ঢাকা ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ভেজাল দুধে জীবন সংকটে

  • আপডেট সময় : ০৭:৩০:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৩৫ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা : পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের গ্রাম চকচকিয়া। দিনের আলোতে বড়াল নদীর পাশের ছিমছাম পরিবেশ। রাতে দেখা মেলে ভয়ঙ্কর চিত্রের। ক্রেতা সেজে সন্ধ্যার কিছু পরে গ্রামে ঢুকতেই নাকে এলো কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধ। এই গন্ধ মানে কারখানা চলছে। প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটাপথ পেরিয়ে গোডাউন আকৃতির একটি টিনশেড ঘরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কস্টিক সোডার প্যাকেট, স্কিমড মিল্ক পাউডার, চিনির বস্তা। আরেকপ্রান্তে ডিটারজেন্ট প্যাকেট ও পামওয়েলের ড্রাম। কয়েকজন শ্রমিক ব্যস্ততার সঙ্গে এগুলো পরিমাণমতো নিয়ে পানি মিশিয়ে বানাচ্ছেন দুধের মতো এক ধরনের সাদা তরল। এটিই নাকি আসল দুধ। কাজ শেষে তরলগুলো ড্রাম থেকে প্লাস্টিকের বড় ক্যান ও সিলভারের বোতলে ভরা হচ্ছে। এক কোণায় রাখা আছে ক্রেতার অর্ডারের তালিকা।

তাদের তৈরি এই পণ্যগুলো ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রাকে করে চলে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে ক্রেতা সেজে কথা বলে মিলেছে আরও রোমহর্ষক তথ্য। চকচকিয়ার মতো এই ইউনিয়নের আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রতিরাতেই এই সাদা দুধ ব্যবসার আড়ালে চলে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। একইভাবে খাঁটি ঘিয়ের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় নকল ঘি। প্রায় ১৫ কেজি সয়াবিন তেল ও ভেজিটেবল ফ্যাটের সঙ্গে পাঁচ কেজি খাঁটি ঘি, এক কেজি আলুর পেস্ট, রঙ ভালোভাবে মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এটি দানাদার হওয়ায় ভেজাল বোঝার কোনো উপায় থাকে না। নকল এই মিশ্রণটি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি কেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে। কারখানার একজন শ্রমিক জানালেন, প্রতিদিন শুধু তাদের কারখানা থেকে ৩০০-৫০০ লিটার ভেজাল দুধ চলে যায় দেশের বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ও প্যাকেটজাত দুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে। সেই হিসেবে শুধু এই ইউনিয়নেই কয়েক হাজার লিটার নকল দুধের কারবার চলে।

নকল দুধ তৈরি করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত শ্রমিক জানান, খামারিরা তাদের কাছে এক মণ আসল দুধ বিক্রি করেন ২১০০ থেকে ২২০০ টাকায়। প্রথমে এই দুধ থেকে মেশিনের সাহায্যে সাড়ে তিন কেজি ননি (ক্রিম) বের করা হয়। প্রতি কেজি ২৬৫/২৭০ টাকা হিসেবে ননিগুলো বিক্রি হয় ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকায়। ননি বের করার পর ননির ঘাটতি মেটাতে দেড়কেজি পামওয়েল তেল মেশানো হয়। সেটি বড়বড় ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেন্ড করলে সেই একই দুধে কৃত্রিম ননি তৈরি হয়। অর্থাৎ তেলের দাম ২৫৮ টাকা বাদ দিলে শুরুতেই প্রতিমণে লাভ হয় ৬৯২ থেকে ৭০০ টাকা! আরও তথ্য জানতে ক্রেতা সেজে ঘোরাঘুরি করাকালে জানা গেলো দুধ থেকে ননি আলাদা করার পর সেটি বড় আকারের চৌকোণা কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয়।

এটি থেকে তৈরি হয় ছানা। তৈরি হয়ে গেলে সেটি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তোলা হয়। কড়াইয়ে থাকা দুধের ঘোলা পানিই তখন নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ। প্রতিমণ ছানার পানিতে ১ কেজি ননি, সামান্য পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, ১ কেজি চিনি, পরিমাণমতো কস্টিক সোডা, স্কিমড মিল্ক পাউডার ও পামওয়েল তেল মিশিয়ে ব্লেন্ড করে অবিকল দুধ তৈরি হয়ে যায়। কাজ শেষ হলে এটি রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। শেষে দুধকে তাজা দেখাতে মেশানো হয় ফরমালিন। দুধের ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায় বলে ফরমালিনসহ স্কিমড মিল্ক পাউডার ব্যবহার করা হয়। এতে ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং দুধ দীর্ঘক্ষণ তাজা থাকে।

যার কারণে ল্যাকটোমিটার দিয়েও এই প্রতারণা সহজে ধরা সম্ভব হয় না। ডেমরার গ্রামগুলোতে ভেজাল দুধ তৈরির কাজ চলে প্রায় প্রতিদিনই ভোর থেকে সকাল আটটা-নয়টা এবং সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। খুব সকালে ট্রাক, লরি, পিকআপ, অটোভ্যানে করে এসব দুধ চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজীপুর উপজেলার ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মণ) ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমাণ ছানা তৈরিতে এক হাজার ৪০০ মণ দুধের প্রয়োজন হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করেন। পরে এই পানিই নকল দুধে পরিণত হয়। প্রতিটি কারখানায় সব সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার লিটার ছানার পানি মজুত রাখা হয়। একইভাবে খাঁটি ঘিয়ের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় নকল ঘি। প্রায় ১৫ কেজি সয়াবিন তেল ও ভেজিটেবল ফ্যাটের সঙ্গে পাঁচ কেজি খাঁটি ঘি, এক কেজি আলুর পেস্ট, রঙ ভালোভাবে মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়।

এটি দানাদার হওয়ায় ভেজাল বোঝার কোনো উপায় থাকে না। নকল এই মিশ্রণটি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতিকেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় প্রতিকেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে। জানা গেছে, ফরিদপুর ছাড়াও পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। দিনে প্রায় ৪ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয় সেখানে। এখান থেকে সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে থাকে। দুধ সংগ্রহের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে স্থাপন করেছে প্রচুর শীতলীকরণ ও সংগ্রহ কেন্দ্র। দীর্ঘসময় ভালো রাখার জন্য দুধ এসব শীতলীকরণ কেন্দ্রে রাখা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ভেজালকারীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু শীতলীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের হাত করে মোটা টাকা লেনদেনের মাধ্যমে সেখানে ভেজাল দুধ সরবরাহ করে।
ফরিদপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কায়সার মো. রুহুল আমিন জানান, সেখানে ১২৭টি নিবন্ধিত দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির বেশির ভাগ বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আরও ব্যক্তিগত দুই সহস্রাধিক দুগ্ধ উৎপাদনের খামার রয়েছে। শুধু এই বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫৪টি দুধ সংগ্রহ পয়েন্ট রয়েছে। উৎপাদিত দুধের প্রায় ৭০ শতাংশ এসব প্রতিষ্ঠান নেয়। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ দুধ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন।
ডেমরা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি চক্র গরুর দুধের বদলে এখন এই কেমিক্যালের দুধ বানিয়ে পুরো গ্রামের সুনাম নষ্ট করে দিচ্ছে।

এদিকে এই গ্রামে খাঁটি দুধ উৎপাদনকারীদের অবস্থাও শোচনীয়। গবাদি পশু পালনকারী মিরাজুল নামের এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা কষ্ট করে দুধ উৎপাদন করি। কিন্তু এই ভেজাল দুধের কারণে দামের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারি না।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দুধ উৎপাদনের জন্য দেশের মধ্যে এই দুই জেলা এগিয়ে। এখানে প্রতিদিন ৪ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ লিটারের কিছু বেশি দুধের চাহিদা রয়েছে। অথচ উৎপাদন হয় ৪ লাখ লিটারের কাছাকাছি। সেই হিসেবে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে ৫০ হাজার লিটার। রমজান ও ঈদের আগে এই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এখন উৎপাদিত দুধের মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার লিটার থেকে দেড় লাখ লিটার নেয় বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা, দুই লাখ লিটার দুধ নেয় বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

আর ঘোষরা ৬৫ থেকে ৭০ হাজার লিটার, দুই শতাধিক মিষ্টির দোকান ২৫ হাজার লিটার এবং হাট-বাজারে স্থানীয় ক্রেতারা প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার লিটার দুধ কেনেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করে দুধের এই ঘাটতি পূরণের সুযোগ নিয়ে থাকে। টাকার অংকে প্রতিরাতে তাদের লাভ হয় (৬০ টাকা কেজি হিসেবে) প্রায় অর্ধকোটি টাকা।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ডিসেম্বর ধরেই নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি

ভেজাল দুধে জীবন সংকটে

আপডেট সময় : ০৭:৩০:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বিশেষ সংবাদদাতা : পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের গ্রাম চকচকিয়া। দিনের আলোতে বড়াল নদীর পাশের ছিমছাম পরিবেশ। রাতে দেখা মেলে ভয়ঙ্কর চিত্রের। ক্রেতা সেজে সন্ধ্যার কিছু পরে গ্রামে ঢুকতেই নাকে এলো কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধ। এই গন্ধ মানে কারখানা চলছে। প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটাপথ পেরিয়ে গোডাউন আকৃতির একটি টিনশেড ঘরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কস্টিক সোডার প্যাকেট, স্কিমড মিল্ক পাউডার, চিনির বস্তা। আরেকপ্রান্তে ডিটারজেন্ট প্যাকেট ও পামওয়েলের ড্রাম। কয়েকজন শ্রমিক ব্যস্ততার সঙ্গে এগুলো পরিমাণমতো নিয়ে পানি মিশিয়ে বানাচ্ছেন দুধের মতো এক ধরনের সাদা তরল। এটিই নাকি আসল দুধ। কাজ শেষে তরলগুলো ড্রাম থেকে প্লাস্টিকের বড় ক্যান ও সিলভারের বোতলে ভরা হচ্ছে। এক কোণায় রাখা আছে ক্রেতার অর্ডারের তালিকা।

তাদের তৈরি এই পণ্যগুলো ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রাকে করে চলে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে ক্রেতা সেজে কথা বলে মিলেছে আরও রোমহর্ষক তথ্য। চকচকিয়ার মতো এই ইউনিয়নের আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রতিরাতেই এই সাদা দুধ ব্যবসার আড়ালে চলে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। একইভাবে খাঁটি ঘিয়ের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় নকল ঘি। প্রায় ১৫ কেজি সয়াবিন তেল ও ভেজিটেবল ফ্যাটের সঙ্গে পাঁচ কেজি খাঁটি ঘি, এক কেজি আলুর পেস্ট, রঙ ভালোভাবে মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এটি দানাদার হওয়ায় ভেজাল বোঝার কোনো উপায় থাকে না। নকল এই মিশ্রণটি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি কেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে। কারখানার একজন শ্রমিক জানালেন, প্রতিদিন শুধু তাদের কারখানা থেকে ৩০০-৫০০ লিটার ভেজাল দুধ চলে যায় দেশের বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ও প্যাকেটজাত দুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে। সেই হিসেবে শুধু এই ইউনিয়নেই কয়েক হাজার লিটার নকল দুধের কারবার চলে।

নকল দুধ তৈরি করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত শ্রমিক জানান, খামারিরা তাদের কাছে এক মণ আসল দুধ বিক্রি করেন ২১০০ থেকে ২২০০ টাকায়। প্রথমে এই দুধ থেকে মেশিনের সাহায্যে সাড়ে তিন কেজি ননি (ক্রিম) বের করা হয়। প্রতি কেজি ২৬৫/২৭০ টাকা হিসেবে ননিগুলো বিক্রি হয় ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকায়। ননি বের করার পর ননির ঘাটতি মেটাতে দেড়কেজি পামওয়েল তেল মেশানো হয়। সেটি বড়বড় ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেন্ড করলে সেই একই দুধে কৃত্রিম ননি তৈরি হয়। অর্থাৎ তেলের দাম ২৫৮ টাকা বাদ দিলে শুরুতেই প্রতিমণে লাভ হয় ৬৯২ থেকে ৭০০ টাকা! আরও তথ্য জানতে ক্রেতা সেজে ঘোরাঘুরি করাকালে জানা গেলো দুধ থেকে ননি আলাদা করার পর সেটি বড় আকারের চৌকোণা কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয়।

এটি থেকে তৈরি হয় ছানা। তৈরি হয়ে গেলে সেটি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তোলা হয়। কড়াইয়ে থাকা দুধের ঘোলা পানিই তখন নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ। প্রতিমণ ছানার পানিতে ১ কেজি ননি, সামান্য পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, ১ কেজি চিনি, পরিমাণমতো কস্টিক সোডা, স্কিমড মিল্ক পাউডার ও পামওয়েল তেল মিশিয়ে ব্লেন্ড করে অবিকল দুধ তৈরি হয়ে যায়। কাজ শেষ হলে এটি রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। শেষে দুধকে তাজা দেখাতে মেশানো হয় ফরমালিন। দুধের ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায় বলে ফরমালিনসহ স্কিমড মিল্ক পাউডার ব্যবহার করা হয়। এতে ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং দুধ দীর্ঘক্ষণ তাজা থাকে।

যার কারণে ল্যাকটোমিটার দিয়েও এই প্রতারণা সহজে ধরা সম্ভব হয় না। ডেমরার গ্রামগুলোতে ভেজাল দুধ তৈরির কাজ চলে প্রায় প্রতিদিনই ভোর থেকে সকাল আটটা-নয়টা এবং সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। খুব সকালে ট্রাক, লরি, পিকআপ, অটোভ্যানে করে এসব দুধ চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজীপুর উপজেলার ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মণ) ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমাণ ছানা তৈরিতে এক হাজার ৪০০ মণ দুধের প্রয়োজন হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করেন। পরে এই পানিই নকল দুধে পরিণত হয়। প্রতিটি কারখানায় সব সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার লিটার ছানার পানি মজুত রাখা হয়। একইভাবে খাঁটি ঘিয়ের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় নকল ঘি। প্রায় ১৫ কেজি সয়াবিন তেল ও ভেজিটেবল ফ্যাটের সঙ্গে পাঁচ কেজি খাঁটি ঘি, এক কেজি আলুর পেস্ট, রঙ ভালোভাবে মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়।

এটি দানাদার হওয়ায় ভেজাল বোঝার কোনো উপায় থাকে না। নকল এই মিশ্রণটি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতিকেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় প্রতিকেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে। জানা গেছে, ফরিদপুর ছাড়াও পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। দিনে প্রায় ৪ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয় সেখানে। এখান থেকে সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে থাকে। দুধ সংগ্রহের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে স্থাপন করেছে প্রচুর শীতলীকরণ ও সংগ্রহ কেন্দ্র। দীর্ঘসময় ভালো রাখার জন্য দুধ এসব শীতলীকরণ কেন্দ্রে রাখা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ভেজালকারীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু শীতলীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের হাত করে মোটা টাকা লেনদেনের মাধ্যমে সেখানে ভেজাল দুধ সরবরাহ করে।
ফরিদপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কায়সার মো. রুহুল আমিন জানান, সেখানে ১২৭টি নিবন্ধিত দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির বেশির ভাগ বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আরও ব্যক্তিগত দুই সহস্রাধিক দুগ্ধ উৎপাদনের খামার রয়েছে। শুধু এই বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫৪টি দুধ সংগ্রহ পয়েন্ট রয়েছে। উৎপাদিত দুধের প্রায় ৭০ শতাংশ এসব প্রতিষ্ঠান নেয়। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ দুধ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন।
ডেমরা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি চক্র গরুর দুধের বদলে এখন এই কেমিক্যালের দুধ বানিয়ে পুরো গ্রামের সুনাম নষ্ট করে দিচ্ছে।

এদিকে এই গ্রামে খাঁটি দুধ উৎপাদনকারীদের অবস্থাও শোচনীয়। গবাদি পশু পালনকারী মিরাজুল নামের এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা কষ্ট করে দুধ উৎপাদন করি। কিন্তু এই ভেজাল দুধের কারণে দামের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারি না।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দুধ উৎপাদনের জন্য দেশের মধ্যে এই দুই জেলা এগিয়ে। এখানে প্রতিদিন ৪ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ লিটারের কিছু বেশি দুধের চাহিদা রয়েছে। অথচ উৎপাদন হয় ৪ লাখ লিটারের কাছাকাছি। সেই হিসেবে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে ৫০ হাজার লিটার। রমজান ও ঈদের আগে এই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এখন উৎপাদিত দুধের মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার লিটার থেকে দেড় লাখ লিটার নেয় বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা, দুই লাখ লিটার দুধ নেয় বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

আর ঘোষরা ৬৫ থেকে ৭০ হাজার লিটার, দুই শতাধিক মিষ্টির দোকান ২৫ হাজার লিটার এবং হাট-বাজারে স্থানীয় ক্রেতারা প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার লিটার দুধ কেনেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করে দুধের এই ঘাটতি পূরণের সুযোগ নিয়ে থাকে। টাকার অংকে প্রতিরাতে তাদের লাভ হয় (৬০ টাকা কেজি হিসেবে) প্রায় অর্ধকোটি টাকা।