আহসান কবির : কবিতা কি নিঃসঙ্গ? কবি হেলাল হাফিজ কি কবিতার মতো আজীবন নিঃসঙ্গ ছিলেন? নাকি কবিতার কাছে তুমুল ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার পর ‘নিঃস্ব’ হয়েই তার পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ছিল? যেখানে গেছেন সেখানে গিয়ে কী বলবেন- ‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম/ বলতে এলাম ভালোবাসি!’ ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়, তিনি কী কবিতাকে তেমন করে বিপদমুক্ত করতে পেরেছেন শেষমেশ? নাকি একাকিত্বের বেদনাকে না কাঁদতে বললেও সেটা উপভোগ করতে গিয়ে আজীবন একাই কেঁদেছেন নীরবে?
প্রকৃতি নিজেই কবিকে নীরব বেদনার মুখোমুখি করেছিল! বেদনা বোঝার আগেই তিনি সীমাহীন বেদনার পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তিন বছর বয়সেই গৃহিণী মা কোকিলা বেগমকে হারিয়েছিলেন। স্কুলশিক্ষক বাবা (খোরশেদ আলি তালুকদার) জীবনের প্রয়োজনেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। মমতাময়ী মাকে হারানোর বেদনা আজীবন ভুলতে পারেননি কবি। একাধিক সাক্ষাৎকারে সে কথা বলেছেন তিনি।
বলেছেনÑ ‘পৃথিবীর এই শ্রেষ্ঠ বেদনাটুকু অনুভবই করতে পারিনি। মা’র কোনো স্মৃতি আমার নেই। যে যাতনা আমাকে পোহাতে হলো তা ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই, অথচ যত বয়স বাড়তে লাগলো মাতৃহীনতার এই বেদনা আমাকে গ্রাস করে ফেললো।’
হয়তো এ কারণেই কবিতার বইয়ের নাম রেখেছিলেন- বেদনাকে বলেছি কেঁদো না।
কবিতায় বা সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন- বেদনার সব কথা মানুষ বলে না!
বেদনার সব কথা না বললেও কিছু কিছু বলেছেন। মাঝে মাঝে বলতেন হেলেনের কথা। হেলেনকে ভালোবেসেছিলেন। স্বাধীনতার পর বাবাকে হারিয়েছিলেন, অল্প কয়েক দিনের মাথায় হেলেন তাকে ছেড়ে বিয়ে করেন অন্যত্র।
ব্যক্তিগত এক আলাপচারিতায় একবার বলেছিলেনÑ ‘এরপর পুরো আউলা হয়ে গেলাম। ঢাকায় নিজেকে অনেকটা লুকিয়ে রাখার জীবনে কবিতা ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি।’ হেলেনকে নিয়ে খুবই কম বলেছেন আমাকে।
একবার বলেছিলেনÑ দেখা করে শেষবার আর এক চিঠিতে হেলেনই প্রথম জানায় যে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। নেমন্তন্ন জানিয়েছিল আমাকে। এরপর আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমাদের। এক দুইটা পত্র হয়তো হেলেনকে পাঠিয়েছিলাম’!
সেই পত্র যেন তার কবিতায়ই আছে। ‘এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ পত্র দিও… এই কবিতার এক জায়গায় আছে- ‘আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও আপত্তি নেই। গিয়ে থাকলে আমার গেছে কার কী তাতে’?
কবি হেলাল হাফিজ বুঝতেও পারেনি যে কবিতারও কিছু গেছে! কবিতার নামে, প্রেম আর দ্রোহের নামে তিনি কিছু অন্ধ কবিতাপ্রেমিক তৈরি করতে পেরেছিলেন। স্বীকারও করেছেন এভাবে- ‘আমি আর কতটুকু পারি?/এর বেশি পারেনি মানুষ! তিনি এরও বেশি কিছু পেরেছিলেন। আজ থেকে শত বছর পরেও যে ছেলে প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নামবে সে মিছিলের স্লোগান হিসেবে হেলাল হাফিজের সেই অমর লাইনটাই উচ্চারণ করবে- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় শিরোনামের এই কবিতার
আরেক লাইন- ‘কেউ কেউ যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে!’ এই কবিতার শেষের দিকে আছে আরেক নাড়া দেওয়া লাইন- ‘ভালোবেসে কেউ যদি খুনি হতে চান/তবে তাই হয়ে যান/প্রকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়!’
ভালোবেসে নিজেই যেন খুনি হয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। নিঃসঙ্গতার তরবারি দিয়ে নিজেকেই কেটেছেন ক্রমাগত নীরবতায়। বছরের পর বছর কাটিয়েছেন হোটেলের নিঃসঙ্গ কোনো রুমের নির্জনতায়। হোটেলে খেয়ে তাসের খেলায় সময় কাটিয়েছেন দিনের পর দিন।
বলতেনÑ জীবনের বহু দিন স্রেফ অপচয় করে কাটিয়েছি। তাস খেলা নিয়ে প্রশ্ন করতে একবার বলেছিলেন- তাস খেলে কত ছেলে পড়া নষ্ট করে/পরীক্ষা আসিলে তাই চোখে জল ঝরে?- ছোটকালে ব্যাকরণ বইতে এটা পড়নি? ওই যে কারক ও বিভক্তি শেখানো হতো। আমি উত্তর দিয়েছিলাম- হাইড্রোজেনে দুটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট?
এই কবিতায় নতুন কী চোখে পড়েছে তোমার? তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম এভাবে- ফেরি করে শাড়ি চুড়ি আলু পটোল বিক্রি করার ফর্মে লেখা কবিতা যার নাম ফেরিওয়ালা। দুটো লাইন খুব বেশি প্রিয়। একটা-ভুল রমণী ভালোবাসার/ভুল নেতাদের জনসভার/হাইড্রোজেনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট?
অন্য লাইনটাÑ একটা মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে! খুব নীরবে নষ্ট হওয়ার কষ্ট নিয়ে কী তিনি পৃথিবী ছাড়লেন? তিনি এসেছিলেন বুকভাঙা অভিমান আর নিঃসঙ্গতার ব্যথা নিয়ে। অনায়াসে তাই লিখতে পেরেছিলেন- ‘যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি/মাথার কসম আবার এসো/জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো/শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক…লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম…।
তবু তার লন্ডভন্ড হয়ে আসাটা বাংলা কবিতার কয়েক প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ হয়েই থাকলো। ‘তবে কেন তুমুল নাড়ালে’ বলে আমাদের নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ‘নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’ লিখে বোঝাতে চেয়েছিলেন অশ্লীল সভ্যতা কাকে বলে। বলেছিলেন- কবিতার মতো করে কিছু মানুষ জমাতে চাই। কয়জন মানুষ পেয়েছেন জানি না। তবে ‘মানবানল’ কবিতা পড়লে দীর্ঘশ্বাস নামবে সবার- ‘আগুন আর কতটুকু পোড়ে/সীমিত তার ক্ষয়/সীমিত বিনাশ/মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস/আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে/কিছু থাকে/ হোক না তা ধূসর শ্যামল রঙ ছাই/মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না…!
মানুষ কী তুমুল পুড়িয়েছিল কবিকে? হেলেন ছাড়া আরও একজনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন- ভালোবেসেই নাম দিয়েছি তনা/মন না দিলে ছোবল দিও/তুলে বিষের ফণা! অন্য অনেকের মতো আমিও জানতে চেয়েছিলাম- এই ‘তনা’ কী তসলিমা নাসরিন? তিনি অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিলেন- ‘তুমি কি জুলেখা, শিরি, সাবিত্রী নাকি রজকিনী? চিনি খুব জানি, তুমি যার তার/যে কেউ তোমার/তোমাকে দিলাম না- ভালোবাসার অপূর্ব অধিকার!
ভালোবাসার অপূর্ব অধিকার বোধকরি আর কাউকে দিতে চাননি। জীবন আর কোনো ভালোবাসাতেও তাকে আবদ্ধ করতে পারেনি। জানি না তার আর কোনো ইচ্ছে ছিল কি না। যদিও আরেক কবিতায় বলেছিলেনÑ ‘ইচ্ছে ছিল রাজা হবো/তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো/ আজ দেখি/রাজ্য আছে/রাজা আছে/ইচ্ছে আছে/শুধু তুমি অন্য ঘরে!’
অন্য ঘরের অনুভবে হোটেল রুমের নীরবতা কিংবা তাসের টেবিলের শোরগোল কাটিয়ে কবিতার কাছেও নিয়মিত যাওয়া হয়নি তার।
বলেছিলেনÑ ‘শ’পাঁচেক কবিতা থেকে একবার ছাপ্পান্নটা বাছাই করে প্রথম কবিতার বই বের করেছিলাম। নাম পছন্দ হয়নি। পরে নাম বদলে দিয়েছি বইয়ের’। সেটিই তার প্রথম বইÑ যে জলে আগুন জ্বলে। এ পর্যন্ত তেত্রিশ সংস্করণ বের হয়েছে।
২৬ বছর পর ২০১২ সালে এই বইয়ের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে বের হয়েছিল ‘কবিতা একাত্তর’ নামে তার দ্বিতীয় বই।
২০১৯-এ তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ শিরোনামে।
২০১৯ পর্যন্ত তাও এক রকম ভালো ছিলেন তিনি। তখন থাকতেন ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকের এক হোটেলে। খাওয়া-দাওয়া আড্ডা সবই ছিল প্রেস ক্লাবনির্ভর।
কোভিড বা করোনার যুগে সবকিছু যেন লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এরপর কর্ণফুলী নামের এক হোটেলে উঠেছিলেন। কোভিডকাল পাড়ি দিতে কিছু দিন ছিলেন তার ভাইয়ের বাড়িতে।
২০২২-এ অসুখে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু দিন হাসপাতালে ছিলেন। এক বছরের কিছুটা বেশি সময় ধরে থাকতেন শাহবাগের সুপার হোস্টেলে। এখানকার ওয়াশরুমে যেতে চেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিছু সময় পর তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক জানান তিনি আগেই মারা গেছেন। তার লেখা কবিতার মতোই মৃত্যুক্ষণ নিয়ে ধ্রুপদী অস্পষ্টতা থাকলো না।
তিনি লিখেছিলেনÑ হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি/নয়তো গিয়েছি হেরে/থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা/কে কাকে গেলাম ছেড়ে!
তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন এটাতে আর কোনো অস্পষ্টতা নেই। তাকে কেউ ছেড়ে গেলেও তিনি ধ্রুপদী অস্পষ্টতা রাখতে চেয়েছেন। তুমুল, কতটুকু বা ধ্রুপদীর মতো শব্দ বেশ কয়েকটা কবিতায় ব্যবহার করেছেন।
যৌবন বয়সে (১৯৮১ সালের লেখা) গালি ব্যবহার করে একটি মাত্র কবিতা লিখেছিলেন, যা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে যায়।
‘যার যেখানে জায়গা’ শিরোনামের এই কবিতায় বলেছিলেনÑ ‘গোছায়া গাছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়/আলামত দেখতাছি মানুষের হইবোই জয়! এই কবিতার শেষ দুই লাইনÑ ‘রাইত হইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি/আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি!’
কবিতায় পরে আর গালি দেননি কখনও। যে আলামতের কথা বলেছিলেন সেই আলামত ফলেছিল ১৯৭১, ১৯৯০ বা ২০২৪-এ।
মানুষের জয় হয়েছে, আমরা ধরে রাখতে পেরেছি কিনা তুমুল অস্পষ্টতা জমে থাকলো সেখানে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ আরও কিছু পুরস্কার পেয়েছেন আগে, হয়তো মরণোত্তর পুরস্কারও পাবেন। ক
বি হেলাল হাফিজের সবচেয়ে বড় পুরস্কার জীবদ্দশায় কবিতা দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন।
জীবনভর একা থেকে দুঃখ ওম দেওয়ার কথা শৈল্পিকভাবে আছে তার কবিতায়Ñ ‘ব্যাকুল শুশ্রূষা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো/নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ/এতোদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই/দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ’
একটা পতাকা পেলে অনেক কিছু বদলে ফেলার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। মিছিলে গিয়ে সেøাগানে সেøাগানে প্রেমিকার সঙ্গে কথোপকথন চাইতেন। তার এই চাওয়াতে কতখানি বদলে গেছে দেশ বা মানুষ সেটা বলেননি কখনও।
শৈল্পিক তাবিজ বুকে দুঃখ নিয়ে চিরঘুমে একাই থাকবেন হেলাল হাফিজ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ধ্রুপদী অস্পষ্টতা বজায় রেখেই ব্যক্তিগত কথা লিখছি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
২০২২ সালে কবির সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল। বলেছিলাম, ২০২১-এর জুলাইতে হেলেনের মতো একজন মন ভেঙে চলে গেছে। একটা গান লিখেছি আপনার কবিতায় প্রভাবিত হয়ে। ‘যতন করে ভুলে যেও’ এইটুকু আমার গানে ব্যবহার করতে চাই।
তিনি খানিক নীরব থেকে বলেছিলেনÑ গানটা কে গাইবে? আমি জানালাম শিল্পীর নাম অবন্তী সিঁথি। তিনি আমার হাতটা আলতো করে ধরলেন। জানালেন তার চারটা কবিতা থেকে গান করা হয়েছে। একটা ছবিতে গানগুলো ব্যবহার করা হবে। যদিও পরে ছবি দেখে জেনেছি শবনম ফেরদৌসি পরিচালিত আজব কারিগর ছবিতে গানগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।
চলে আসার আগে জানতে চাইলেন, আমার কবিতার একটা প্রিয় লাইন বলে যাও। কোনো কিছু না ভেবে যে লাইনটা মনে এলো সেটাই বললামÑ ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’!
কবিতার জায়নামাজ ব্যবহার করে তার জন্য আজীবন প্রার্থনা তুলে রাখলাম।
লেখক: রম্যলেখক