সাঈদুর রহমান লিটন : মেয়েটি যেখানে থাকে তার পাশে একটি প্রাইমারি স্কুল।স্কুলে মেয়েরা যায় দল বেঁধে।মেয়েটি ও যায়। মেয়েটির নাম ফুলকি। ফুলকি, তার মায়ের বা বাবার দেওয়া নাম নয়। মেয়েটির চেহারা ফুলের মত সুন্দর। তাই এলাকার মানুষ ফুলকি নামে ডাকে। ফুলকি স্কুলে যায় একাই একাই। ও কে কেউ দলে নেয় না।স্কুলে ও কারো পাশে বসতে দেয় না।বেঞ্চের সবার শেষে মন মরা হয়ে ক্লাস করে। ফুলকি এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে।
ফুলকির বন্ধুরা হাতে মেহেদি পরে।দেখতে দারুণ লাগে।সবার হাতে কত রকমের মেহেদির ডিজাইন করে। ফুলকির ও ইচ্ছে করে ও রকম করে মেহেদি নিতে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব?
ফুলকির মা জমিলা পাগলী।পাশের বাজারে সারাদিন থাকে। গান গায়, অযথা হাসে, লাফালাফি করে আরো কত কি? চেয়ে চিনতে খায়। ফুলকির ও এনে দেয়। এভাবেই ফুলকি মানুষ।
ফুলকি সেদিন স্কুলে গেলে আবারো তার হাতে মেহেদি দেখে।ফুলকির প্রবল ইচ্ছে হয় হাতে মেহেদি পরার। বন্ধুদের গল্প করতে শুনেছে, মেহেদির নাম নেহা মেহেদি। ফুলকি তার খাতার এক পাশে লিখে রাখে নেহা মেহেদি।
ফুলকি তার মায়ের কাছে চাবে। তাও উপায় নেই।ফুলকি এখন একটু বড় হয়েছে। ওর মা পাগলী তা বুঝতে পারে।ওর বাবা নেই। ওর বাবা কে তাও জানে না। শুধু জানে ফুলকির বাবা নাই।।বাবা নাই বলেই ওর সাথে কেউ মিশতে চায় না। বাবা না থাকলে কেন মেশা যাবে না ফুলকি বুঝে ওঠে না।
ফুলকির মা বাজারে বাজারে থাকে।দেখতে ভালই সুন্দর। শুধুই বুদ্ধি টুকুই নাই।পাগলী হলেও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে।সবজি বাজারের উন্মুক্ত
ঘরে থাকে।
রাতের আঁধারে কোন ভদ্র লোক ফুলকির বাবার কাজ করেছে সে আল্লাহই জানে।ফুলকি স্কুলের পাশেই একটা খড়ের স্তুপ সেখানেই জন্ম নিয়েছে।আর ওখান থেকেই অবহেলা অনাদরে মানুষ হয়েছে।
এই স্কুলের হেড স্যার ফুলকি একটু বড় হলে স্কুলে নিয়ে বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন।সেই থেকে ফুলকি স্কুলে।তা প্রায় আজ তিন বছর হতে চলল।ফুলকি ভালই পড়তে পারে।তার মেধা বিধাতার দান।তাকে দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নাই। তার তিন বেলা খাওয়ার ও নিশ্চয়তা নাই।তার শখ হয়েছে মেহেদি পরার।নেহা মেহেদি। স্কুলের অদূরে মাস্টার কসমেটিক্স।ফুলকি দোকান ঘুরে দেখে মেহেদি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।ফুলকির চোখ আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তার শখের মেহেদি এখানে।হাতের কাছে। কিন্তু কেনার সামর্থ নাই। ফুলকি চলে যায়। পাগলী মায়ের কাছে। মা তো মায়ই।পাগলী হোক আর ভাল। কোলে বসিয়ে আদর করে। কুঁড়িয়ে পাওয়া একটা পচা আপেল দেয়, ফুলকি খুশি মনে খেয়ে নেয়।
ফুলকি এখন মাঝে মাঝে মাস্টার কসমেটিক্সের ওখানে যায়। দূর থাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।সেটাই মনের তৃপ্তি। কি আর করবে।কিনতে পারে না তবু ও আসে।তাতে কী সুখ! ফুলকি জানে না। ফুলকির ঝুলিয়ে রাখা নেহা মেহেদি দেখলেই ভাল লাগে। মনে মনে ভাবে আমি ও একদিন এই মেহেদি কিনব।হাতে বন্ধুদের মত আল্পনা আঁকবে কি দারুণই না হবে। নিজের হাত দেখতে ভারি সুন্দর লাগবে। সেই সুন্দর হাত বারবার দেখবে। মেহেদি পরার স্বপ্ন ফুলকি প্রতিদিনই দেখে ।
কিন্তু মেহেদি পরা হয় না। ফুলকি এর বাড়ি ওর বাড়ি চেয়ে চেয়ে খায়। সবাই ভালো ও বাসে।অনেকেই না চাইতে ও খাবার দেয়।ভারি মিষ্টি কথা বলে।বাজারে অনেকেই হোটেলের সামনে দাঁড়ালে পুড়ি, সিঙ্গারা বা কারো এঁটো খাবার দেয়। ফুলকি খুশি মনে খায়।কিন্তু মাস্টার কসমেটিক্সের সামনে প্রতিদিনই যায়, একদিন ও বলল না মেহেদি নিবি নাকি? মনে হয় কাকুটা আমাকে দেখতে পায় না।দেখতে পেলে আমাকে দিত। কত কি ভাবে, ফুলকির ভাবনার অন্ত নাই। ফুলকি গত ঈদে সবাই যখন মেহেদি হাতে ঘুরছে।ফুলকির খুব কষ্ট হয় মনে। ফুলকি ফুঁফিয়ে ফুঁপিয়ে একাই কাঁদে।চোখ ফেঁটে একাই পানি বের হয়।পানি আর আটকাতে পারে না।
সবাই মেহেদি পরে কিন্তু আমি পরতে পারবো না, বুকের ভিতর এক অজানা ব্যথা কাজ করে। কাউকে বলতে ও পারে না। কাকে বলবে? শোনার কেই বা আছে। যাদের বাবা নাই, মা পাগলী তাদের কথা শোনার লোক থাকে না।পথের এঁটো খেয়ে মানুষ। তাদের মেহেদি পরতে নেই ফুলকি ভাবে। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিতে পারে না।ফুলকি একবার ভাবে মেহেদির দোকানের কাকুর কাছে একটা মেহেদি চাবে। হাতে পায়ে ধরে চাবে। কাকুকে তো ভালই দেখা যায়। কাকু যদি দেয় তবে আজই মেহেদি পরবে।সেই স্বপ্ন নিয়ে মাস্টার কসমেটিক্সে যায়। ধীরে ধীর দোকানের কাছাকাছি যায়। মিষ্টি মিষ্টি কণ্ঠে ফুলকি দোকানদার কে বলে কাকু….ও কাকু….।
ফুলকির মেহেদি পরার শখ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ