ঢাকা ০৮:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

স্বাধীন কুর্দিস্তান আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা সাকিনা

  • আপডেট সময় : ০৫:০৪:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৫৪ বার পড়া হয়েছে

সাকিনা জানচেজের জীবনে দুটি লড়াই ছিলÑ এক. পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও দুই. নিজের জন্মভূমি কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। তার ছদ্মনাম ছিল সারা। স্বাধীন কুর্দিস্তান আন্দোলনের নেত্রী, ১৯৭৮ সালে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার আত্মজীবনী গ্রন্থের শিরোনাম দিয়েছিলেনÑ আমার সারাজীবনই সংগ্রামের।
সাকিনার জন্ম ১৯৫৮ সালে পূর্ব তুরস্কের টুনসেলি প্রদেশে; যেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাই কুর্দি এবং আলেভি সম্প্রদায়ের। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম তুর্কি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হোন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এলাজিগ প্রদেশে পিকেকের শাখা গড়ে তোলার এবং তার ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়।
২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি মহান এই কুর্দি বিপ্লবীকে প্যারিসে গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন সাংবাদিকের ভাষ্য, গভীর রাত দুইটার দিকে প্যারিসের কুর্দিস্তান ইনফরমেশন অফিসের তালাবদ্ধ ঘর থেকে অন্য দুজন নারীর সাথে সাকিনার মরদেহও উদ্ধার করে পুলিশ। তিনজনের মাথায়ই গুলির চিহ্ন ছিল; যা কি না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডেরই অংশ। ধারণা করা হয়, একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সাকিনা পুরো ইউরোপে তুরস্ক সরকারের সাথে পিকেকের যে শান্তি আলোচনা হওয়ার কথা হচ্ছিল সে সম্পর্কেই তথ্য পৌঁছে দিচ্ছিলেন বলেই তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
তিনি ছিলেন একজন সেক্যুলার ফেমিনিস্ট যোদ্ধা, যিনি কিনা সুপরিচিত ছিলেন তার কারিশমা, সাহস, লড়াকু মনোভাব, তার দৃঢ় সংকল্প এবং কুর্দি কমিউনিটিতে তার সম্মানের জন্য। কুর্দি স্বায়ত্বশাসনের দাবির পিছনে তার যে অবদান তা ছিল প্রচণ্ড রকমের সম্মানের এবং এই একটি কারণেই তাকে বছরের পর বছর জেল খাটতে হয়েছে, নির্যাতন সইতে হয়েছে, নির্বাসিত হতে হয়েছে, এবং শেষপর্যন্ত তুরস্কের সিক্রেট সার্ভিসের হাতে তাকে খুনও হতে হয়।
সারা সেসব মহান বিপ্লবী নারীদের একজন; যে নামটি তার লড়াইকালীন নাম। কুর্দিস্তানের লড়াই এর একজন নেতার নাম। চিরকাল নারীমুক্তির ও জাতীয় মুক্তির পক্ষের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত একটি নাম।
নারীবাদ সম্পর্কে তার ধারণাটি প্রথম এসেছিল কুর্দি নারীদের অবস্থা দেখে। তিনি বলেছিলেন, কুর্দি নারীরা সেক্স ক্লাস হিসেবে নির্যাতিত হতো, আর তার এই সচেতনতা তৈরির পিছনে তিনি মার্ক্সিজম সম্পর্কে তার জ্ঞানকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন, মেয়েদের কণ্ঠ সবার কাছে পৌঁছাক, ওরা আরও দৃশ্যমান হোক, আরও বেশি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হোক, ওদের রাজনৈতিক শক্তি অর্জিত হোক। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তিনি কখনও পিছপা হোননি, আপোস করেননি কোথাও। ফলে পুরুষের কাতারে তাকে একাই লড়ে যেতে দেখা যেতো অধিকাংশ সময়। তার নেতৃত্বেই তখন উইমেন লিবারেশন মুভমেন্ট শুরু হয় কুর্দিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে। নারীবাদের সমতার দাবিকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও অত্যাবশ্যকীয় করে তোলেন। গড়ে তোলের উইমেন্স আর্মি। প্রচুরসংখ্যক নারীর সাড়া মেলে এতে। আর এটা ছিল তখনকার সময়েরও দাবি। একদিকে যুদ্ধে প্রচুর হতাহত হচ্ছিল পুরুষেরা, ফলে নারীরাও আর পিছু হটেনি। কুর্দি লেবানিজ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি ক্রমেই সামরিক একাডেমীতে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৮৮ সালে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রণী হিসাবে স্বীকৃত হয়।
সাকিনার নেতৃত্বেই কুর্দিস্তানের নারীদের যেটুকু অধিকার অর্জিত হয়, তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেও হার মানায়। নারীর অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেউ কখনো যেচে দিয়ে যায় না, এজন্য লড়াই করতে হয়। বিশেষ করে ইসলামের পতাকা তলে থাকা দেশগুলো এবং রাষ্ট্রহীন দেশের নারীর অবস্থানের হেরফের হয় না তেমন। আশির দশকের শেষভাগে ইউরোপে থাকা কুর্দি নারীরা বাইরে থেকেই ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট শুরু করেন এবং এসোসিয়েশন অব প্যাট্রিয়টিক উইমেন অব কুর্দিস্তানের পত্তন ঘটান। এই গ্রুপটিই পুরুষের সহিংসতার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলে পরবর্তিতে। এই মুভমেন্টে নারীরা তখন আরও একটি জনপ্রিয় ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট শুরু করেন। আর তাহলো পুরুষের জন্য ফেমিনিস্ট এডুকেশন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গসমতার প্রশ্নে যে অসমতা রয়েছে, সে ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিই ছিল এই এডুকেশনের মূল উপজীব্য।
লাল সালাম সারা, কুর্দি জনগোষ্ঠীর প্রিয় নারী, আপনার হত্যা নারীমুক্তির সংগ্রামকে শেষ করে দিতে পারেনি।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

স্বাধীন কুর্দিস্তান আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা সাকিনা

আপডেট সময় : ০৫:০৪:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

সাকিনা জানচেজের জীবনে দুটি লড়াই ছিলÑ এক. পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও দুই. নিজের জন্মভূমি কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। তার ছদ্মনাম ছিল সারা। স্বাধীন কুর্দিস্তান আন্দোলনের নেত্রী, ১৯৭৮ সালে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার আত্মজীবনী গ্রন্থের শিরোনাম দিয়েছিলেনÑ আমার সারাজীবনই সংগ্রামের।
সাকিনার জন্ম ১৯৫৮ সালে পূর্ব তুরস্কের টুনসেলি প্রদেশে; যেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাই কুর্দি এবং আলেভি সম্প্রদায়ের। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম তুর্কি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হোন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এলাজিগ প্রদেশে পিকেকের শাখা গড়ে তোলার এবং তার ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়।
২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি মহান এই কুর্দি বিপ্লবীকে প্যারিসে গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন সাংবাদিকের ভাষ্য, গভীর রাত দুইটার দিকে প্যারিসের কুর্দিস্তান ইনফরমেশন অফিসের তালাবদ্ধ ঘর থেকে অন্য দুজন নারীর সাথে সাকিনার মরদেহও উদ্ধার করে পুলিশ। তিনজনের মাথায়ই গুলির চিহ্ন ছিল; যা কি না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডেরই অংশ। ধারণা করা হয়, একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সাকিনা পুরো ইউরোপে তুরস্ক সরকারের সাথে পিকেকের যে শান্তি আলোচনা হওয়ার কথা হচ্ছিল সে সম্পর্কেই তথ্য পৌঁছে দিচ্ছিলেন বলেই তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
তিনি ছিলেন একজন সেক্যুলার ফেমিনিস্ট যোদ্ধা, যিনি কিনা সুপরিচিত ছিলেন তার কারিশমা, সাহস, লড়াকু মনোভাব, তার দৃঢ় সংকল্প এবং কুর্দি কমিউনিটিতে তার সম্মানের জন্য। কুর্দি স্বায়ত্বশাসনের দাবির পিছনে তার যে অবদান তা ছিল প্রচণ্ড রকমের সম্মানের এবং এই একটি কারণেই তাকে বছরের পর বছর জেল খাটতে হয়েছে, নির্যাতন সইতে হয়েছে, নির্বাসিত হতে হয়েছে, এবং শেষপর্যন্ত তুরস্কের সিক্রেট সার্ভিসের হাতে তাকে খুনও হতে হয়।
সারা সেসব মহান বিপ্লবী নারীদের একজন; যে নামটি তার লড়াইকালীন নাম। কুর্দিস্তানের লড়াই এর একজন নেতার নাম। চিরকাল নারীমুক্তির ও জাতীয় মুক্তির পক্ষের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত একটি নাম।
নারীবাদ সম্পর্কে তার ধারণাটি প্রথম এসেছিল কুর্দি নারীদের অবস্থা দেখে। তিনি বলেছিলেন, কুর্দি নারীরা সেক্স ক্লাস হিসেবে নির্যাতিত হতো, আর তার এই সচেতনতা তৈরির পিছনে তিনি মার্ক্সিজম সম্পর্কে তার জ্ঞানকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন, মেয়েদের কণ্ঠ সবার কাছে পৌঁছাক, ওরা আরও দৃশ্যমান হোক, আরও বেশি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হোক, ওদের রাজনৈতিক শক্তি অর্জিত হোক। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তিনি কখনও পিছপা হোননি, আপোস করেননি কোথাও। ফলে পুরুষের কাতারে তাকে একাই লড়ে যেতে দেখা যেতো অধিকাংশ সময়। তার নেতৃত্বেই তখন উইমেন লিবারেশন মুভমেন্ট শুরু হয় কুর্দিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে। নারীবাদের সমতার দাবিকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও অত্যাবশ্যকীয় করে তোলেন। গড়ে তোলের উইমেন্স আর্মি। প্রচুরসংখ্যক নারীর সাড়া মেলে এতে। আর এটা ছিল তখনকার সময়েরও দাবি। একদিকে যুদ্ধে প্রচুর হতাহত হচ্ছিল পুরুষেরা, ফলে নারীরাও আর পিছু হটেনি। কুর্দি লেবানিজ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি ক্রমেই সামরিক একাডেমীতে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৮৮ সালে নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রণী হিসাবে স্বীকৃত হয়।
সাকিনার নেতৃত্বেই কুর্দিস্তানের নারীদের যেটুকু অধিকার অর্জিত হয়, তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেও হার মানায়। নারীর অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেউ কখনো যেচে দিয়ে যায় না, এজন্য লড়াই করতে হয়। বিশেষ করে ইসলামের পতাকা তলে থাকা দেশগুলো এবং রাষ্ট্রহীন দেশের নারীর অবস্থানের হেরফের হয় না তেমন। আশির দশকের শেষভাগে ইউরোপে থাকা কুর্দি নারীরা বাইরে থেকেই ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট শুরু করেন এবং এসোসিয়েশন অব প্যাট্রিয়টিক উইমেন অব কুর্দিস্তানের পত্তন ঘটান। এই গ্রুপটিই পুরুষের সহিংসতার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলে পরবর্তিতে। এই মুভমেন্টে নারীরা তখন আরও একটি জনপ্রিয় ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট শুরু করেন। আর তাহলো পুরুষের জন্য ফেমিনিস্ট এডুকেশন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গসমতার প্রশ্নে যে অসমতা রয়েছে, সে ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিই ছিল এই এডুকেশনের মূল উপজীব্য।
লাল সালাম সারা, কুর্দি জনগোষ্ঠীর প্রিয় নারী, আপনার হত্যা নারীমুক্তির সংগ্রামকে শেষ করে দিতে পারেনি।