ঢাকা ০২:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

যে জীবন থেকে ফেরার পথ নেই

  • আপডেট সময় : ০৬:০০:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৫৩ বার পড়া হয়েছে

তালহা বিন জসিম : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আমার চাকরির বয়স খুব বেশি নয়। ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর যোগদান করি। এই মাত্র চার বছরের চাকরিতে শুধু অপারেশনাল কাজ করতে গিয়ে ১৮ জন ফায়ার কর্মীর মৃত্যুর সাক্ষী হতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৪৭ জন বীর ফায়ার কর্মী আত্মত্যাগ করেছেন। এরা জীবন দিয়েছে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে। এরা জীবন দিয়েছে শুধু পরের স্বার্থের জন্য। তারা কখনো ভাবেনি এই কাজ করতে গেলে তার মৃত্যু হতে পারে। তারা ভাবেনি তার মৃত্যুর পর পরিবারের কী হবে। তারা ভাবেনি মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মৃত্যু হলে তার সন্তানটা কীভাবে বড় হবে, স্ত্রী, বাবা ও মা কীভাবে চলবে, তাদের সংসারটা কীভাবে চলবে। এই নিঃস্বার্থ ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছে এই সমাজ কখনো ভেবেছে?
ফায়ার সার্ভিসের এই নীরবে কাজ করে যাওয়া মানুষগুলো শুধু মানুষের সেবা করার ব্রত আর কাজ শেষে মানুষের ভালোবাসার ভর করেই কাজ করে যাচ্ছে। এই বাহিনী কী সুযোগ, সুবিধা, প্রণোদনা পায় এর পর্যালোচনা আপনাদের জন্য রেখে দিলাম। আমরা বিশ্বাস করি, যদি আপনাদের সেবায় আমরা কাজে লেগে থাকি তাহলে এর পর্যালোচনা করে আমাদের এর সত্যিকারের প্রতিদান দেবেন।

স্বাধীনতার পর থেকে শুধু অপারেশনাল কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪৭ জন কর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বাধীনতার পূর্বেও এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অন্যের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে নিজেদের আত্মত্যাগ করেছেন। এই মৃত্যুগুলো সত্যিই করুণ ও দুঃখের। কেউ মারা গিয়েছেন অগ্নিনির্বাপণ যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণের সময় বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে, কেউ মারা গেছেন আগুন নেভানোর সময় দেয়ালচাপা পড়ে, কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণের সময় বিস্ফোরণে।

কেউ মারা গেছেন ডুবুরি কাজ করাকালীন পানির নিচে আটকে পড়ে। কেউ মারা গেছেন অগ্নিদুর্ঘটনাকালীন উচ্ছৃঙ্খল মানুষের পিটুনিতে। আপনার হয়ত জানেন, বিএম কন্টেইনারের অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন অগ্নিবীর মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনায় ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে প্রথম দুটি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণে অংশগ্রণ করে। এই দুটি ইউনিটের প্রত্যেকে মারা যান।

এমনকি তিনজনের লাশের এক টুকরোও আমরা খুঁজে পাইনি। চিন্তা করেন কী ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছিল। আমরা বোবা হয়ে যাই যখন এই তিন বীরের বাবা মা এসে বলে আমার সন্তানের এক টুকরো হাড় বা কিছু একটা দাও, যা মাটি দিয়ে আমরা বিশ্বাস করতে পারি আমার সন্তান এখানে আছে। কিন্তু আমাদের কিছু দেওয়ার নেই। এমনকি এই বাবা মায়ের সামনে আমরা কাঁদতেও পারি না, যদি আমাদের দুর্বল দেখে তারা আরও ভেঙে পড়েন। আমরা বলি এই ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি কর্মী আপনার সন্তান। কিন্তু এই আশ্বাস বাবা-মায়ের মন মানে না। আবার যখন কাঁদতে কাঁদতে বলে কিছু একটা দাও, আমরা তখনও সকল আবেগকে বুকে চাপা দিয়ে নীরব থাকা আর উপায় খুঁজে পাই না।

আমরা যখন কাজে যাই তখন মাথায় শুধু মানুষের সেবা করা ছাড়া কিছু থাকে না। আমাদের বাহিনীতে প্রচলিত আছেÑ তুমি ফায়ারে যোগদান করেছ, এখন আর তোমার পরিবার নেই, সমাজ নেই, বন্ধু নেই। কেননা কোনো উৎসবে সারাদেশে ছুটি থাকলেও ফায়ার কর্মীর ছুটি নেই। ঈদে সবাই বাড়ি যাবে, ফায়ার কর্মীর ছুটি ভাগাভাগি করে নিতে হয়, উৎসব করবে মানুষজন ফায়ার কর্মীর ছুটি নেই। ঝড়, বন্যা হলে ফায়ার কর্মীর ছুটি বাতিল। এভাবে স্ত্রী, সন্তান, বাবা মা বন্ধুরা ফায়ার কর্মীদের সবসময় কাছে পায় না। এতে অনেক সময় অসামাজিক হয়ে যায় ফায়ার কর্মীরা। তবু আগুনে গিয়ে ফিরে না আসার অনিশ্চয়তা নিয়েও হাসিমুখে সবসময় মানুষের সেবায় প্রস্তুত থাকে। আমাদের অনুপ্রেরণা মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করায়।

হ্যাঁ, আমরাও মানুষ। আমাদের দুঃখ লাগে, কষ্ট লাগে, খারাপ লাগে। যখন আগুনে কাজ করতে গিয়ে মৃত মানুষগুলো উদ্ধার করি তখন আমাদের খারাপ লাগে, যখন আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়ে মানুষের আহাজারি শুনি দেখি, তখন নীরব হয়ে যাই। যখন সড়ক দুর্ঘটনায় বীভৎস আহতদের উদ্ধার করি, অনেক সময় রাতে ঘুম আসে না। যখন মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে আগুনের সাইরেন পাই, হঠাৎ ঘুম ভেঙে বুকটা ধপ ধপ করে, মাথা চক্কর মারলেও দৌড়ে গাড়িতে উঠি। যখন পানির গভীর অন্ধকারে মৃত্যু ঠান্ডা শরীরের মানুষগুলোকে নিয়ে উপরে উঠে আসি, আমাদের বুকটাও কাঁপে। কিন্তু যে জীবন আমরা বেছে নিয়েছি সেখান থেকে ফেরার পথ নেই। যে এই মানুষের জীবন সম্পদ রক্ষার নেশায় আটকে গেছে তার আর ফিরে আসার উপায় নেই।
লেখক: স্টেশন অফিসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

যে জীবন থেকে ফেরার পথ নেই

আপডেট সময় : ০৬:০০:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫

তালহা বিন জসিম : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আমার চাকরির বয়স খুব বেশি নয়। ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর যোগদান করি। এই মাত্র চার বছরের চাকরিতে শুধু অপারেশনাল কাজ করতে গিয়ে ১৮ জন ফায়ার কর্মীর মৃত্যুর সাক্ষী হতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৪৭ জন বীর ফায়ার কর্মী আত্মত্যাগ করেছেন। এরা জীবন দিয়েছে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে। এরা জীবন দিয়েছে শুধু পরের স্বার্থের জন্য। তারা কখনো ভাবেনি এই কাজ করতে গেলে তার মৃত্যু হতে পারে। তারা ভাবেনি তার মৃত্যুর পর পরিবারের কী হবে। তারা ভাবেনি মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মৃত্যু হলে তার সন্তানটা কীভাবে বড় হবে, স্ত্রী, বাবা ও মা কীভাবে চলবে, তাদের সংসারটা কীভাবে চলবে। এই নিঃস্বার্থ ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছে এই সমাজ কখনো ভেবেছে?
ফায়ার সার্ভিসের এই নীরবে কাজ করে যাওয়া মানুষগুলো শুধু মানুষের সেবা করার ব্রত আর কাজ শেষে মানুষের ভালোবাসার ভর করেই কাজ করে যাচ্ছে। এই বাহিনী কী সুযোগ, সুবিধা, প্রণোদনা পায় এর পর্যালোচনা আপনাদের জন্য রেখে দিলাম। আমরা বিশ্বাস করি, যদি আপনাদের সেবায় আমরা কাজে লেগে থাকি তাহলে এর পর্যালোচনা করে আমাদের এর সত্যিকারের প্রতিদান দেবেন।

স্বাধীনতার পর থেকে শুধু অপারেশনাল কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪৭ জন কর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বাধীনতার পূর্বেও এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অন্যের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে নিজেদের আত্মত্যাগ করেছেন। এই মৃত্যুগুলো সত্যিই করুণ ও দুঃখের। কেউ মারা গিয়েছেন অগ্নিনির্বাপণ যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণের সময় বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে, কেউ মারা গেছেন আগুন নেভানোর সময় দেয়ালচাপা পড়ে, কেউ মারা গেছেন অগ্নিনির্বাপণের সময় বিস্ফোরণে।

কেউ মারা গেছেন ডুবুরি কাজ করাকালীন পানির নিচে আটকে পড়ে। কেউ মারা গেছেন অগ্নিদুর্ঘটনাকালীন উচ্ছৃঙ্খল মানুষের পিটুনিতে। আপনার হয়ত জানেন, বিএম কন্টেইনারের অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন অগ্নিবীর মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনায় ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে প্রথম দুটি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণে অংশগ্রণ করে। এই দুটি ইউনিটের প্রত্যেকে মারা যান।

এমনকি তিনজনের লাশের এক টুকরোও আমরা খুঁজে পাইনি। চিন্তা করেন কী ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছিল। আমরা বোবা হয়ে যাই যখন এই তিন বীরের বাবা মা এসে বলে আমার সন্তানের এক টুকরো হাড় বা কিছু একটা দাও, যা মাটি দিয়ে আমরা বিশ্বাস করতে পারি আমার সন্তান এখানে আছে। কিন্তু আমাদের কিছু দেওয়ার নেই। এমনকি এই বাবা মায়ের সামনে আমরা কাঁদতেও পারি না, যদি আমাদের দুর্বল দেখে তারা আরও ভেঙে পড়েন। আমরা বলি এই ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি কর্মী আপনার সন্তান। কিন্তু এই আশ্বাস বাবা-মায়ের মন মানে না। আবার যখন কাঁদতে কাঁদতে বলে কিছু একটা দাও, আমরা তখনও সকল আবেগকে বুকে চাপা দিয়ে নীরব থাকা আর উপায় খুঁজে পাই না।

আমরা যখন কাজে যাই তখন মাথায় শুধু মানুষের সেবা করা ছাড়া কিছু থাকে না। আমাদের বাহিনীতে প্রচলিত আছেÑ তুমি ফায়ারে যোগদান করেছ, এখন আর তোমার পরিবার নেই, সমাজ নেই, বন্ধু নেই। কেননা কোনো উৎসবে সারাদেশে ছুটি থাকলেও ফায়ার কর্মীর ছুটি নেই। ঈদে সবাই বাড়ি যাবে, ফায়ার কর্মীর ছুটি ভাগাভাগি করে নিতে হয়, উৎসব করবে মানুষজন ফায়ার কর্মীর ছুটি নেই। ঝড়, বন্যা হলে ফায়ার কর্মীর ছুটি বাতিল। এভাবে স্ত্রী, সন্তান, বাবা মা বন্ধুরা ফায়ার কর্মীদের সবসময় কাছে পায় না। এতে অনেক সময় অসামাজিক হয়ে যায় ফায়ার কর্মীরা। তবু আগুনে গিয়ে ফিরে না আসার অনিশ্চয়তা নিয়েও হাসিমুখে সবসময় মানুষের সেবায় প্রস্তুত থাকে। আমাদের অনুপ্রেরণা মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করায়।

হ্যাঁ, আমরাও মানুষ। আমাদের দুঃখ লাগে, কষ্ট লাগে, খারাপ লাগে। যখন আগুনে কাজ করতে গিয়ে মৃত মানুষগুলো উদ্ধার করি তখন আমাদের খারাপ লাগে, যখন আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়ে মানুষের আহাজারি শুনি দেখি, তখন নীরব হয়ে যাই। যখন সড়ক দুর্ঘটনায় বীভৎস আহতদের উদ্ধার করি, অনেক সময় রাতে ঘুম আসে না। যখন মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে আগুনের সাইরেন পাই, হঠাৎ ঘুম ভেঙে বুকটা ধপ ধপ করে, মাথা চক্কর মারলেও দৌড়ে গাড়িতে উঠি। যখন পানির গভীর অন্ধকারে মৃত্যু ঠান্ডা শরীরের মানুষগুলোকে নিয়ে উপরে উঠে আসি, আমাদের বুকটাও কাঁপে। কিন্তু যে জীবন আমরা বেছে নিয়েছি সেখান থেকে ফেরার পথ নেই। যে এই মানুষের জীবন সম্পদ রক্ষার নেশায় আটকে গেছে তার আর ফিরে আসার উপায় নেই।
লেখক: স্টেশন অফিসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স