নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকার যত দ্রুত সম্ভব শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকে যতটা দ্রুত সম্ভব শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে।’ প্রেস সচিব বলেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে আইনগত প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে। তবে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য একটা প্রয়োজনীয় সময়ের ব্যাপার আছে। আমরা বারবার বলছি- শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনতে চাই। আশা করছি, উনাকে দ্রুত দেশে ফেরত এনে বিচারের সম্মুখীন করা সম্ভব হবে। প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে ইতিমধ্যে ভারত সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের এ বিষয়ে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে তাকে ফেরত চেয়েছে।
এ বিষয়ে ভারতকে নোট ভারবাল পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান। শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে প্রেস সচিব বলেন, ‘আমরা দেখেছি গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার অপরাধগুলো কতটা ভয়াবহ ছিল। পুরো পৃথিবী এখন তার অপরাধগুলো দেখতে পাচ্ছে।’ গুম কমিশনের রিপোর্টের বরাদ দিয়ে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে প্রায় ৩,৫০০ মানুষ গুম হয়েছে। আইন-বর্হিভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। এ ছাড়া জুলাই বিপ্লবে প্রায় ১,৫০০ ছাত্র-জনতা প্রাণ হারিয়েছে। জুলাই মাসে গুলিবিদ্ধ আরাফাত নামে ৬ বছর বয়সী মাদ্রাসা ছাত্রের শাহাদাতের কথা স্মরণ করে শফিকুল আলম বলেন, একটা শিশুকে পুলিশ গুলি করেছে, তা কতটা ভয়াবহ! গত রোববার তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার শাসনামলে শাপলা চত্বরে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুর পরের হত্যাকাণ্ডও আমরা দেখেছি।’ বিএনপি বারবার বলছে তাদের ৫০ থেকে ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ মামলা ছিল মিথ্যা। ৫০ লাখ মামলা যাদের নামের হয়েছে তাদের পরিবার অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনার ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, সরকার তার দুর্নীতির বিষয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করছে। শেখ হাসিনা কী পরিমাণ চুরি করেছেন বাংলাদেশের মানুষ তা জানতে চায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা কীভাবে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশে একটা চোরতন্ত্র জারি রেখেছিল তার ভয়াল চিত্র শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে। প্রতিবছর ১ হাজার ৬শ’ কোটি মার্কিন ডলার পাচার এবং ব্যাংকগুলো থেকে কীভাবে টাকা লুট হয়েছে তা সবার জানা। প্রেস সচিব বলেন, শেখ হাসিনা নিজে বলেছিলেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সেই পিয়নের ব্যাংক তহবিলে ৬২৬ কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের আর্থিক লেনদেনের নথি তলব
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের দেশে-বিদেশে লেনদেনের যাবতীয় নথি তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো চিঠিতে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নামে পরিচালিত অফশোর ব্যাংকের হিসাব বিবরণীসহ সব অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে। একইসঙ্গে অনুসন্ধান টিম প্রথম দফায় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত নথিপত্র তলব করে নির্বাচন কমিশন এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসের নথি তলব করেছে। জানা গেছে, শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নয়টি প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
একইসঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের পৃথক আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নভোথিয়েটার মামলায় পুনরায় তদন্ত করবে দুদক
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলায় পুনরায় তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল মঙ্গলবার দুদকের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালের ২৭ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমানে বিলুপ্ত)। এর মধ্যে পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম একটি এবং দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা (এন্টি করাপশন অফিসার) খান মো. মীজানুল ইসলাম দুটি মামলা করেন। এসব মামলায় যথাক্রমে ৭ জন, ৮ জন এবং ১২ জনকে আসামি করা হয়। প্রতিটি মামলারই প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার প্রকল্প বিষয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যনির্বাহী পরিষদের (একনেক) সিদ্ধান্তকে আমলে নিয়ে এই মামলাগুলো করা হয়। একনেকের সিদ্ধান্তগুলো ছিল—প্রকল্পের পরামর্শকের ব্যয় বৃদ্ধি, ভবন নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যয় বৃদ্ধি। মামলার আসামিদের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক মারা গেছেন। আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, মহীউদ্দীন খান আলমগীর অভিযোগের দায় থেকে উচ্চ আদালত থেকে অব্যাহতি পান।
মামলার পর থেকেই শেখ হাসিনা এবং অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন আইনি লড়াই করেছেন। দুর্নীতি দমন ব্যুরো পরবর্তী সময়ে কমিশন হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের কমিশন মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে আলাদা দুটি রিট আবেদন করেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের ৪ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। আদালতের ওই রায়ের পর মামলাগুলো দুদকের অনিষ্পন্ন শাখায় পড়ে ছিল। তিনটি মামলা পুনঃতদন্তের জন্য উপপরিচালক মঞ্জুর মোরশেদকে দুদকের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাসে তিনটি মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।