আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিদ্রোহীদের বিদ্যুৎগতির আক্রমণে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের ‘দুঃশাসন’ অবসানের পর মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য নতুন রূপ নেবে।
বিবিসি-র মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা হুগো বাচেগা এমন বিশ্লেষণ তুলে ধরে বলেছেন, সিরিয়ার এ নাটকীয় পট পরিবর্তনের ফলে সেখানে ক্ষমতায় বিপজ্জনক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা এবং আরও সহিংসতার জন্ম দেবে। এক সপ্তাহ আগে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইদলিবের ঘাঁটি থেকে যখন বিদ্রোহীরা হঠাৎ আবার হামলা শুরু করেছিল তখনও আসাদ সরকারের পতন অচিন্তনীয় ছিল। এই হামলাই ছিল সিরিয়ার ইতিহাসের বাঁক বদলের সূচনা।
২০০০ সালের পর বাবা হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন বাশার আল আসাদ। ছেলের মতো হাফিজ আল আসাদও ছিলেন কঠোর শাসক। তিনি ২৯ বছর সিরিয়া শাসন করেছিলেন। বাশারও বাবার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও দমনমূলক রাজনৈতিক কাঠামো বজায় রেখেছিলেন। যদিও ক্ষমতাগ্রহণের পর সিরিয়ার মানুষ আশা করেছিল তিনি আলাদা মনোভাবের হতে পারেন, ঠিক বাবার মতো নয়। হবেন অনেক বেশি খোলামেলা এবং কম নৃশংস। কিন্তু মানুষের সেই আশা ছিল স্বল্পস্থায়ী। ২০১১ সালে বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নৃশংসভাবে দমন করার কারণে আসাদকে সিরিয়ার মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। কারণ, এরপরই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এ ছাড়া আরো ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়েছে। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে বাশার বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দিয়ে এতোদিন ক্ষমতায় টিকেছিলেন। রাশিয়া তার প্রতাপশালী বিমানবাহিনী ব্যবহার করেছে, ইরান সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে। আর প্রতিবেশী লেবাননের হিজবুল্লাহ সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধা পাঠিয়েছে আসাদ বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু এবার মিত্রদের তেমন কোনও সহায়তাই পায়নি আসাদ সরকার। কারণ মিত্ররা তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত এখন। রাশিয়া ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরুর পর সেখানে যুদ্ধ করছে। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে গতবছর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, যা এখনো চলছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানেরও পাল্টাপাল্টি কিছু হামলা হয়েছে। এরপর ইরান ইসরায়েলকে মোকাবেলা করা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সিরিয়ায় নতুন সংঘাতে সরাসরি জড়াতে চায়নি। মিত্রদের সহায়তা না পাওয়ায় ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠি হায়াত তাহরির আল-শাম এর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যত কোথাও কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি আসাদের সেনারা। আবার কোথাও কোথাও বাধা না দিয়ে তারা পালিয়ে গেছে। গত সপ্তাহে বিদ্রোহী বাহিনী কোনও রকম প্রতিরোধের মুখে না পড়েই প্রথমে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী আলেপ্পো দখল করে নেয়। তারপর হামা এবং কয়েক দিন পর হোমস নগরী দখল করে নেওয়ায় রাজধানী দামেস্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দামেস্ক দখল করে নিতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। বিদ্রোহী যোদ্ধারা দামেস্কে ঢোকার সময়ই ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। এর মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের ৫ দশকের শাসনের ইতি ঘটায় মধ্যপ্রাচে ক্ষমতার ভারসাম্য এখন নতুন রূপ পাবে। সিরিয়ায় আসাদের পতন ইরানের জন্য বড়সড়ো ধাক্কাই। কারণ আসাদের সময় ইরান ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যোগাযোগের অংশ ছিল সিরিয়া। হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে সিরিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলের সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে যুদ্ধে হিজবুল্লাহও দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তাদের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধারও বার বার বিমান হামলার শিকার হয়েছে। ইরাকের মিলিশিয়া ও গাজার হামাস যোদ্ধাসহ এসব গোষ্ঠীকে ইরান প্রতিরোধের অক্ষ মনে করে, যারা এখন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। ইরানের মিত্রদের এমন বিপর্যয় ইসরায়েল উদযাপন করতেই পারে, কারণ তারা ইরানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে।
সিরিয়ায় বিদ্রোহী বাহিনীর এ বিজয় তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব হত না বলে মনে করেন অনেকে। কারণ দেশটি সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠিকে সমর্থন করে। তবে তুরস্ক হায়াত তাহরিরকে সহায়তা করার কথা অস্বীকার করেছে। কখনো কখনো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান আলোচনার মধ্য দিয়ে বিরোধ মীমাংসার আহ্বান জানিয়েছেন। তুরস্কের মাথা ব্যাথার কারণ ওই দেশে আশ্রয় নেওয়া ৩০ লাখ সিরীয় শরণার্থী। তুরস্কে এটি স্পর্শকাতর একটি সমস্যা। তাই এরদোয়ান কূটনৈতিক সমাধান আশা করছিলেন, যাতে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো যায়। কিন্তু বাশার আল আসাদ বরাবরই আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আসাদ পরিবারের বিদায়ে সিরিয়ার মানুষ খুশি। কিন্তু ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কারণ বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্ব যাদের হাতে সেই হায়াত তাহরিরের শিকড় আল কায়দার জমিনে এবং এ গোষ্ঠীর রয়েছে সহিংসতায় ভরা অতীত। যদিও গত কয়েক বছর ধরে তারা জাতীয়তাবাদী হিসেবে জনগণের সামনে নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বক্তব্যে কূটনীতি ও সমঝোতার সুর লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অনেকেই তাদের বিশ্বাস করছে না। আসাদ সরকারকে উৎখাতের পর এখন আবার তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হতে পারে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে।