ঢাকা ১২:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেদে শিশুদের সামাজিক উন্নয়নে বাধা উদ্যোগের অভাব

  • আপডেট সময় : ০৫:৫৪:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫
  • ১০ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু ডেস্ক: বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেদে সম্প্রদায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে সাপ ধরা ও খেলা দেখানো, জাদু প্রদর্শন, ভেষজ ওষুধ বিক্রি এবং শিঙা লাগানো, দাঁতের ব্যথা নিরাময়, বাতব্যথার উপশম তথা প্রথাগত চিকিৎসা প্রদানের মতো কাজের ওপর নির্ভরশীল। ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনধারা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে তারা মূলধারার সমাজ থেকে আলাদা। তবে এ যাযাবর জীবনধারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তাদের শিশুদের শিক্ষার ওপর। বেদে শিশুদের শিক্ষার অপ্রতুলতা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে একটি বড় বাধা।
বেদে শিশুদের শিক্ষার বর্তমান চিত্র: বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম। অধিকাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারে না। ভ্রাম্যমাণ জীবনের কারণে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভবও হয় না। এমনকি যদি তারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ও, অভিভাবকদের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য এবং সাংস্কৃতিক বাধার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বেদে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ অভিভাবক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিও করে না। তারা ভাবেন, শিক্ষার মাধ্যমে ঐতিহ্যগত পেশার সঙ্গে সন্তানের সংযোগ বজায় রাখা সম্ভব নয়। ফলে বেদে শিশুরা অল্প বয়সেই পরিবারের সঙ্গে জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হয় এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বেদে জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার শতকরা ১০ শতাংশের কম, যেখানে দেশের জাতীয় সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে স্কুল ত্যাগ করে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেদে শিশুদের উপস্থিতি ১ শতাংশের কম।
বেদে শিশুদের শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা

ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন: বেদে সম্প্রদায় সারা বছর নৌকায় বা অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করে। তাদের এক জায়গায় স্থায়ী না থাকার কারণে শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না।
দারিদ্র্য: বেদে জনগোষ্ঠী চরম দরিদ্র। গ্রামবাংলা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেদে জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯৮ শতাংশ পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এ কারণে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে জীবিকা অর্জনে যুক্ত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তারা। ফলে শিশুরা উপার্জনের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়।
অজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক বাধা: বেদে সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা কম। অধিকাংশ বেদে অভিভাবক মনে করেন, তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী নন।
বৈষম্য: অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে বেদে শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। সামাজিক পরিচিতির কারণে অন্য শিশুরা তাদের থেকে দূরে থাকে; যা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা আশঙ্কাজনক হারে কমিয়ে দেয়।
পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব: বেদে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা প্রকল্পের অভাব রয়েছে। তাদের জন্য কোনো আলাদা শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বেদে জনগোষ্ঠীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়ানো অশিক্ষার ধারা এবং শিক্ষাবিমুখ মনোভাব এ জনগোষ্ঠীকে শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেনি, বরং তাদের আর্থসামাজিক জীবনেও সৃষ্টি করেছে চরম বৈষম্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব তাদের দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, সামাজিক বঞ্চনা এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণে সংকট সৃষ্টি করেছে। এ প্রেক্ষাপটে বেদে জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অভাবে সৃষ্ট প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যাতে তাদের উন্নয়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
দারিদ্র্যের চক্র ও শিশুশ্রম: শিক্ষা না থাকায় তারা পরিবারের ঐতিহ্যবাহী পেশায় জড়িয়ে থাকে, যা তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে না। শিশুরা পড়াশোনার পরিবর্তে আয়ের জন্য সাপ খেলা, ওষুধ বিক্রি বা ভিক্ষাবৃত্তির মতো বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য হয়। কম বয়সে কাজে যুক্ত হওয়ায় তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
মাদকের ঝুঁকি: বেদে সম্প্রদায়ের অনেক এলাকায় মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় শিশুরা এর ভয়াবহ প্রভাবের শিকার হচ্ছে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অবহেলা তাদের মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
বাল্যবিয়ে ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি: বেদে শিশুদের বিশেষত কিশোরীদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে একটি সাধারণ বিষয়। ১৪-১৫ বছর বয়সের মেয়েদের বেশিরভাগই বিবাহিত; যা তাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। মাত্র ২০-২১ বছর বয়সি এক বেদে কন্যার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে তিনি চার সন্তানের জননী! শেষবার সন্তান জন্মদানের সময় থেকে এমন অপুষ্টিতে ভুগছেন যে নিজের টিকে থাকা নিয়েই শঙ্কিত তিনি।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অধিকারবঞ্চনা: শিক্ষার পাশাপাশি বেদে শিশুরা স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অধিকার থেকেও বঞ্চিত। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পর্যন্ত নিতে পারে না। এ সম্প্রদায়ের নারীরা সন্তান জন্মের জন্যও সাধারণত সদর হাসপাতালে যান না। অভিযোগ করেন নার্স বা চিকিৎসকদের অবহেলা নিয়ে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: সমাজ তাদের ‘অশিক্ষিত’ ও ‘অপরিচ্ছন্ন’ হিসেবে দেখে; যা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত করে এবং বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগ্রহ কমায়। মূলত শিক্ষার অভাবেই বেদে জনগোষ্ঠী মূলধারার সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারছে না।
ভবিষ্যৎ করণীয়: সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেদে শিশুদের শিক্ষার উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অনুপাত হিসেবে যা নিতান্তই অপ্রতুল। তবে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো এখনও রয়ে গেছে। সফলতার আলো দেখতে হলে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই বেদে শিশুদের শিক্ষার উন্নয়নে কার্যকর এবং টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনÑ
ভ্রাম্যমাণ শিক্ষা ব্যবস্থা: বেদে জনগোষ্ঠীর যাযাবর জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নৌকাভিত্তিক বা অস্থায়ী বিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের কিছু প্রদেশে ‘বোট স্কুল ইনিশিয়েটিভ’ উদ্যোগ সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে। প্রয়োজনে ই-লার্নিং ও অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের মাধ্যমে বেদে শিশুদের শিক্ষায় সংযুক্ত করতে হবে।
বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা: বেদে শিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বৃত্তি চালু করতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা: বেদে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে (প্রয়োজনে স্বতন্ত্র) পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। পেশাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য তাদের পাঠ্যক্রমে কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
সচেতনতা বৃদ্ধি: বেদে অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কর্মসূচি চালু করতে হবে।
স্থানীয় সংস্থাগুলোর ভূমিকা: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয় চালু করা, পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারে।
কারিগরি শিক্ষা: বেদে জনগোষ্ঠীর বসবাসস্থলের কাছাকাছি কারিগরি শিক্ষার জন্য কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে বেদে শিশুদের জন্য পেশাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। তা ছাড়া তাদের সংস্কৃতি ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপযুক্ত কারিগরি কোর্স যেমন সেলাই, হস্তশিল্প, ইলেকট্রনিকস, মোবাইল রিচার্জ, সৌন্দর্যচর্চা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনায় সহযোগিতা করা যেতে পারে।
সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: বেদে শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।
শিক্ষার মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনা

বেদে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা গেলে তাদের জীবনমানের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। শিক্ষার সুযোগ বাড়ালে তাদের জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে। শিক্ষা তাদের নতুন দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করবে; যা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশার বাইরে নতুন পেশায় প্রবেশের সুযোগ দেবে। এর মাধ্যমে তারা মূলধারার সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে। বেদে মেয়েরা শিক্ষার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যাবে। কমে যাবে বাল্যবিয়ের হার।
সর্বোপরি বেদে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা শুধু তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নয়, এটি একটি জাতির নৈতিক দায়িত্বও বটে। তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হলে তারা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে এবং জাতির সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, বেসরকারি সংস্থার প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সচেতনতা একত্রে কাজ করলে বেদে শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা সম্ভব। শিক্ষার আলোই পারে বেদে শিশুদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে। এছাড়া একটি জাতি তখনই উন্নত হতে পারেÑ যখন তার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের মূল স্রোতে যুক্ত হবে। বেদে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বেদে শিশুদের সামাজিক উন্নয়নে বাধা উদ্যোগের অভাব

আপডেট সময় : ০৫:৫৪:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫

নারী ও শিশু ডেস্ক: বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেদে সম্প্রদায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে সাপ ধরা ও খেলা দেখানো, জাদু প্রদর্শন, ভেষজ ওষুধ বিক্রি এবং শিঙা লাগানো, দাঁতের ব্যথা নিরাময়, বাতব্যথার উপশম তথা প্রথাগত চিকিৎসা প্রদানের মতো কাজের ওপর নির্ভরশীল। ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনধারা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে তারা মূলধারার সমাজ থেকে আলাদা। তবে এ যাযাবর জীবনধারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তাদের শিশুদের শিক্ষার ওপর। বেদে শিশুদের শিক্ষার অপ্রতুলতা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে একটি বড় বাধা।
বেদে শিশুদের শিক্ষার বর্তমান চিত্র: বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম। অধিকাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারে না। ভ্রাম্যমাণ জীবনের কারণে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভবও হয় না। এমনকি যদি তারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ও, অভিভাবকদের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য এবং সাংস্কৃতিক বাধার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বেদে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ অভিভাবক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিও করে না। তারা ভাবেন, শিক্ষার মাধ্যমে ঐতিহ্যগত পেশার সঙ্গে সন্তানের সংযোগ বজায় রাখা সম্ভব নয়। ফলে বেদে শিশুরা অল্প বয়সেই পরিবারের সঙ্গে জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হয় এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বেদে জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার শতকরা ১০ শতাংশের কম, যেখানে দেশের জাতীয় সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে স্কুল ত্যাগ করে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেদে শিশুদের উপস্থিতি ১ শতাংশের কম।
বেদে শিশুদের শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা

ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন: বেদে সম্প্রদায় সারা বছর নৌকায় বা অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করে। তাদের এক জায়গায় স্থায়ী না থাকার কারণে শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না।
দারিদ্র্য: বেদে জনগোষ্ঠী চরম দরিদ্র। গ্রামবাংলা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেদে জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯৮ শতাংশ পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এ কারণে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে জীবিকা অর্জনে যুক্ত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তারা। ফলে শিশুরা উপার্জনের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়।
অজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক বাধা: বেদে সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা কম। অধিকাংশ বেদে অভিভাবক মনে করেন, তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী নন।
বৈষম্য: অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে বেদে শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। সামাজিক পরিচিতির কারণে অন্য শিশুরা তাদের থেকে দূরে থাকে; যা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা আশঙ্কাজনক হারে কমিয়ে দেয়।
পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব: বেদে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা প্রকল্পের অভাব রয়েছে। তাদের জন্য কোনো আলাদা শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বেদে জনগোষ্ঠীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়ানো অশিক্ষার ধারা এবং শিক্ষাবিমুখ মনোভাব এ জনগোষ্ঠীকে শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেনি, বরং তাদের আর্থসামাজিক জীবনেও সৃষ্টি করেছে চরম বৈষম্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব তাদের দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সমস্যা, সামাজিক বঞ্চনা এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণে সংকট সৃষ্টি করেছে। এ প্রেক্ষাপটে বেদে জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অভাবে সৃষ্ট প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যাতে তাদের উন্নয়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
দারিদ্র্যের চক্র ও শিশুশ্রম: শিক্ষা না থাকায় তারা পরিবারের ঐতিহ্যবাহী পেশায় জড়িয়ে থাকে, যা তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে না। শিশুরা পড়াশোনার পরিবর্তে আয়ের জন্য সাপ খেলা, ওষুধ বিক্রি বা ভিক্ষাবৃত্তির মতো বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য হয়। কম বয়সে কাজে যুক্ত হওয়ায় তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
মাদকের ঝুঁকি: বেদে সম্প্রদায়ের অনেক এলাকায় মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় শিশুরা এর ভয়াবহ প্রভাবের শিকার হচ্ছে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অবহেলা তাদের মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
বাল্যবিয়ে ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি: বেদে শিশুদের বিশেষত কিশোরীদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে একটি সাধারণ বিষয়। ১৪-১৫ বছর বয়সের মেয়েদের বেশিরভাগই বিবাহিত; যা তাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। মাত্র ২০-২১ বছর বয়সি এক বেদে কন্যার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে তিনি চার সন্তানের জননী! শেষবার সন্তান জন্মদানের সময় থেকে এমন অপুষ্টিতে ভুগছেন যে নিজের টিকে থাকা নিয়েই শঙ্কিত তিনি।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অধিকারবঞ্চনা: শিক্ষার পাশাপাশি বেদে শিশুরা স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অধিকার থেকেও বঞ্চিত। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পর্যন্ত নিতে পারে না। এ সম্প্রদায়ের নারীরা সন্তান জন্মের জন্যও সাধারণত সদর হাসপাতালে যান না। অভিযোগ করেন নার্স বা চিকিৎসকদের অবহেলা নিয়ে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: সমাজ তাদের ‘অশিক্ষিত’ ও ‘অপরিচ্ছন্ন’ হিসেবে দেখে; যা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত করে এবং বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগ্রহ কমায়। মূলত শিক্ষার অভাবেই বেদে জনগোষ্ঠী মূলধারার সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারছে না।
ভবিষ্যৎ করণীয়: সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেদে শিশুদের শিক্ষার উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অনুপাত হিসেবে যা নিতান্তই অপ্রতুল। তবে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো এখনও রয়ে গেছে। সফলতার আলো দেখতে হলে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই বেদে শিশুদের শিক্ষার উন্নয়নে কার্যকর এবং টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনÑ
ভ্রাম্যমাণ শিক্ষা ব্যবস্থা: বেদে জনগোষ্ঠীর যাযাবর জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নৌকাভিত্তিক বা অস্থায়ী বিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের কিছু প্রদেশে ‘বোট স্কুল ইনিশিয়েটিভ’ উদ্যোগ সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে। প্রয়োজনে ই-লার্নিং ও অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের মাধ্যমে বেদে শিশুদের শিক্ষায় সংযুক্ত করতে হবে।
বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা: বেদে শিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বৃত্তি চালু করতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা: বেদে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে (প্রয়োজনে স্বতন্ত্র) পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। পেশাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য তাদের পাঠ্যক্রমে কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
সচেতনতা বৃদ্ধি: বেদে অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কর্মসূচি চালু করতে হবে।
স্থানীয় সংস্থাগুলোর ভূমিকা: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয় চালু করা, পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারে।
কারিগরি শিক্ষা: বেদে জনগোষ্ঠীর বসবাসস্থলের কাছাকাছি কারিগরি শিক্ষার জন্য কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে বেদে শিশুদের জন্য পেশাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। তা ছাড়া তাদের সংস্কৃতি ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপযুক্ত কারিগরি কোর্স যেমন সেলাই, হস্তশিল্প, ইলেকট্রনিকস, মোবাইল রিচার্জ, সৌন্দর্যচর্চা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনায় সহযোগিতা করা যেতে পারে।
সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: বেদে শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।
শিক্ষার মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনা

বেদে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা গেলে তাদের জীবনমানের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। শিক্ষার সুযোগ বাড়ালে তাদের জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে। শিক্ষা তাদের নতুন দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করবে; যা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশার বাইরে নতুন পেশায় প্রবেশের সুযোগ দেবে। এর মাধ্যমে তারা মূলধারার সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে। বেদে মেয়েরা শিক্ষার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যাবে। কমে যাবে বাল্যবিয়ের হার।
সর্বোপরি বেদে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা শুধু তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নয়, এটি একটি জাতির নৈতিক দায়িত্বও বটে। তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হলে তারা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে এবং জাতির সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, বেসরকারি সংস্থার প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সচেতনতা একত্রে কাজ করলে বেদে শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা সম্ভব। শিক্ষার আলোই পারে বেদে শিশুদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে। এছাড়া একটি জাতি তখনই উন্নত হতে পারেÑ যখন তার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়নের মূল স্রোতে যুক্ত হবে। বেদে শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।