ঝিনাইদহ সংবাদদাতা : ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইটভাটা। পরিবেশ দূষণকারী এসব ইটভাটার নেই বৈধ লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
বাজার, স্কুল ও আবাসিক এলাকা ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাটাগুলোর মালিকরা বেশ প্রভাবশালী। তাদের চাপে দীর্ঘদিন ভাটাগুলোতে কোনো অভিযান চলে না বলে অভিযোগ।
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ইট পোড়ানোর লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিসের সার্টিফিকেটসহ কোনো অনুমোদন ছাড়াই মালিকরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নির্বিঘ্নে এসব ভাটায় বছরের পর বছর ইট পোড়াচ্ছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে সরকারি নীতিমালা অমান্য করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও আবাসিক এলাকায় ফসলি জমি নষ্ট করে অবৈধভাবে ভাটার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সবুজ বনায়ন কেটে ইটের ভাটায় দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পথচারী, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী এবং আবাসিক এলাকার জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলদ বৃক্ষ, প্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) ২০১৩-এর আইন বলছে, আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষিজমির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা না করে হরিণাকুন্ডুতে গড়ে উঠেছে ১৭টি ইটভাটা।
সড়কের পাশে ফসলি জমি ঘেঁষে শাখারীদহ বাজার এলাকায় হরিণাকুন্ডু ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান খোকনের মামা-ভাগ্নে ব্রিকস, শীতলী পাড়া হাকিমপুর এলাকায় মেসার্স মিলন অ্যান্ড জান্নাত ব্রিকস, পারমথুরাপুর মেসার্স আসাদ জাহাঙ্গীর ব্রিকস, চাঁদপুরে বাবুল হোসেন খানের আরএসবি ব্রিকস, ভায়না ইউনিয়নে ভাই ভাই ব্রিকস, আরাফ ব্রিকস, একতা ব্রিকস, সোহান ব্রিকস, রুমা ব্রিকস, এ জেড ডাবলু ব্রিকস, বিশ্বাস ব্রিকস, জামাত ব্রিকস ও দৌলতপুর ইউনিয়নে রয়েল ব্রিকস ও মাসুম পারভেজের বিজলী ব্রিকস নামের ইটভাটাগুলোতে ইট পোড়ানোর প্রধান উপাদান কাঠ।
এসব ইটভাটার অধিকাংশেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স। তবুও ব্যবসা রমরমা। ফলে চুল্লি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ দূষিত যেমন হচ্ছে, তেমনই ইট পোড়ানোর জন্য ভাটার চারপাশে শত শত মণ আম, জাম, কাঁঠাল, রেইনট্রি, কদম, নারিকেল, বাঁশের মাথা ও খেজুর গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের কাঠ মজুদ করা হয়েছে।
এছাড়া ফসলি জমির টপসয়েল কেটে পাহাড় সমান মাটির স্তুপ করা হয়েছে। উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটা জনবসতির খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ভাটাগুলোর ১০০ থেকে ১৫০ গজের মধ্যে রয়েছে বিপুল সংখ্যক ফলদ গাছ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শতাধিক বাড়িঘর। কাঠ পোড়ানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় গাছের পাতা পুড়ে যাচ্ছে। ভাটা এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকায় স্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ইটভাটা নির্মাণের কারণে কৃষি জমির পরিমাণও দিন দিন কমতে শুরু করেছে। ভাটার শ্রমিকরা জানান, নিম্নমানের এসব ভাটায় কয়লা ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। তাই কাঠ দিয়েই ইট পোড়াতে হয়।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ফসলি জমির পাশে ইটভাটা গড়ে তোলার কারণে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাসসহ ফসল উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। এদিকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ইটভাটার মাটি সংগ্রহের জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কোনো রকম অনুমতি ছাড়াই এ উপজেলায় প্রতি মৌসুমে ভাটার মালিকরা এক শ্রেণির মাটিখেকো দালালদের মাধ্যমে কৃষি জমির উপরিভাগের টপসয়েল কেটে ইটভাটায় স্তপ করে থাকেন।
ফলে ফসলি জমির উর্বরতাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। অথচ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। বিনিময়ে ইটভাটা থেকে বাৎসরিক আদায় করা হচ্ছে কোটি টাকার মাসোহারা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ইটভাটার। বাকিগুলো চলছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। তবে সেসব ভাটার মালিকরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন বলে দাবি করেন। অভিযোগ রয়েছে, বছরে দুই-একবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দায় সারছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসন।
ভাটা মালিকদের বক্তব্য, তারা বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চান কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাচ্ছেন না। তাই নিরুপায় হয়ে চাঁদা দিয়ে চালাতে হচ্ছে এসব ইটভাটা। বৈধতা না থাকলেও প্রতি বছর ইট পোড়ানোর মৌসুমে পাঁচ লাখ টাকা
রাজস্ব দিতে হচ্ছে সরকারকে। ভাটা মালিকরা জানিয়েছেন, কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা করা যাবে না। একই সঙ্গে ইট পরিবহনের জন্য সরকারি পাকা সড়কও ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু এই আইন মানা আমাদের জন্য খুবই কঠিন। তাই আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পেলেও ভাটা স্থাপন করেছি।
তারা আরও জানান, ভাটাগুলোর বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে প্রশাসনের উৎপাতও বেশি। প্রশাসন ঝামেলা করছে অনবরত। তাদের অনেককেই টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হচ্ছে।
ইটভাটার মালিকরা জানান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বন বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রতিটি সেক্টর ম্যানেজ করে ভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব ম্যানেজ করছেন উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান খোকন। জিয়াউর রহমান বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে কয়লার দাম বৃদ্ধির কারণে ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ইটভাটার ২০১৫ সালের পর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও নবায়ন নেই।
তিনি বলেন, প্রতি বছর ইটভাটাগুলোর মালিকরা এলআর ফান্ডসহ আয়কর ও ভ্যাট দিচ্ছেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স নবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটাগুলো বৈধ নয়। আমি এখানে যোগদান করে স্পষ্ট বলে দিয়েছি এলআর ফান্ডে কোনো টাকা নেওয়া যাবে না।