সাভার সংবাদদাতা: সরকারি নথিতে ঢাকার ধামরাইয়ের সাত ইটভাটা বন্ধদেখালেও বাস্তবে চলছে উৎপাদন-বিক্রি। প্রকাশ্যে এসব ভাটায় কার্যক্রম চালাচ্ছেন মালিকরা। ইটভাটাগুলো হলো, ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের মাহী ব্রিকস ও স্বর্ণ ব্রিকস (এমএলই-১ ব্রিকস) এবং সুয়াপুর ইউনিয়নের দেলধা এলাকার সততা ব্রিকস-৪ ও সততা ব্রিকস-৫ এবং পাশের হিরু এন্টারপ্রাইজ, সোহাগ ব্রিকস ও একে ব্রিকস।
জানা গেছে, ২৪ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর ও ঢাকা জেলা প্রশাসন অভিযান চলিয়ে ওই সাত ইটভাটা বন্ধ করে দেন। অভিযানের পর পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবৈধভাবে ভাটা পরিচালনা করে বায়ু দূষণ করায় দেলধা এলাকার সততা ব্রিকস-৪ ও সততা ব্রিকস-৫ ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একই কারণে দেলধা এলাকার হিরু এন্টারপ্রাইজ, সোহাগ ব্রিকস ও একে ব্রিকসসহ পাশের এলাকার মেসার্স মাহী এন্টারপ্রাইজ ও স্বর্ণ ব্রিকসের (এমএলই-১ ব্রিকস) কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে অভিযানের কয়েক দিন পর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধু মাহী ব্রিকসের সামনে ভাটাটির লাইসেন্স ও ছাড়পত্র বাতিলের নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ওই নোটিশে ইট বিক্রি ও উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সততা ব্রিকস-৪ ও সততা ব্রিকস-৫ ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও গত রোববার দেলধা গিয়ে ভাটা দুইটিতে ইট পোড়াতে দেখা যায়। অথচ ভাটা দুটির ইট পোড়ানোর কোনো অনুমতি নেই বলে জানা যায়।
সততা ব্রিকস-৪ ও সততা ব্রিকস-৫-এ কর্মরত শ্রমিকেরা জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে দুটি ভাটার চিমনির আংশিক ভেঙে দিয়েছিল। পরে তা মেরামত করে ইট পোড়ানো হচ্ছে।
জানতে চাইলে ভাটা দুটির মালিক ওবায়দুর রহমান আলাল বলেন, অনেক টাকা লগ্নি করা হয়েছে। তাই নিরুপায় হয়ে ভাটা চালু করা হয়েছে। পাশের হিরু এন্টারপ্রাইজ, সোহাগ ব্রিকস ও একে ব্রিকসে গিয়েও ইট পোড়াতে দেখা যায়। জানতে চাইলে একে ব্রিকসের ব্যবস্থাপক হযরত আলী বলেন, আমাদের ইটভাটার ছাড়পত্র ও লাইসেন্সের মেয়াদ রয়েছে। শুধু ইট তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত মাটি কাটার অনুমতি না থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর আমাদের ভাটার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু ভাটা চালু না রাখলেতো অনেক লোকসান গুনতে হবে। তাই ভাটার কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। কুল্লা এলাকায় এমএলই ব্রিকস-১-এ গিয়ে ভাটাটিতে ইট পোড়ানোর পাশাপাশি কাঁচা ইট তৈরি ও ইট বিক্রি করতে দেখা যায়। ভাটার সামনে ভাটার কার্যক্রম বন্ধে জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের কোনো নোটিশ পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ভাটার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ লাভলু বলেন, আগে ভাটাটির নাম ছিল স্বর্ণ ব্রিকস এবং ওই নামে কাগজপত্র ছিল।
কয়েক বছর আগে স্থানীয় কুল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফর রহমান ভাটটি কিনে নেন। এরপর এর নাম দেওয়া হয় এমএলই-১ ব্রিকস। মোহাম্মদ লাভলু আরও বলেন, স্বর্ণ ব্রিকসের নামে যে লাইসেন্স ও ছাড়পত্র ছিল তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যা পরে নবায়ন করা হয়নি। এমএলই-১ নামে লাইসেন্স ও ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাওয়া যায়নি।
একারণে গত ২৪ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ভাটার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু এক দিন পর থেকেই আমরা ভাটা চালাচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা অমান্য করে কেন ইটভাটা পরিচালনা করছেন জানতে চাইলে মো. লাভলু বলেন, অন্যরাও মানছেন না, তাই আমরাও মানছি না।
এমএলই-১ ব্রিকস থেকে কয়েকশ গজ দূরে মেসার্স মাহী এন্টারপ্রাইজ। ভাটাটির পরিবেশের ছাড়পত্রের মেয়াদও ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ইট পোড়ানোর অনুমতি ছিল। এরপরও পরিবেশ অধিদপ্তর গত ২৪ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়ে ভাটার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। এরপর উপজেলা প্রশাসন ভাটার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়।
স্থানীয়রা জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন মাহী ব্রিকসের কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেও গোপনে ইট বিক্রিসহ ভাটার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে মেসার্স মাহী এন্টার প্রাইজের মালিক মো. সোলাইমান হোসেন বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন ভাটার কার্যক্রম বন্ধ করার পর থেকে ইট বিক্রি ও উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।
সোলাইমান হোসেন আরও বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের কয়েক দিন পর উপজেলা প্রশাসন শুধু আমার ইটভাটার সামনে লাইসেন্স ও ছাড়পত্র বাতিলের নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়।
যে কারণ দেখিয়ে জেলা প্রশাসন আমার ইটভাটার লাইসেন্স বাতিল করেছে একই কারণ থাকার পরেও অন্য ইটভাটার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমার পাশের মদিনা ব্রিকসের অবস্থান আবাসিক এলাকার মধ্যে। কিন্তু মদিনা ব্রিকসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরও ওই ভাটায় কোনো অভিযান চালায়নি। জানতে চাইলে ধামরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে মেসার্স মাহী এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। তাই ভাটাটির কার্যক্রম বন্ধ করে নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেসব ইটভাটায় অনুমতি ছাড়া ইট পোড়ানো হচ্ছে এবং পরিবেশ অধিদপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার পরেও তা চালু রাখা হয়েছে ওইসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে ইউএনও মামনুন আহমেদ অনীক এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ইলিয়াস মাহমুদ বলেন, অভিযোগ আমারাও পেয়েছি। যেসব ইটভাটার মালিক নির্দেশনা অমান্য করে ইট পোড়াচ্ছেন সেইসব ইটভাটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।