ঢাকা ০৪:৩৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সঞ্চয় ভেঙে টিকে থাকার চেষ্টা

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৫:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা : কঠিন হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকার জীবনযাত্রা। বিগত কয়েক বছরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বছরের শুরুতেই একগাদা খরচের চাপ আসে জগদ্দল পাথরের মতো। বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ। সঙ্গে যোগ হয় মূল্যস্ফীতি কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কারণে অতিরিক্ত পণ্যমূল্য। এমনই পরিস্থিতির শিকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসাদুজ্জমান। রাজধানীর দুই রুমের ফ্ল্যাটে সম্প্রতি তার মাকে নিয়ে এসেছেন। এখন আছেন বেশ বিপাকে। গত মাসে প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে টাকা উঠিয়েছেন। আয়-ব্যয়ের ব্যাপক অসংগতি। উল্টো এখন পরিবার গ্রামে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্য সঞ্চয়ও তো দরকার। বলেন, ‘সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এতে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি দামে। কষ্ট করে হলেও আগে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা ব্যাংকে ডিপিএস করতাম। এখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাজার খরচ। যাতায়াত, বাসাভাড়া, চিকিৎসাসহ অন্য খরচ তো আছেই। বিপরীতে সেভাবে ইনক্রিমেন্ট হয়নি। নিরুপায় হয়ে গত দুই মাস ডিপিএস বন্ধ করেছি। তবুও চলা কঠিন হচ্ছে। শিগগির পরিবার গ্রামে রেখে আসবো, ইতোমধ্যে বাসাও ছেড়ে দিয়েছি।’
দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই বছর ধরে দুই অঙ্কে। নিত্যপণ্যসহ ফলমূলের দাম চড়া। এর মধ্যে শতাধিক পণ্যে বসেছে অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স। যার প্রভাবে অন্য পণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। সব ক্ষেত্রে খরচ বাড়ায়, টান পড়ছে সঞ্চয়ে। এতে বেশি বিপাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কারও সঞ্চয় শূন্য, কেউ সঞ্চয় ভেঙে চলছেন। এই শহরে টিকে থাকতে কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে ব্যাচেলর জীবন বেছে নিতেও বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ চেইন, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে পার্থক্য এজন্য দায়ী। প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি নজর দিতে হবে স্থিতিশীলতার দিকে। যদিও সরকার বলছে, সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম। মাসে প্রায় অর্ধলাখ টাকা বেতন তার। তবু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাছে অসহায় তিনি। সঞ্চয় শূন্য। বড় কোনো দুর্ঘটনা হলেই হাত পাততে হয় অন্যের কাছে। বলেন, ‘একটা সময় মেসে থেকে পড়াশোনা করেছি। তখন যেমন টানাপোড়েন ছিল, এখনো তেমনই আছি। এখন আয় বেড়েছে, সঙ্গে ব্যয়ও। বাচ্চার পড়াশোনা, বাসাভাড়া, নিত্যপণ্য আর যাতায়াতের পেছনেই সব চলে যায়। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে থেকে গেছি। গত মাসে মায়ের অপারেশনের জন্য ৪৫ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল সেটাও ধার করে সেরেছি।’ গ্রামে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সাবলেটে উঠেছেন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মারুফ। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘একটা সময় কিছুটা সঞ্চয় ছিল। পরে বিয়ে হলো, মা-বাবা ও স্ত্রীকে ঢাকায় আনলাম। চলেছি দুই বছর। এতেই সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। তিন মাস হলো পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। সময় পেলে গ্রামে যাই। অন্তত খরচটা কমেছে। এছাড়া উপায় ছিল না। সন্তান বড় হলে হয়তো নিয়ে আসতে হবে, ততদিনে সঞ্চয় করার চেষ্টা থাকবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সার্বিক কর্মকাণ্ডে। আমানত প্রবাহ কমেছে এ দুই খাতেই। আগের প্রান্তিকে বাড়লেও এখন কমেছে কোটিপতিদের আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সবশেষ হিসাব বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৬ হাজার কোটিপতি যাদের সবাই এক কোটি টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করেছেন। তাদের টাকা উত্তোলনের কারণে ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স দেড় হাজারের বেশি মানুষের কোটি টাকার নিচে নেমেছে। গত বছরের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকে আমানত ছিল ১৮ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে এক হাজার ৬৫৭ জন। জুন শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪ জন। পরের প্রান্তিক সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭ জনে। কোটিপতিদের আমানতও কমেছে। এদিকে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম সঞ্চয়পত্র বিক্রিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। মূলত ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমছে মানুষের। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এর প্রভাব অনেক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম তিন (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাসে ১৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিক্রি হয়েছিল ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের আসল বাবদ গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে ছয় হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরে সঞ্চয়পত্রের আসল পরিশোধ বাবদ সরকারের খরচ কমেছে ১৬ হাজার ২৬২ কোটি টাকা।
নানাবিধ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর ঋণ জালিয়াতির কারণে গত দুই বছর তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে প্রায় ১২ ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল আটটি ব্যাংক। পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট আরও প্রকট হয়। ব্যাংকগুলো নিয়ে গ্রাহকের আস্থা কমে যাওয়ায় তারা টাকা তোলা শুরু করেন। এতে ব্যাংকগুলোয় নতুন করে আমানত রাখার পরিবর্তে তোলার পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে তীব্র হয়েছে তারল্য সংকট। দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে তারল্য গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। টাকা ছাপিয়েও দেওয়া হচ্ছে তারল্য সহায়তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘ব্যাংকে গ্রাহকের আমানতের টাকা নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই।’ তবে ব্যাংকাররা বলছেন আস্থাহীনতা নয়, বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চলতে পারছেন না গ্রাহক। এতে টাকা তুলে নিচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এর বিপরীতে আয় বাড়েনি। অনেক গ্রাহক চলতে পারছেন না। বাধ্য হচ্ছেন সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালাতে।’ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাবিহা আহমেদ বলেন, ‘আমার এক ছেলের ওপর সংসার চলে। আমার যা সঞ্চয়পত্রের লাভ তা দিয়ে চিকিৎসাসহ অন্য খরচ চলছিল। কিন্তু সব কিছুর দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এখন ছেলেকে টাকা দেবো। সে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করবে। আমি সঞ্চয় ভাঙতে এসে দেখি আমার মতো অনেকেই ভাঙছেন।’ অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘অনেক সমস্যা যা কি না চলে আসছিল এবং এখনো চলমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এর মধ্যে অন্যতম। যে কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে পার্থক্য এজন্য দায়ী। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর প্রতিফলন এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আরও একটু সময় লাগবে হয়তো।’ জানা গেছে, দেশের মানুষের সংকটের মূলে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সেটা সরকারও অবগত। এ নিয়ে পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একনেক সভায় বলেন, ‘সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো জিনিসের মূল্য একবার বাড়লে সেটি কমানো কঠিন। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’ বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতিই বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি গত দুই মাসে কমেছে কিছুটা। কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি তো এখন প্রায় ১৩। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে মানুষের সংকটও দূর হবে।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আর্থিক খাতের ‘ডাকাতি’ খতিয়ে দেখতে প্রতিনিধি পাঠানোর আহ্বান :ড. ইউনূস

সঞ্চয় ভেঙে টিকে থাকার চেষ্টা

আপডেট সময় : ০৮:৪৫:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

বিশেষ সংবাদদাতা : কঠিন হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকার জীবনযাত্রা। বিগত কয়েক বছরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বছরের শুরুতেই একগাদা খরচের চাপ আসে জগদ্দল পাথরের মতো। বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ। সঙ্গে যোগ হয় মূল্যস্ফীতি কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কারণে অতিরিক্ত পণ্যমূল্য। এমনই পরিস্থিতির শিকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসাদুজ্জমান। রাজধানীর দুই রুমের ফ্ল্যাটে সম্প্রতি তার মাকে নিয়ে এসেছেন। এখন আছেন বেশ বিপাকে। গত মাসে প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে টাকা উঠিয়েছেন। আয়-ব্যয়ের ব্যাপক অসংগতি। উল্টো এখন পরিবার গ্রামে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্য সঞ্চয়ও তো দরকার। বলেন, ‘সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এতে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি দামে। কষ্ট করে হলেও আগে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা ব্যাংকে ডিপিএস করতাম। এখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাজার খরচ। যাতায়াত, বাসাভাড়া, চিকিৎসাসহ অন্য খরচ তো আছেই। বিপরীতে সেভাবে ইনক্রিমেন্ট হয়নি। নিরুপায় হয়ে গত দুই মাস ডিপিএস বন্ধ করেছি। তবুও চলা কঠিন হচ্ছে। শিগগির পরিবার গ্রামে রেখে আসবো, ইতোমধ্যে বাসাও ছেড়ে দিয়েছি।’
দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই বছর ধরে দুই অঙ্কে। নিত্যপণ্যসহ ফলমূলের দাম চড়া। এর মধ্যে শতাধিক পণ্যে বসেছে অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স। যার প্রভাবে অন্য পণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। সব ক্ষেত্রে খরচ বাড়ায়, টান পড়ছে সঞ্চয়ে। এতে বেশি বিপাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কারও সঞ্চয় শূন্য, কেউ সঞ্চয় ভেঙে চলছেন। এই শহরে টিকে থাকতে কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে ব্যাচেলর জীবন বেছে নিতেও বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ চেইন, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে পার্থক্য এজন্য দায়ী। প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি নজর দিতে হবে স্থিতিশীলতার দিকে। যদিও সরকার বলছে, সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম। মাসে প্রায় অর্ধলাখ টাকা বেতন তার। তবু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কাছে অসহায় তিনি। সঞ্চয় শূন্য। বড় কোনো দুর্ঘটনা হলেই হাত পাততে হয় অন্যের কাছে। বলেন, ‘একটা সময় মেসে থেকে পড়াশোনা করেছি। তখন যেমন টানাপোড়েন ছিল, এখনো তেমনই আছি। এখন আয় বেড়েছে, সঙ্গে ব্যয়ও। বাচ্চার পড়াশোনা, বাসাভাড়া, নিত্যপণ্য আর যাতায়াতের পেছনেই সব চলে যায়। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে থেকে গেছি। গত মাসে মায়ের অপারেশনের জন্য ৪৫ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল সেটাও ধার করে সেরেছি।’ গ্রামে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সাবলেটে উঠেছেন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মারুফ। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘একটা সময় কিছুটা সঞ্চয় ছিল। পরে বিয়ে হলো, মা-বাবা ও স্ত্রীকে ঢাকায় আনলাম। চলেছি দুই বছর। এতেই সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। তিন মাস হলো পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। সময় পেলে গ্রামে যাই। অন্তত খরচটা কমেছে। এছাড়া উপায় ছিল না। সন্তান বড় হলে হয়তো নিয়ে আসতে হবে, ততদিনে সঞ্চয় করার চেষ্টা থাকবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সার্বিক কর্মকাণ্ডে। আমানত প্রবাহ কমেছে এ দুই খাতেই। আগের প্রান্তিকে বাড়লেও এখন কমেছে কোটিপতিদের আমানত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সবশেষ হিসাব বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৬ হাজার কোটিপতি যাদের সবাই এক কোটি টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করেছেন। তাদের টাকা উত্তোলনের কারণে ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স দেড় হাজারের বেশি মানুষের কোটি টাকার নিচে নেমেছে। গত বছরের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকে আমানত ছিল ১৮ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে এক হাজার ৬৫৭ জন। জুন শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪ জন। পরের প্রান্তিক সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭ জনে। কোটিপতিদের আমানতও কমেছে। এদিকে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের অন্যতম মাধ্যম সঞ্চয়পত্র বিক্রিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। মূলত ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমছে মানুষের। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এর প্রভাব অনেক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম তিন (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাসে ১৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিক্রি হয়েছিল ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে নতুন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের আসল বাবদ গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে ছয় হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরে সঞ্চয়পত্রের আসল পরিশোধ বাবদ সরকারের খরচ কমেছে ১৬ হাজার ২৬২ কোটি টাকা।
নানাবিধ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর ঋণ জালিয়াতির কারণে গত দুই বছর তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে প্রায় ১২ ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল আটটি ব্যাংক। পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট আরও প্রকট হয়। ব্যাংকগুলো নিয়ে গ্রাহকের আস্থা কমে যাওয়ায় তারা টাকা তোলা শুরু করেন। এতে ব্যাংকগুলোয় নতুন করে আমানত রাখার পরিবর্তে তোলার পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে তীব্র হয়েছে তারল্য সংকট। দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে তারল্য গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। টাকা ছাপিয়েও দেওয়া হচ্ছে তারল্য সহায়তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘ব্যাংকে গ্রাহকের আমানতের টাকা নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই।’ তবে ব্যাংকাররা বলছেন আস্থাহীনতা নয়, বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চলতে পারছেন না গ্রাহক। এতে টাকা তুলে নিচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এর বিপরীতে আয় বাড়েনি। অনেক গ্রাহক চলতে পারছেন না। বাধ্য হচ্ছেন সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালাতে।’ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাবিহা আহমেদ বলেন, ‘আমার এক ছেলের ওপর সংসার চলে। আমার যা সঞ্চয়পত্রের লাভ তা দিয়ে চিকিৎসাসহ অন্য খরচ চলছিল। কিন্তু সব কিছুর দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। এখন ছেলেকে টাকা দেবো। সে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করবে। আমি সঞ্চয় ভাঙতে এসে দেখি আমার মতো অনেকেই ভাঙছেন।’ অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘অনেক সমস্যা যা কি না চলে আসছিল এবং এখনো চলমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এর মধ্যে অন্যতম। যে কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হচ্ছে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে পার্থক্য এজন্য দায়ী। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর প্রতিফলন এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আরও একটু সময় লাগবে হয়তো।’ জানা গেছে, দেশের মানুষের সংকটের মূলে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সেটা সরকারও অবগত। এ নিয়ে পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একনেক সভায় বলেন, ‘সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো জিনিসের মূল্য একবার বাড়লে সেটি কমানো কঠিন। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’ বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতিই বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি গত দুই মাসে কমেছে কিছুটা। কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি তো এখন প্রায় ১৩। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে মানুষের সংকটও দূর হবে।’