ঢাকা ০৫:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দিনে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমে শারীরিক-মানসিক ভয়াবহ ক্ষতি

  • আপডেট সময় : ০৩:৫৭:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে একজন মানুষ ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন যার কারণে একটি সুন্দর জীবনও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সার্জনস ফর সিøপ আপনিয়ার জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলছেন বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা যায় ৪৫-৫০ শতাংশ মানুষের ঘুম নিয়ে সমস্যা হয়। তা থেকে বিষণ্ন্নতাসহ নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ঘুম তম হওয়ার কারণ হলো চাকরি হারানো, আয় নিয়ে উদ্বেগ, ব্লু লাইট এফেক্ট (শিশুদের মোবাইল বা ডিভাইস ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া), পারিবারিক সহিংসতা এবং কাজের ক্ষেত্রে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া, রোগ আতঙ্ক তৈরি হওয়া, মদ্যপান ও ধূমপান বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা ইত্যাদি।

ঘুম নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। তাই দেশের কি পরিমাণ মানুষ অনিদ্রায় ভোগেন এবং এর কারণ কী ওই সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
মনিলাল আইচ লিটু বলছেন, বাংলাদেশে ঘুমের সমস্যার একটি বড় কারণ হলো যথাযথ ‘ঘুমের সংস্কৃতি’ না থাকা অর্থাৎ সময়মতো রাতের খাওয়ার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার বহুল প্রচলিত অভ্যাস না থাকা। এখানে বেশির ভাগ মানুষেরই রাতের খাবার খাওয়া ও ঘুমাতে যাওয়ার সময় মেনে চলার অভ্যাস নেই। এটিও ঘুমের সমস্যা তৈরি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এসব কারণেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত নিয়মিত ঘুমের ওপর।
ওয়ার্ল্ড অসোসিয়েশন অফ সিøপ মেডিসিনের ওয়ার্ল্ডের মূল উদ্দেশ্য হলো ঘুমের অভাবে হওয়া শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়টি মানুষকে অবহিত করা।

নিয়মিত ঘুম না হওয়া বলতে কী বোঝায়: ঢাকার গৃহিণী মাহবুবা মিঠু বলছেন, সংসারের কাজ ও বাচ্চা সামলাতে গিয়ে তিনি দিনে গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পান। তিনি বলেন, বাচ্চা ছোট কি করবো। চাইলেই ঘুমাতে পারিনা। আবার সারা দিনের কাজ শেষ যখন ঘুমাবো তখন বাচ্চার জন্য বারবার জাগতে হয়। ফলে ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
ডা. শারমীন ইয়াসমীন বলছেন আট ঘণ্টা না হোক, অন্তত ছয় ঘণ্টাও যদি কেউ নিয়মিত না ঘুমাতে পারে তাহলে সেটিই ঘুমের সমস্যা বা অনিয়মিত ঘুম। আর এ সমস্যা নিয়মিত হলে তা জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কাজের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। কারণ এটি মনোযোগ নষ্ট করে, রক্তচাপসহ নানা স্নায়ুজনিত সমস্যা তৈরি করে।

ঘুম না হলে যা হতে পারে: ঘুম কম হওয়ার কারণে শারীরিকভাবে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। পৃথিবীজুড়ে ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম ঘুমের কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং মোটা হয়ে যাবার সম্পর্ক আছে। প্রায় ৫০লাখ মানুষের উপর এসব গবেষণা চালানো হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটানা কয়েক রাত যদি ঘুম কম হয় তাহলে সেটি ডায়াবেটিসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের নিদ্রাহীনতা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে শরীরের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলছেন, তিন মাস কারও নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে অকাল মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশংকা দশ গুণ বেড়ে যায়। দেরিতে ঘুমানো বা কম ঘুমানোর কারণে প্যানিক (আতঙ্কিত হওয়া), ফোবিয়া (ভীতি) ও ফ্যানটম পেইন (অকারণ অস্বস্তি)তৈরি হয় যার ফলে বিষণ্ণতা এবং উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়। আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘুমের সংস্কৃতি না থাকায় ঘুম জনিত সমস্যার প্রকোপও বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, সঠিক মাত্রায় নিয়মিত ঘুম হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়।

আবার নিয়মিত ঘুমের ব্যাঘাত বা অনিদ্রা হলে তা একজন মানুষকে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ফেলে দিতে পারে।
ঘুম না হলে কাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে: আরেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শারমীন ইয়াসমিন বলছেন ঘুম ঠিক মতো না হলে শারীরিক সমস্যা যেমন হতে পারে তেমনি এটি একজন ব্যক্তির পেশাগত জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। ঘুম না হলে তা কাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কারণ ঘুমের অভাবে মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। স্বাভাবিক যেসব কাজ তা ঠিক মতো করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ডা. শারমীন বলেন, কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে।

মনোযোগ নষ্ট হবে। স্নায়ুজনিত সমস্যা তৈরি হবে। মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। তাই দিনে অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা হলেও সাউন্ড সিøপ জরুরি। তিনি বলেন, এ ঘুমের সমস্যা থেকে উদ্ভব হওয়া মানসিক সমস্যার কারণে পারিবারিক সুখ শান্তিও নষ্ট হতে পারে।

রাতে ঘুমানোর সঠিক সময়: ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। ঘুমই আসলে সুস্থ শরীরের চাবিকাঠি। তবে সঠিক সময়ে ঘুমানো এবং ঘুমাতে যাওয়ার সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। তা না হলেই বিপদ!
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজের চাপ বা সময়ের অভাবে বহু মানুষ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে বাধ্য হন। কেউ কেউ আবার জেগে থাকেন স্বেচ্ছায়। কিন্তু দেরি করে ঘুমাতে গেলে ঘুমের অভাব হয়; যা ডেকে আনতে পারে বড় বড় অসুখ।
চিকিৎসকরা বলছেন, ঘুমের পরিমাণ কমলে একগুচ্ছ অসুস্থতা আসে। যেমনÑ স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে অমনযোগী হওয়া, বিলম্বিত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়া, মানসিক অসুস্থতা যেমন মাদক সেবন, হতাশা, উদ্বেগে থাকা, এমনকী গর্ভাবস্থাতেও একাধিক সমস্যার আশঙ্কা তৈরি হয়।

চিকিৎসকরা ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ৮ ঘণ্টা নিজের সুবিধা মতো করে ঘুমিয়ে নিলেই হবে না। কারণ ঘণ্টা হিসাবে ঘুম হলেও ঘুমের কোনো উপকারিতাই পাবেন না।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুম শারীরিক ও মানসিক চাপ দূর করে। কার্ডিওভাসকুলার জটিলতাসহ বিভিন্ন কঠিন রোগের ঝুঁকি কমায়।
ঘুম নিয়ে একটি বিশেষ গবেষণা হয়েছে যুক্তরাজ্যে।
ওই গবেষণায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাত ১০টায় ঘুমাতে যাওয়া আদর্শ সময়; এমনকি রাত ১১টায় ঘুমানো হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী।

ইউরোপীয় হার্ট জার্নালে প্রকাশ হয়েছে ওই গবেষণার প্রতিবেদন। গবেষণায় ৪৩ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৮৮ হাজার মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অ্যাক্সিলোমিটার ব্যবহার করে সেসব মানুষের ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে দেখা গেছে, যারা রাত ১০টার আগে ঘুমাতে যান কাদের কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কম।

তবে রাত ১১টায় ঘুমাতে যাওয়াও উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, মাঝ রাতের পর ঘুমাতে যাওয়া সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এতে একাধিক শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। আর দেরি করে ঘুমালে কেউ সকালে উঠতে পারেন না। এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

তাই চেষ্টা করুন প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমাতে যেতে।
এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিওরোসায়েন্সের লেকচারার এবং এই সমীক্ষার লেখক ড. ডেভিড প্ল্যানস বলেন, আমাদের সমীক্ষার প্রধান বিষয় একজন মানুষের ২৪ ঘণ্টার সাইকেলের মধ্যে ঘুমানোর সময় এবং নির্দিষ্ট সময়। সব চেয়ে ঝুঁকির সময় হলো মাঝ রাতের পর ঘুমানো। কারণ এতে সকালে উঠতে দেরি হয় এবং দিনের আলো শরীরে পৌঁছায় না। ফলে দেহঘড়ি ঠিক হতে সমস্যা হয়। তবে রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমানো সঠিক সময় হলেও এই নিয়ম সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।

আর আদৌ সবার এই সময়ই ঘুমানো উচিত কি না তা পরিষ্কার করে জানার জন্য আরও তথ্য ও সমীক্ষা প্রয়োজন।
অবশ্য সব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে নিয়মিত মাত্রায় সঠিকভাবে ঘুমানোর অভ্যাসের ওপর জোর দিয়েছেন ডা. মনিলাল আইচ লিটু।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দিনে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমে শারীরিক-মানসিক ভয়াবহ ক্ষতি

আপডেট সময় : ০৩:৫৭:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে একজন মানুষ ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন যার কারণে একটি সুন্দর জীবনও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সার্জনস ফর সিøপ আপনিয়ার জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলছেন বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা যায় ৪৫-৫০ শতাংশ মানুষের ঘুম নিয়ে সমস্যা হয়। তা থেকে বিষণ্ন্নতাসহ নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ঘুম তম হওয়ার কারণ হলো চাকরি হারানো, আয় নিয়ে উদ্বেগ, ব্লু লাইট এফেক্ট (শিশুদের মোবাইল বা ডিভাইস ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া), পারিবারিক সহিংসতা এবং কাজের ক্ষেত্রে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া, রোগ আতঙ্ক তৈরি হওয়া, মদ্যপান ও ধূমপান বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা ইত্যাদি।

ঘুম নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। তাই দেশের কি পরিমাণ মানুষ অনিদ্রায় ভোগেন এবং এর কারণ কী ওই সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
মনিলাল আইচ লিটু বলছেন, বাংলাদেশে ঘুমের সমস্যার একটি বড় কারণ হলো যথাযথ ‘ঘুমের সংস্কৃতি’ না থাকা অর্থাৎ সময়মতো রাতের খাওয়ার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার বহুল প্রচলিত অভ্যাস না থাকা। এখানে বেশির ভাগ মানুষেরই রাতের খাবার খাওয়া ও ঘুমাতে যাওয়ার সময় মেনে চলার অভ্যাস নেই। এটিও ঘুমের সমস্যা তৈরি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এসব কারণেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত নিয়মিত ঘুমের ওপর।
ওয়ার্ল্ড অসোসিয়েশন অফ সিøপ মেডিসিনের ওয়ার্ল্ডের মূল উদ্দেশ্য হলো ঘুমের অভাবে হওয়া শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়টি মানুষকে অবহিত করা।

নিয়মিত ঘুম না হওয়া বলতে কী বোঝায়: ঢাকার গৃহিণী মাহবুবা মিঠু বলছেন, সংসারের কাজ ও বাচ্চা সামলাতে গিয়ে তিনি দিনে গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পান। তিনি বলেন, বাচ্চা ছোট কি করবো। চাইলেই ঘুমাতে পারিনা। আবার সারা দিনের কাজ শেষ যখন ঘুমাবো তখন বাচ্চার জন্য বারবার জাগতে হয়। ফলে ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
ডা. শারমীন ইয়াসমীন বলছেন আট ঘণ্টা না হোক, অন্তত ছয় ঘণ্টাও যদি কেউ নিয়মিত না ঘুমাতে পারে তাহলে সেটিই ঘুমের সমস্যা বা অনিয়মিত ঘুম। আর এ সমস্যা নিয়মিত হলে তা জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কাজের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। কারণ এটি মনোযোগ নষ্ট করে, রক্তচাপসহ নানা স্নায়ুজনিত সমস্যা তৈরি করে।

ঘুম না হলে যা হতে পারে: ঘুম কম হওয়ার কারণে শারীরিকভাবে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। পৃথিবীজুড়ে ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম ঘুমের কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং মোটা হয়ে যাবার সম্পর্ক আছে। প্রায় ৫০লাখ মানুষের উপর এসব গবেষণা চালানো হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটানা কয়েক রাত যদি ঘুম কম হয় তাহলে সেটি ডায়াবেটিসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের নিদ্রাহীনতা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে শরীরের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলছেন, তিন মাস কারও নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে অকাল মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশংকা দশ গুণ বেড়ে যায়। দেরিতে ঘুমানো বা কম ঘুমানোর কারণে প্যানিক (আতঙ্কিত হওয়া), ফোবিয়া (ভীতি) ও ফ্যানটম পেইন (অকারণ অস্বস্তি)তৈরি হয় যার ফলে বিষণ্ণতা এবং উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়। আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘুমের সংস্কৃতি না থাকায় ঘুম জনিত সমস্যার প্রকোপও বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, সঠিক মাত্রায় নিয়মিত ঘুম হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়।

আবার নিয়মিত ঘুমের ব্যাঘাত বা অনিদ্রা হলে তা একজন মানুষকে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ফেলে দিতে পারে।
ঘুম না হলে কাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে: আরেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শারমীন ইয়াসমিন বলছেন ঘুম ঠিক মতো না হলে শারীরিক সমস্যা যেমন হতে পারে তেমনি এটি একজন ব্যক্তির পেশাগত জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। ঘুম না হলে তা কাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কারণ ঘুমের অভাবে মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। স্বাভাবিক যেসব কাজ তা ঠিক মতো করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ডা. শারমীন বলেন, কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে।

মনোযোগ নষ্ট হবে। স্নায়ুজনিত সমস্যা তৈরি হবে। মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। তাই দিনে অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা হলেও সাউন্ড সিøপ জরুরি। তিনি বলেন, এ ঘুমের সমস্যা থেকে উদ্ভব হওয়া মানসিক সমস্যার কারণে পারিবারিক সুখ শান্তিও নষ্ট হতে পারে।

রাতে ঘুমানোর সঠিক সময়: ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। মানুষ তার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। ঘুমই আসলে সুস্থ শরীরের চাবিকাঠি। তবে সঠিক সময়ে ঘুমানো এবং ঘুমাতে যাওয়ার সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। তা না হলেই বিপদ!
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজের চাপ বা সময়ের অভাবে বহু মানুষ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে বাধ্য হন। কেউ কেউ আবার জেগে থাকেন স্বেচ্ছায়। কিন্তু দেরি করে ঘুমাতে গেলে ঘুমের অভাব হয়; যা ডেকে আনতে পারে বড় বড় অসুখ।
চিকিৎসকরা বলছেন, ঘুমের পরিমাণ কমলে একগুচ্ছ অসুস্থতা আসে। যেমনÑ স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে অমনযোগী হওয়া, বিলম্বিত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়া, মানসিক অসুস্থতা যেমন মাদক সেবন, হতাশা, উদ্বেগে থাকা, এমনকী গর্ভাবস্থাতেও একাধিক সমস্যার আশঙ্কা তৈরি হয়।

চিকিৎসকরা ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ৮ ঘণ্টা নিজের সুবিধা মতো করে ঘুমিয়ে নিলেই হবে না। কারণ ঘণ্টা হিসাবে ঘুম হলেও ঘুমের কোনো উপকারিতাই পাবেন না।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুম শারীরিক ও মানসিক চাপ দূর করে। কার্ডিওভাসকুলার জটিলতাসহ বিভিন্ন কঠিন রোগের ঝুঁকি কমায়।
ঘুম নিয়ে একটি বিশেষ গবেষণা হয়েছে যুক্তরাজ্যে।
ওই গবেষণায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাত ১০টায় ঘুমাতে যাওয়া আদর্শ সময়; এমনকি রাত ১১টায় ঘুমানো হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী।

ইউরোপীয় হার্ট জার্নালে প্রকাশ হয়েছে ওই গবেষণার প্রতিবেদন। গবেষণায় ৪৩ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৮৮ হাজার মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অ্যাক্সিলোমিটার ব্যবহার করে সেসব মানুষের ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে দেখা গেছে, যারা রাত ১০টার আগে ঘুমাতে যান কাদের কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কম।

তবে রাত ১১টায় ঘুমাতে যাওয়াও উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, মাঝ রাতের পর ঘুমাতে যাওয়া সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এতে একাধিক শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। আর দেরি করে ঘুমালে কেউ সকালে উঠতে পারেন না। এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

তাই চেষ্টা করুন প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমাতে যেতে।
এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিওরোসায়েন্সের লেকচারার এবং এই সমীক্ষার লেখক ড. ডেভিড প্ল্যানস বলেন, আমাদের সমীক্ষার প্রধান বিষয় একজন মানুষের ২৪ ঘণ্টার সাইকেলের মধ্যে ঘুমানোর সময় এবং নির্দিষ্ট সময়। সব চেয়ে ঝুঁকির সময় হলো মাঝ রাতের পর ঘুমানো। কারণ এতে সকালে উঠতে দেরি হয় এবং দিনের আলো শরীরে পৌঁছায় না। ফলে দেহঘড়ি ঠিক হতে সমস্যা হয়। তবে রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমানো সঠিক সময় হলেও এই নিয়ম সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।

আর আদৌ সবার এই সময়ই ঘুমানো উচিত কি না তা পরিষ্কার করে জানার জন্য আরও তথ্য ও সমীক্ষা প্রয়োজন।
অবশ্য সব সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে নিয়মিত মাত্রায় সঠিকভাবে ঘুমানোর অভ্যাসের ওপর জোর দিয়েছেন ডা. মনিলাল আইচ লিটু।