ঢাকা ০৯:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্রিটেন-বাংলাদেশের ক্ষমতার গতি

  • আপডেট সময় : ০৫:১৭:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫
  • ১৭ বার পড়া হয়েছে

মুনজের আহমদ চৌধুরী : ব্রিটেনে ও বাংলাদেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছিল গত জুলাই মাসে। ক্ষমতায় এসেছিল যথাক্রমে লেবার পার্টি ও ড. ইউনূসের সরকার। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টিকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি।
মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও লেবার পার্টির জনপ্রিয়তায় বিপুল ধস নেমেছে বলে বিভিন্ন জনমত জরিপে স্পষ্ট হয়েছে। এত দ্রæততম সময়ে কোনো নির্বাচিত সরকারের অজনপ্রিয় হওয়ার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ব্রিটেনের বর্তমান সরকার।

ব্রিটেনের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে গতি ফেরানো ছিল তাদের অন্যতম প্রতিশ্রæতি। কিন্তু তারা ক্ষমতায় বসবার পর অর্থনীতির বিপর্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে যা স্পষ্ট হয়েছে সব সা¤প্রতিক পরিসংখ্যানে।
বেকারত্ব বাড়ছে, বন্ধ হচ্ছে ছোট বড় কারখানা, সুপারস্টোর থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা। মাত্র পাঁচ মাসে হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে ব্রিটেন থেকে।

যার ফলে ক্রমশ জনসমর্থন কমছে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর।
অনেকের কাছে যে বিষয়টি আশঙ্কার তা হলো, লেবার পার্টির সমর্থন কমলেও তা যুক্ত হচ্ছে না লেবারের চির প্রতিদ্ব›দ্বী সদ্য ক্ষমতাচ্যুত কনজারভেটিভদের প্রতি।

সেই সমর্থন যুক্ত হচ্ছে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ নিয়ে বিতর্কিত ও কট্টর অভিবাসী বিরোধী নাইজেল ফারাজের প্রতি। সাধারণ মানুষের বড় দুটি দলের প্রতি আস্থাহীনতা ও ডানপন্থিদের চেয়ে উগ্র কট্টর ডানপন্থিদের শক্তিশালী হওয়া ব্রিটেনের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করছে।
জন্মসূত্রে বাসিন্দাদের বেকারত্ব ও বেনিফিট নির্ভরতার প্রবণতা, সরকারি সাহায্যের অর্থের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকা আর নিম্নমুখী জীবনমানের কারণে ইউরোপের দেশে দেশে নাগরিকরা হতাশ।

সেই হতাশাকে পুঁজি করে অভিবাসী বিরোধিতা উসকে দিয়ে গত কয়েক বছরে, ইউরোপের দেশে দেশে অভিবাসী ও অভিবাসনবিরোধী উগ্র ডানপন্থার জয়জয়কার ছিল। ব্রিটেনেও সেই নেতিবাচক রাজনীতির উপাদানগুলোকে কৌশলে পুঞ্জীভ‚ত করা উগ্র আর চটকদার জাতীয়তাবাদের সেøাগানমুখী পারদ এখন দ্রæতলয়ে ঊর্ধ্বমুখী।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতোই বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তি ভোটের রাজনীতি ব্রিটেনেও ম্রিয়মাণ। লেবার পার্টিতেও জেরেমি করবিনের মতো জনমানুষের নেতার জায়গা হয়নি।

বাম দলগুলো ক্রমেই ভেতরে-বাইরে ডানপন্থার নীতিতে ঝুঁকে ভোটের ব্যাংক বড় করতে চেয়েছে। লেবার পার্টিও সেই পথ ধরে দীর্ঘদিন পর এবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই দেশ চালাতে গিয়ে চরম ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের সম্ভাব্য বিপর্যয়জনক ফলাফল এড়াতে কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দিয়েছেন।
ওই একই পথ ধরে ডানপন্থা ঝুঁকেছে আরও ডানে, শুধু উগ্র ডানপন্থিদের ভোট ধরে রাখার প্রয়োজনে। কিন্তু তাতেও ব্রিটেনের বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী ডানপন্থি দল কনজারভেটিভ পার্টির শেষ রক্ষা হয়নি।

কিছু দিন আগেও নাইজেল ফারাজকে ব্রিটেনের রাজনীতিতে কৌতুক ও বিনোদনমুখী এক চরিত্র হিসেবে দেখা হতো। ফারাজ আটবার হাউজ অব কমন্সের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ছয়টি সাধারণ নির্বাচনে এবং দুটি উপনির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে প্রথমবার এমপি হয়েছেন কেবল ২০২৪ সালে। সেই ফারাজের নতুন গড়া দল রিফর্ম ইউকে এখন সদস্য সংখ্যার বিচারে ১৮৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টির সাথে পাল্লা দিচ্ছে।

তবে ফারাজ দাবি করছেন, তার দল কনজারভেটিভকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারতীয়র পর অশ্বেতাঙ্গ নারী নেতৃত্ব দলে প্রতিষ্ঠিত করেও জনসমর্থন ফিরে পাচ্ছে না দলটি।
নতুন বছর দেশটির প্রাচীন ও বড় দুটি দলই শুরু করছে স্বল্পতম সময়ে বৃহত্তম জনসমর্থন হারানো জনিত ব্যর্থতার অস্বস্তি নিয়ে।
দুই.
ব্রিটেনে লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসার খুব কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে সরাসরি ভোটে নয়, ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন ড. ইউনূস। তার ক্ষমতায় বসার প্রথম দিনে বাংলা ট্রিবিউনেই লিখেছিলাম, তার সরকারের কাজ দেখে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানাতে চাই।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের টানা ‘হাসিনাতন্ত্র’-এর বিপরীতে পাঁচ মাস বয়সী সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়নের উপযুক্ত সময় এখনই নয়। এখনো শতাধিক টিকটকার, ইউটিউবার সরকারের উপদেষ্টা হতে নিজেদের যোগ্যতর ভেবে উন্মুখ অপেক্ষারত। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কোটি কোটি মানুষের কাক্সিক্ষত পতনের সাফল্যের দাবিদার ক্রেডিট শিকারি পুরনো বোতলের নতুন শ্রেণিটি সব সেক্টরে আওয়ামী লীগের পলাতক টাউটদের শূন্যস্থানে জায়গা করে নিতে মরিয়া। জুলাইয়ের বিপ্লবে নীরব থাকা বর্ণচোরারা যথারীতি সুবিধাবাজিতে সরব।
দুঃখজনক হলো, এই সরকারও জনআকাক্সক্ষার চরিত্র বা নীতি কোনোটিই ধারণ কিংবা নিদেনপক্ষে প্রদর্শনও করতে পারেনি। জাতীয় বা সর্বদলীয় রূপে সংহত অবস্থান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সব পক্ষকে খুশি রাখার প্রবণতাই দৃশ্যমান।
এ সরকার যারা চালাচ্ছেন তারা রাজনীতিবিদ নন, দেশ পরিচালনায় তাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, এটা সত্য। এ সত্য স্বীকার করেই বলি, যে গগনচুম্বী জনপ্রত্যাশা এ সরকারের কাছে শুরুতে মানুষের ছিল, তার অনেকখানি জুড়েই এখন হতাশা স্পষ্ট। সেনাবাহিনী পাশে থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি প্রশাসনেও এখনও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত আন্তর্জাতিক উচ্চতার নিরিখের কোনো নৈপুণ্য এখনো অনুপস্থিত। প্রথম দিন থেকে ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা দেশের সকল সেক্টরে অর্থবহ ইতিবাচক সংস্কার-রিসেট করার কথা বলছেন।

কিন্তু বছরের শেষ দিনে এসেও রুটিনমাফিক কিছু কমিটি ও প্রতিবেদনের পুনরাবৃত্তি ছাড়া সেই কাংঙ্ক্ষিত সংস্কার প্রক্রিয়ার কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি।
এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের ভোট ডাকাতির নির্বাচন ও নির্বাচনি গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন ও তার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে। কিন্তু গত পাঁচ মাসেও এই স্বল্পকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস আদৌ কবে নির্বাচন দেবেন, কতদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে চান, সেটি সুস্পষ্ট করেননি।

১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা আজকের বাংলাদেশকে ১৯০ বছর শাসন করে। এরপর ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলায় আরও ২৪ বছর ব্রিটিশ আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। প্রায় দুইশ বছর শাসন করা বাংলাদেশ আর শোষক ব্রিটেনের চলতি রাজনীতির গতিপথকে অদ্ভুত এক সমান্তরালে দাঁড় করিয়েছে আজকের সময়।
দীর্ঘ লেখা এখন রিল আর টিকটক দেখে অভ্যাস করা পাঠক থেকে অস্থির দর্শক হওয়া স্ক্রল করা চোখেদের ধৈর্যচ্যুতির উপসর্গ। বিলেতের মধ্য রাতে শীত তাড়িয়ে ঘুমের সময় চুরি করে এক বসায় পর্যবেক্ষণ লেখার তাড়নাও সঙ্গত কারণেই দমিত।
আমার অন্তত এক যুগ আগে প্রকাশিত কলামের শেষ লাইন ছিল, অন্ধ ডানের বায়ে, আর ভ্রষ্ট বামের ডানে রাজনৈতিক দালাল আর সন্ত্রাসহীন স্ব-দেশের সোপানে…।
বিশ্বাস করি, যাপিত নৈরাশ্যের কাছে কখনো কোনোদিনও সুবিধাবাজ- দলবাজ-দালাল না হওয়া সাধারণ মানুষের পবিত্র আশাবাদ পরাজিত হতে পারে না।

লেখক: যুক্তরাজ্যে কর্মরত সাংবাদিক

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দাভোসে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ

ব্রিটেন-বাংলাদেশের ক্ষমতার গতি

আপডেট সময় : ০৫:১৭:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫

মুনজের আহমদ চৌধুরী : ব্রিটেনে ও বাংলাদেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছিল গত জুলাই মাসে। ক্ষমতায় এসেছিল যথাক্রমে লেবার পার্টি ও ড. ইউনূসের সরকার। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টিকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি।
মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও লেবার পার্টির জনপ্রিয়তায় বিপুল ধস নেমেছে বলে বিভিন্ন জনমত জরিপে স্পষ্ট হয়েছে। এত দ্রæততম সময়ে কোনো নির্বাচিত সরকারের অজনপ্রিয় হওয়ার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ব্রিটেনের বর্তমান সরকার।

ব্রিটেনের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে গতি ফেরানো ছিল তাদের অন্যতম প্রতিশ্রæতি। কিন্তু তারা ক্ষমতায় বসবার পর অর্থনীতির বিপর্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে যা স্পষ্ট হয়েছে সব সা¤প্রতিক পরিসংখ্যানে।
বেকারত্ব বাড়ছে, বন্ধ হচ্ছে ছোট বড় কারখানা, সুপারস্টোর থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা। মাত্র পাঁচ মাসে হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে ব্রিটেন থেকে।

যার ফলে ক্রমশ জনসমর্থন কমছে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর।
অনেকের কাছে যে বিষয়টি আশঙ্কার তা হলো, লেবার পার্টির সমর্থন কমলেও তা যুক্ত হচ্ছে না লেবারের চির প্রতিদ্ব›দ্বী সদ্য ক্ষমতাচ্যুত কনজারভেটিভদের প্রতি।

সেই সমর্থন যুক্ত হচ্ছে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ নিয়ে বিতর্কিত ও কট্টর অভিবাসী বিরোধী নাইজেল ফারাজের প্রতি। সাধারণ মানুষের বড় দুটি দলের প্রতি আস্থাহীনতা ও ডানপন্থিদের চেয়ে উগ্র কট্টর ডানপন্থিদের শক্তিশালী হওয়া ব্রিটেনের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করছে।
জন্মসূত্রে বাসিন্দাদের বেকারত্ব ও বেনিফিট নির্ভরতার প্রবণতা, সরকারি সাহায্যের অর্থের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকা আর নিম্নমুখী জীবনমানের কারণে ইউরোপের দেশে দেশে নাগরিকরা হতাশ।

সেই হতাশাকে পুঁজি করে অভিবাসী বিরোধিতা উসকে দিয়ে গত কয়েক বছরে, ইউরোপের দেশে দেশে অভিবাসী ও অভিবাসনবিরোধী উগ্র ডানপন্থার জয়জয়কার ছিল। ব্রিটেনেও সেই নেতিবাচক রাজনীতির উপাদানগুলোকে কৌশলে পুঞ্জীভ‚ত করা উগ্র আর চটকদার জাতীয়তাবাদের সেøাগানমুখী পারদ এখন দ্রæতলয়ে ঊর্ধ্বমুখী।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতোই বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তি ভোটের রাজনীতি ব্রিটেনেও ম্রিয়মাণ। লেবার পার্টিতেও জেরেমি করবিনের মতো জনমানুষের নেতার জায়গা হয়নি।

বাম দলগুলো ক্রমেই ভেতরে-বাইরে ডানপন্থার নীতিতে ঝুঁকে ভোটের ব্যাংক বড় করতে চেয়েছে। লেবার পার্টিও সেই পথ ধরে দীর্ঘদিন পর এবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই দেশ চালাতে গিয়ে চরম ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের সম্ভাব্য বিপর্যয়জনক ফলাফল এড়াতে কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দিয়েছেন।
ওই একই পথ ধরে ডানপন্থা ঝুঁকেছে আরও ডানে, শুধু উগ্র ডানপন্থিদের ভোট ধরে রাখার প্রয়োজনে। কিন্তু তাতেও ব্রিটেনের বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী ডানপন্থি দল কনজারভেটিভ পার্টির শেষ রক্ষা হয়নি।

কিছু দিন আগেও নাইজেল ফারাজকে ব্রিটেনের রাজনীতিতে কৌতুক ও বিনোদনমুখী এক চরিত্র হিসেবে দেখা হতো। ফারাজ আটবার হাউজ অব কমন্সের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ছয়টি সাধারণ নির্বাচনে এবং দুটি উপনির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে প্রথমবার এমপি হয়েছেন কেবল ২০২৪ সালে। সেই ফারাজের নতুন গড়া দল রিফর্ম ইউকে এখন সদস্য সংখ্যার বিচারে ১৮৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টির সাথে পাল্লা দিচ্ছে।

তবে ফারাজ দাবি করছেন, তার দল কনজারভেটিভকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারতীয়র পর অশ্বেতাঙ্গ নারী নেতৃত্ব দলে প্রতিষ্ঠিত করেও জনসমর্থন ফিরে পাচ্ছে না দলটি।
নতুন বছর দেশটির প্রাচীন ও বড় দুটি দলই শুরু করছে স্বল্পতম সময়ে বৃহত্তম জনসমর্থন হারানো জনিত ব্যর্থতার অস্বস্তি নিয়ে।
দুই.
ব্রিটেনে লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসার খুব কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে সরাসরি ভোটে নয়, ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন ড. ইউনূস। তার ক্ষমতায় বসার প্রথম দিনে বাংলা ট্রিবিউনেই লিখেছিলাম, তার সরকারের কাজ দেখে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানাতে চাই।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের টানা ‘হাসিনাতন্ত্র’-এর বিপরীতে পাঁচ মাস বয়সী সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়নের উপযুক্ত সময় এখনই নয়। এখনো শতাধিক টিকটকার, ইউটিউবার সরকারের উপদেষ্টা হতে নিজেদের যোগ্যতর ভেবে উন্মুখ অপেক্ষারত। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কোটি কোটি মানুষের কাক্সিক্ষত পতনের সাফল্যের দাবিদার ক্রেডিট শিকারি পুরনো বোতলের নতুন শ্রেণিটি সব সেক্টরে আওয়ামী লীগের পলাতক টাউটদের শূন্যস্থানে জায়গা করে নিতে মরিয়া। জুলাইয়ের বিপ্লবে নীরব থাকা বর্ণচোরারা যথারীতি সুবিধাবাজিতে সরব।
দুঃখজনক হলো, এই সরকারও জনআকাক্সক্ষার চরিত্র বা নীতি কোনোটিই ধারণ কিংবা নিদেনপক্ষে প্রদর্শনও করতে পারেনি। জাতীয় বা সর্বদলীয় রূপে সংহত অবস্থান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সব পক্ষকে খুশি রাখার প্রবণতাই দৃশ্যমান।
এ সরকার যারা চালাচ্ছেন তারা রাজনীতিবিদ নন, দেশ পরিচালনায় তাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই, এটা সত্য। এ সত্য স্বীকার করেই বলি, যে গগনচুম্বী জনপ্রত্যাশা এ সরকারের কাছে শুরুতে মানুষের ছিল, তার অনেকখানি জুড়েই এখন হতাশা স্পষ্ট। সেনাবাহিনী পাশে থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি প্রশাসনেও এখনও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত আন্তর্জাতিক উচ্চতার নিরিখের কোনো নৈপুণ্য এখনো অনুপস্থিত। প্রথম দিন থেকে ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা দেশের সকল সেক্টরে অর্থবহ ইতিবাচক সংস্কার-রিসেট করার কথা বলছেন।

কিন্তু বছরের শেষ দিনে এসেও রুটিনমাফিক কিছু কমিটি ও প্রতিবেদনের পুনরাবৃত্তি ছাড়া সেই কাংঙ্ক্ষিত সংস্কার প্রক্রিয়ার কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি।
এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের ভোট ডাকাতির নির্বাচন ও নির্বাচনি গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন ও তার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে। কিন্তু গত পাঁচ মাসেও এই স্বল্পকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস আদৌ কবে নির্বাচন দেবেন, কতদিন তারা ক্ষমতায় থাকতে চান, সেটি সুস্পষ্ট করেননি।

১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা আজকের বাংলাদেশকে ১৯০ বছর শাসন করে। এরপর ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলায় আরও ২৪ বছর ব্রিটিশ আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। প্রায় দুইশ বছর শাসন করা বাংলাদেশ আর শোষক ব্রিটেনের চলতি রাজনীতির গতিপথকে অদ্ভুত এক সমান্তরালে দাঁড় করিয়েছে আজকের সময়।
দীর্ঘ লেখা এখন রিল আর টিকটক দেখে অভ্যাস করা পাঠক থেকে অস্থির দর্শক হওয়া স্ক্রল করা চোখেদের ধৈর্যচ্যুতির উপসর্গ। বিলেতের মধ্য রাতে শীত তাড়িয়ে ঘুমের সময় চুরি করে এক বসায় পর্যবেক্ষণ লেখার তাড়নাও সঙ্গত কারণেই দমিত।
আমার অন্তত এক যুগ আগে প্রকাশিত কলামের শেষ লাইন ছিল, অন্ধ ডানের বায়ে, আর ভ্রষ্ট বামের ডানে রাজনৈতিক দালাল আর সন্ত্রাসহীন স্ব-দেশের সোপানে…।
বিশ্বাস করি, যাপিত নৈরাশ্যের কাছে কখনো কোনোদিনও সুবিধাবাজ- দলবাজ-দালাল না হওয়া সাধারণ মানুষের পবিত্র আশাবাদ পরাজিত হতে পারে না।

লেখক: যুক্তরাজ্যে কর্মরত সাংবাদিক