লেন আটকে রাখতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা ৭০ শতাংশ যানবাহন ডানে টার্ন নিয়ে উড়োজাহাজ ক্রসিং হয়ে মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, খেজুর বাগান ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিরপুর, শ্যামলীর দিকে চলে যেতো। সেসব যানবাহনকে এখন ফার্মগেটে যেতে হচ্ছে, না বোঝার কারণে। এসব যানবাহন কিন্তু নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) প্রবেশ গেটের আগে ডানে মোড় নিয়ে লিঙ্ক রোড হয়ে আগারগাঁও বা বিআইসিসি মোড় হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাবে। আবার তেজগাঁও ফ্লাইওভার হয়ে আসা ৭০ শতাংশ যানবাহন সোজা যায়। ১৫ বা ২০ শতাংশ যানবাহন কিন্তু বিজয় সরণি মোড়ে এসে গেদারিং করছে ডানে জাহাঙ্গীর গেটে যাবেন বলে। সব মিলিয়ে কি সমাধান হবে জানি না। চেষ্টা করে দেখা যাক। আপাতত সমাধান দেখছি না।
বিজয় সরণি মোড়ের মাঝখানে আটকে এক সিএনজিচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিজয় সরণি সিগন্যালে না দাঁড়িয়ে কোনোদিন যদি পার হতে পারি তাহলে আলহামদুলিল্লাহ বলি। কারণ এখানে আটকে যাওয়া মানে দিনের ১৫/২০ মিনিট লস। সিগন্যাল ছাড়া পার হওয়াটা এখানে স্বপ্নের মতো। সেটা ৯৯ শতাংশ দুঃস্বপ্নই উপহার দিয়েছে। আজকেও আটকে গেলাম। আজকেরটা বেশি যন্ত্রণার। সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়া কিন্তু ডানে মহাখালী যাবো, যেতে পারছি না, আটকে আছি মাঝখানে।
সেখানকার বয়স্ক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, এই এলাকায় ১৫ বছর কাটিয়ে দিলাম। এখানে কোনো নিয়মেই সমাধান আসেনি। ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস কিংবা ওভারপাস ছাড়া এখানে আমি সমাধান দেখি না।
জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর এলাকার ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার উদয় কুমার সাহা বলেন, কি হবে বা হতে পারে? সমাধান আদৌ হবে কিনা সেটা দেখার জন্য হলেও তো এটা জারি রাখতে হবে। বিজয় সরণি মোড়ের ট্রাফিক শৃঙ্খলার স্বার্থে এটা করতে গিয়ে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে, বিকল্প কি হতে পারে সেটা বের করা সম্ভব। দেখতে হবে রোববার দিনটা কেমন যায়।