ঢাকা ০৩:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ,শুরুতে উচ্চাশা, পরে হতাশা

  • আপডেট সময় : ০৭:৫৯:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গঠন করা হয় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা পেতে সংস্থাটির সাম্প্রতিক কার্যক্রমে ধীরগতি ও প্রশাসনিক জটিলতার অভিযোগ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সেবাপ্রার্থীরা। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু হয়।

লক্ষ্য ছিল আহত ও শহীদ পরিবারের দ্রুত পুনর্বাসন এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা। শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমানকে (স্নিগ্ধ) সাধারণ সম্পাদক করে সংস্থাটির ৭ সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। পরে ২১ অক্টোবর ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সমাজসেবা অধিদফতর সংস্থাটির কার্যকরী পরিষদের অনুমোদন দেয়। সংস্থাটির প্রকাশ করা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফাউন্ডেশনটি ইতোমধ্যে সোনালী ব্যাংকে খোলা অ্যাকাউন্টে ১০৯ কোটি ২০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে এবং ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ২৭২০টি শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বিতরণ করেছে।

ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে ধীরগতি এবং সেবাপ্রার্থীদের প্রতি উদাসীন মনোভাব এখন ফাউন্ডেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে মনে করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট অনেকেই। শুরুর দিকে এর কার্যক্রম আশার আলো তৈরি করলেও পরবর্তীতে নানান বিড়ম্বনায় সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে চিকিৎসার দাবি জানিয়ে কখনও পঙ্গু হাসপাতালের সামনে, কখনও উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে, আবার কখনও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নেন আহতরা। সেখান থেকে তারা জানান, সরকার দ্রুত জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠন করে আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু তাদের কার্যক্রম এখন হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিভিন্ন সময় শহীদ পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের দ্রুত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসা আন্দোলনে আহত জিহাদ ইসলাম বলেন, ‘আমি ৭ দফা দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফাউন্ডেশন থেকে যে ডাক্তারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল, সেই ডাক্তার আমাকে দেখে ফাউন্ডেশন থেকে টাকা নিয়ে চিকিৎসার কথা বলেন।

গত ২৭ নভেম্বর আবেদন করলেও এখনও টাকা পাইনি। শুধু আমি নই, অনেকেই এখন অবহেলার শিকার হচ্ছেন। সরকার শুরুতে আশা দেখিয়ে এখন আমাদের হতাশ করছে। শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন, ফাউন্ডেশনের অফিসে সেবা পেতে বারবার ধরনা দিতে হচ্ছে। অনেকেই জরুরি চিকিৎসার আবেদন করেও সময়মতো সাড়া পাচ্ছেন না।

ফাইল জমা দেওয়া থেকে শুরু করে অনুদান পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বলে জানান আহতরা। আন্দোলনে আহত মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ সুপ্ত অভিযোগ করেন, ‘ফাউন্ডেশনের কাজ অনেক ধীরগতিতে চলছে। প্রয়োজনের তুলনায় স্টাফ সংখ্যা অনেক কম।

যারা ফাইলের আপডেট নিতে যায় তাদের কোনোরকম বুঝ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সহায়তার আবেদনের পর আমাদের যে টোকেন নাম্বার দিয়েছে সেখানেও সিরিয়াল অনুযায়ী কাজ করছে না তারা।’ ঢাকার কিশোরীগঞ্জের বাসিন্দা মো. রতন ভূঁইয়া, যার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক কেস আইডি নাম্বার ২৭৫০০। তিনি বলেন, ’১৮ ডিসেম্বর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন শাহবাগ অফিসে সহায়তার আবেদন জমা দিয়ে টোকেন নাম্বার নিয়ে চলে এসেছি। এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও কোনও যোগাযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, শহীদ পরিবার ও আহতরা আজ অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত, বাচ্চাদের স্কুল ড্রেস পর্যন্ত বানাতে পারছি না। সারজিস আলম বলেছিলেন, ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার ৩ দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে, এখন দেখছি কথা ও কাজে মিল কম।’ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী। সম্প্রতি নাগরিক কমিটির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম সরকার আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে এবং প্রয়োজনে বিদেশে পাঠাবে। কিন্তু আমরা দেখছি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন ঠিকমত কাজ করছে না। তারা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে আমরা বারবার প্রশ্ন করেছি, তারা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে হতাশা প্রকাশ

ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেবাপ্রার্থীরা তাদের হতাশা এবং কষ্ট শেয়ার করার পর ফাউন্ডেশন কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাগুলো নির্ধারিত প্রক্রিয়ার বাইরে হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে ফাউন্ডেশনের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা নিয়েও। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ফাউন্ডেশনের অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সেবাগ্রহীতাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব না দেওয়া, প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া এবং দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করে সচেতন নাগরিক সমাজ।
ফাউন্ডেশনের বক্তব্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অভিযোগের পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তাদের ফেসবুক পেজে একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, ‘আমরা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহত ও শহীদদের পরিবারকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের প্রচেষ্টা সর্বদা সৎ ও স্বচ্ছ, তবে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কখনও কখনও কাজ সামান্য দেরি হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা জনমনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করছে। আমাদের উদ্দেশ্য কখনোই কোনও শহীদ পরিবারকে হেয় করা নয়। বরং, আমরা চাই সঠিক তথ্যের মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়াতে ও যথাযথ সহায়তা প্রদান করতে। তারপরও যদি আমাদের কোনও কথায় বা কাজে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমরা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা আপনাদের বিশ্বাস ও সহযোগিতা কামনা করি, যাতে শহীদদের আত্মত্যাগের যথাযথ সম্মান রক্ষা করতে পারি। বিভ্রান্তি এড়িয়ে সত্যকে জানুন, গুজবে কান দেবেন না।’

এদিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনকে সফল করতে প্রশাসনিক দক্ষতা ও আন্তরিকতার পাশাপাশি সেবার গুণগত মান বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, শহীদ ও আহত পরিবারগুলো এমনিতেই আর্থিক ও মানসিক চাপে রয়েছেন। তাদের প্রতি ফাউন্ডেশনের উদাসীনতা শুধু তাদের দুর্দশা বাড়াবে না, গণআন্দোলনের ন্যায়বিচার এবং স্মৃতিরক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যকেও ক্ষুণ্ন করবে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমি মনে করি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের তালিকা করা এবং পরিবারসহ তাদের দায়িত্ব নেওয়া, দেখাশোনা করা সরকারের দায়িত্ব। বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া বা বিভিন্ন সংগঠনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া, এটা কাজের সমন্বয়ের জন্য অসুবিধা হয়। এখন শহীদ পরিবারগুলো ও আহত ব্যক্তিদের বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। এটা অপমানজনক। এটাকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব হিসেবে রাখা উচিত ছিল। তিনি বলেন, ছয় মাস পার হয়ে গেছে আহতদের অনেকে চিকিৎসা পাননি। শহীদের তালিকা ঠিকমতো হয়নি। এগুলো ঠিক হয়নি। এটা তো কঠিন কিছু না। এগুলোর জন্য যারা অভিজ্ঞ, যারা এ ধরনের ফাউন্ডেশন পরিচালনা করেন তাদের সবাইকে নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে একটা কার্যকর কমিটি করে দেওয়া উচিত ছিল। তাদের সহায়তার জন্য ছাত্র সমন্বয়ক ও অন্যরা থাকতে পারতো।
গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন
বিতর্কের মুখে বুধবার (২২ জানুয়ারি) জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে সরে দাঁড়ান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি তার ফেসবুক পেজে এই ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ফাউন্ডেশনের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের কথা জানান। সেখানে তিনি জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আমি নেই। এই ফাউন্ডেশনের গতি ত্বরান্বিত করার জন্য ফাউন্ডেশনের গঠনতন্ত্র, কাঠামো ও কাজের প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ফাউন্ডেশনে এখন থেকে ‘এক্সিকিউটিভ কমিটি’ পুরো অফিসের সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সেখানে অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন৷ মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বর্তমানে সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এবং ‘গভর্নিং বডি’ ফাউন্ডেশনের পলিসি মেকিংয়ে কাজ করবে। এই বডিতে প্রধান উপদেষ্টাসহ ৪ জন উপদেষ্টা রয়েছেন (স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, স্থানীয় সরকার ও আইসিটি)। ‘সাধারণ সম্পাদক’ নামে কোনও পদ থাকবে না ফাউন্ডেশনে। তিনি আরও বলেন, এই দায়িত্ব পালনকালে আমি ফাউন্ডেশন থেকে কোনও বেতন বা সম্মানি নেইনি। যতদিন পর্যন্ত আমি আমার সর্বোচ্চ সময় ফাউন্ডেশনে দিতে পেরেছি ততদিন আমি দায়িত্ব পালন করেছি। যখন মনে হয়েছে এখন থেকে ফাউন্ডেশনে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া আমার জন্য সম্ভব হবে নয়, তখন আমি দায়িত্ব থেকে সরে এসেছি। আমার কাছে নিজের সীমাবদ্ধতা অ্যাড্রেস করা এবং সে অনুযায়ী দায়িত্ব গ্রহণ বা ত্যাগ করা কোনও দুর্বলতা নয় বরং এটাতে সৎ সাহস লাগে। আমি চেষ্টা করেছি আমার চেয়ারের দায়িত্বের সঙ্গে সৎ থাকতে।

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আর্থিক খাতের ‘ডাকাতি’ খতিয়ে দেখতে প্রতিনিধি পাঠানোর আহ্বান :ড. ইউনূস

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ,শুরুতে উচ্চাশা, পরে হতাশা

আপডেট সময় : ০৭:৫৯:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

বিশেষ সংবাদদাতা : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গঠন করা হয় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা পেতে সংস্থাটির সাম্প্রতিক কার্যক্রমে ধীরগতি ও প্রশাসনিক জটিলতার অভিযোগ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সেবাপ্রার্থীরা। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু হয়।

লক্ষ্য ছিল আহত ও শহীদ পরিবারের দ্রুত পুনর্বাসন এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা। শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমানকে (স্নিগ্ধ) সাধারণ সম্পাদক করে সংস্থাটির ৭ সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। পরে ২১ অক্টোবর ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সমাজসেবা অধিদফতর সংস্থাটির কার্যকরী পরিষদের অনুমোদন দেয়। সংস্থাটির প্রকাশ করা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফাউন্ডেশনটি ইতোমধ্যে সোনালী ব্যাংকে খোলা অ্যাকাউন্টে ১০৯ কোটি ২০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে এবং ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ২৭২০টি শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বিতরণ করেছে।

ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে ধীরগতি এবং সেবাপ্রার্থীদের প্রতি উদাসীন মনোভাব এখন ফাউন্ডেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে মনে করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট অনেকেই। শুরুর দিকে এর কার্যক্রম আশার আলো তৈরি করলেও পরবর্তীতে নানান বিড়ম্বনায় সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে চিকিৎসার দাবি জানিয়ে কখনও পঙ্গু হাসপাতালের সামনে, কখনও উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে, আবার কখনও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নেন আহতরা। সেখান থেকে তারা জানান, সরকার দ্রুত জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠন করে আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু তাদের কার্যক্রম এখন হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিভিন্ন সময় শহীদ পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের দ্রুত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসা আন্দোলনে আহত জিহাদ ইসলাম বলেন, ‘আমি ৭ দফা দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফাউন্ডেশন থেকে যে ডাক্তারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল, সেই ডাক্তার আমাকে দেখে ফাউন্ডেশন থেকে টাকা নিয়ে চিকিৎসার কথা বলেন।

গত ২৭ নভেম্বর আবেদন করলেও এখনও টাকা পাইনি। শুধু আমি নই, অনেকেই এখন অবহেলার শিকার হচ্ছেন। সরকার শুরুতে আশা দেখিয়ে এখন আমাদের হতাশ করছে। শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন, ফাউন্ডেশনের অফিসে সেবা পেতে বারবার ধরনা দিতে হচ্ছে। অনেকেই জরুরি চিকিৎসার আবেদন করেও সময়মতো সাড়া পাচ্ছেন না।

ফাইল জমা দেওয়া থেকে শুরু করে অনুদান পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বলে জানান আহতরা। আন্দোলনে আহত মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ সুপ্ত অভিযোগ করেন, ‘ফাউন্ডেশনের কাজ অনেক ধীরগতিতে চলছে। প্রয়োজনের তুলনায় স্টাফ সংখ্যা অনেক কম।

যারা ফাইলের আপডেট নিতে যায় তাদের কোনোরকম বুঝ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সহায়তার আবেদনের পর আমাদের যে টোকেন নাম্বার দিয়েছে সেখানেও সিরিয়াল অনুযায়ী কাজ করছে না তারা।’ ঢাকার কিশোরীগঞ্জের বাসিন্দা মো. রতন ভূঁইয়া, যার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক কেস আইডি নাম্বার ২৭৫০০। তিনি বলেন, ’১৮ ডিসেম্বর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন শাহবাগ অফিসে সহায়তার আবেদন জমা দিয়ে টোকেন নাম্বার নিয়ে চলে এসেছি। এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও কোনও যোগাযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, শহীদ পরিবার ও আহতরা আজ অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত, বাচ্চাদের স্কুল ড্রেস পর্যন্ত বানাতে পারছি না। সারজিস আলম বলেছিলেন, ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার ৩ দিনের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে, এখন দেখছি কথা ও কাজে মিল কম।’ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী। সম্প্রতি নাগরিক কমিটির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম সরকার আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে এবং প্রয়োজনে বিদেশে পাঠাবে। কিন্তু আমরা দেখছি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন ঠিকমত কাজ করছে না। তারা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে আমরা বারবার প্রশ্ন করেছি, তারা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে হতাশা প্রকাশ

ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেবাপ্রার্থীরা তাদের হতাশা এবং কষ্ট শেয়ার করার পর ফাউন্ডেশন কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাগুলো নির্ধারিত প্রক্রিয়ার বাইরে হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে ফাউন্ডেশনের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা নিয়েও। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ফাউন্ডেশনের অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সেবাগ্রহীতাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব না দেওয়া, প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া এবং দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করে সচেতন নাগরিক সমাজ।
ফাউন্ডেশনের বক্তব্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অভিযোগের পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তাদের ফেসবুক পেজে একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, ‘আমরা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহত ও শহীদদের পরিবারকে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের প্রচেষ্টা সর্বদা সৎ ও স্বচ্ছ, তবে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কখনও কখনও কাজ সামান্য দেরি হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা জনমনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করছে। আমাদের উদ্দেশ্য কখনোই কোনও শহীদ পরিবারকে হেয় করা নয়। বরং, আমরা চাই সঠিক তথ্যের মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়াতে ও যথাযথ সহায়তা প্রদান করতে। তারপরও যদি আমাদের কোনও কথায় বা কাজে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমরা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা আপনাদের বিশ্বাস ও সহযোগিতা কামনা করি, যাতে শহীদদের আত্মত্যাগের যথাযথ সম্মান রক্ষা করতে পারি। বিভ্রান্তি এড়িয়ে সত্যকে জানুন, গুজবে কান দেবেন না।’

এদিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনকে সফল করতে প্রশাসনিক দক্ষতা ও আন্তরিকতার পাশাপাশি সেবার গুণগত মান বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, শহীদ ও আহত পরিবারগুলো এমনিতেই আর্থিক ও মানসিক চাপে রয়েছেন। তাদের প্রতি ফাউন্ডেশনের উদাসীনতা শুধু তাদের দুর্দশা বাড়াবে না, গণআন্দোলনের ন্যায়বিচার এবং স্মৃতিরক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যকেও ক্ষুণ্ন করবে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমি মনে করি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের তালিকা করা এবং পরিবারসহ তাদের দায়িত্ব নেওয়া, দেখাশোনা করা সরকারের দায়িত্ব। বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া বা বিভিন্ন সংগঠনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া, এটা কাজের সমন্বয়ের জন্য অসুবিধা হয়। এখন শহীদ পরিবারগুলো ও আহত ব্যক্তিদের বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। এটা অপমানজনক। এটাকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব হিসেবে রাখা উচিত ছিল। তিনি বলেন, ছয় মাস পার হয়ে গেছে আহতদের অনেকে চিকিৎসা পাননি। শহীদের তালিকা ঠিকমতো হয়নি। এগুলো ঠিক হয়নি। এটা তো কঠিন কিছু না। এগুলোর জন্য যারা অভিজ্ঞ, যারা এ ধরনের ফাউন্ডেশন পরিচালনা করেন তাদের সবাইকে নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে একটা কার্যকর কমিটি করে দেওয়া উচিত ছিল। তাদের সহায়তার জন্য ছাত্র সমন্বয়ক ও অন্যরা থাকতে পারতো।
গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন
বিতর্কের মুখে বুধবার (২২ জানুয়ারি) জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে সরে দাঁড়ান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি তার ফেসবুক পেজে এই ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ফাউন্ডেশনের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের কথা জানান। সেখানে তিনি জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আমি নেই। এই ফাউন্ডেশনের গতি ত্বরান্বিত করার জন্য ফাউন্ডেশনের গঠনতন্ত্র, কাঠামো ও কাজের প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ফাউন্ডেশনে এখন থেকে ‘এক্সিকিউটিভ কমিটি’ পুরো অফিসের সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সেখানে অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন৷ মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বর্তমানে সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এবং ‘গভর্নিং বডি’ ফাউন্ডেশনের পলিসি মেকিংয়ে কাজ করবে। এই বডিতে প্রধান উপদেষ্টাসহ ৪ জন উপদেষ্টা রয়েছেন (স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, স্থানীয় সরকার ও আইসিটি)। ‘সাধারণ সম্পাদক’ নামে কোনও পদ থাকবে না ফাউন্ডেশনে। তিনি আরও বলেন, এই দায়িত্ব পালনকালে আমি ফাউন্ডেশন থেকে কোনও বেতন বা সম্মানি নেইনি। যতদিন পর্যন্ত আমি আমার সর্বোচ্চ সময় ফাউন্ডেশনে দিতে পেরেছি ততদিন আমি দায়িত্ব পালন করেছি। যখন মনে হয়েছে এখন থেকে ফাউন্ডেশনে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া আমার জন্য সম্ভব হবে নয়, তখন আমি দায়িত্ব থেকে সরে এসেছি। আমার কাছে নিজের সীমাবদ্ধতা অ্যাড্রেস করা এবং সে অনুযায়ী দায়িত্ব গ্রহণ বা ত্যাগ করা কোনও দুর্বলতা নয় বরং এটাতে সৎ সাহস লাগে। আমি চেষ্টা করেছি আমার চেয়ারের দায়িত্বের সঙ্গে সৎ থাকতে।