প্রণব মজুমদার : একেবারেই ভগ্নদশা দেশের পুঁজিবাজারের। অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ বাজারে দুষ্টচক্রের কারসাজিতে যেসব ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তা কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না! মন্দাভাব এখনও বিদ্যমান। বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে কদিন আগে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় পুঁজিবাজারের অবস্থান খুবই নাজুক। পরিসংখ্যান বলছে, বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ৫ ধাপ নেমে দেশের পুঁজিবাজার অবস্থান করছে ৪২তম স্থানে। র্যাংকিংয়ে বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ৫ দশমিক ৬২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বর্তমান বাজার মূলধন সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার ঘরে। দেশের পুঁজিবাজার এখন বাজার মূলধন ও জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে প্রায় ১০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৫, ভিয়েতনামে ৪১, ইন্দোনেশিয়ায় ৪৪, থাইল্যান্ডে ৯১ ও ভারতে ১২০ শতাংশ। বৈশ্বিক সূচকে পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের পুঁজিবাজার।
সমৃদ্ধ অর্থনীতির দুটি শক্তিশালী স্তম্ভ হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং পুঁজিবাজার। দেশের অর্থনীতিতে প্রথমটিতে কিছতা উন্নতি লক্ষ্য করা গেলেও দ্বিতীয়টিতে আমরা বেশ নিস্প্রভ। পুঁজিবাজারের অবনতি বা মন্দাভাব আমাদের দীর্ঘকালের। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা ও বিচারহীনতা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে ভীষণভাবে সংকুচিত ও পঙ্গু করে রেখেছে। তিন দশক ধরে দেখছি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তদের শাস্তি না দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সহযোগী হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক নিজেই দুষ্কৃতকারী বনে গেছে। সুশাসনের পরিবর্তে দিনের পর দিন পুঁজিবাজারকে প্রভাবশালীদের মূলধন লুণ্ঠনের বাজারে পরিণত করা হয়েছে।
দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট আজ থেকে নয়। বাজারে আস্থা সৃষ্টিতে বিগত কোনো সরকারই আন্তরিক ছিল না। ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী কমিটির প্রকাশ করা ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিচার আজও হয়নি। অভিযুক্তরা পুনর্বাসিত হয়েছেন। বিচারের বদলে ‘ক্ষমা’ পেয়ে পুঁজিবাজারের এই লুটপাটকারীরা বরং পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করেছিলেন।
কলঙ্কজনক ওই ঘটনার অভিযুক্ত একজন ছিলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের (ডিএসই) সভাপতি যিনি এখন পৃথিবীতে নেই। রাজধানীর সদরঘাটে সাম্প্রতিককালে নৌকায় ধৃত দেশের পুঁজিবাজারের হোতা ও বড় লুণ্ঠনকারী এখন কারাগারে। শেয়ার কেলেঙ্কারির ওই ঘটনার অভিযুক্ত ছিলেন ৪৫ জন। পুঁজি লুণ্ঠনকারীরা দেশের শেয়ার বাজারকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে গেছেন।
২০১০ সালের দেশের পুঁজিবাজারে পুনরায় কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়। কেলেঙ্কারির সঙ্গে উল্লেখিতরাও জড়িত ছিল। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা নিয়ে তখন সরকারের ‘মেলোড্রামা’ মঞ্চস্থ হয়! কমিটির প্রধান সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে অপ্রত্যাশিত এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়!
দেশের ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতকে টেনে তোলার জন্য সংস্কারমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বতী সরকার। কিন্তু পুঁজিবাজারের ক্ষত নিরাময় করতে কার্যকর বড় চিকিৎসা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নতুন কমিশন গঠিত হয়েছে এরই মধ্যে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) বোর্ড পুনর্গঠন হয়েছে। পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য টাস্কফোর্স হয়েছে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। সবাই একসঙ্গে কাজ করলেও বাজারের বর্তমান দুর্দশা থেকে খুব দ্রুত বের হয়ে আসা সম্ভব নয়।
পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করছে তাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা তৈরিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও বাজার নজরদারির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।
অতীতে নীতিগত রূপরেখার একটি বড় সমস্যা লক্ষণীয়। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাজারের দৈনন্দিন কার্যক্রম বা বাজার উন্নয়নে অযাচিতভাবে জড়িত হয়ে পড়ছে। ফলে নিয়ন্ত্রক বিতর্কিত হচ্ছে এবং সংস্কার উদ্যোগগুলো অকার্যকর থেকে যাচ্ছে। তাই বাজার ব্যবস্থায় বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর ভূমিকা কী হবে তা নির্ধারণের সময় এসেছে। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সফল অভিজ্ঞতা অনুসরণ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদে বাজারের আস্থা কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এ জন্য কিছু নীতি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের একাংশের অযৌক্তিক দাবি দাওয়া এবং সেসবের প্রতি বাজারের মৌল ভিত্তির বাইরে এসে অ্যাডহক ভিত্তিতে কার্যক্রমে যাওয়া থেকে নিয়ন্ত্রককে বিরত থাকতে হবে। তা না হলে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাদের আর ফেরানো যাবে না। চরম তারল্য সংকটে গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজারে সূচক ও বাজার মূলধনেও ব্যাপক পতন হয়েছে। তা দূর করতে কাজ করছে গঠিত টাস্কফোর্স।
পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হলেও নানা সীমাবদ্ধতায় তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বারবার। পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও নানা অনিয়ম-অদক্ষতায় সংকুচিত হয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুসংগঠিত পুঁজিবাজার অপরিহার্য হলেও তা এখনো গড়ে ওঠেনি।
টাস্কফোর্সের একজন সদস্য অধ্যাপক আল-আমিনের মতে, বাজারকে আস্থার জায়গায় নিয়ে আসা কঠিন কাজ। আমাদের পুঁজিবাজারের বড় সংকট হলো আস্থা, তারল্য সংকটও বিদ্যমান।
সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে। কালক্ষেপণ আর নয়। আমীরুল ও খালেদ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অপরাধীদের যোগ্য বিচারসহ কমিটির সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার জোর পরামর্শ দেই সরকারকে। তা করা গেলে দেশের পুঁজিবাজারে আস্থা বা বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব। কেননা পুঁজিবাজার দেশের তৃণমূলে এখন বিস্তৃত।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সম্প্রতি অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে। পুঁজিবাজারের অবস্থা অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই রুগ্ন, কিন্তু এই রুগ্নতা অসাড়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন অব্যাহতভাবে অবদমিত হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ক্ষণিকের জন্য ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হলেও নিমেষেই ওই গতির দিক পরিবর্তিত হয়ে বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্তকরণের প্রয়াস চালাচ্ছে। পুঁজিবাজারে সক্রিয় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বাস্ত। কয়েকজন বিনিয়োগকারী এ জন্য আত্মহননের পথও বেছে নিয়েছিলেন।
দেশের পুঁজিবাজারের ভগ্নদশা উত্তরণকল্পে দুটি পদক্ষেপ বেশ পরিলক্ষিত। প্রথমটি হচ্ছে শেয়ার মূল্যের পরিবর্তনের উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়া। শেয়ার বাজারে মূল্য পরিবর্তনের সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রচলন বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে এবং এটি প্রচলিত কয়েক ধরনের সার্কিট ব্রেকারের মধ্যে একটি।
শেয়ার বাজারে যদি হঠাৎ ব্যাপক মূল্য পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে স্বল্প সময়ের জন্য সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করে শেয়ার বাজারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সার্কিট ব্রেকার সাধারণত ব্যবহার করা হয় বিশেষ সময়ের বিশেষ অবস্থা প্রতিরোধ করার জন্য।
বাজার অর্থনীতির বেসরকারিকরণের যুগে দেশে অর্থনীতি উন্নয়নে সমৃদ্ধ পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই। মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সুবিশাল বেকার সমস্যার সমাধানের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা জরুরি। পুঁজিবাজার হতে পারে ওইরকম একটি ক্ষেত্র। আস্থার সংকটে সত্যিকারের লাভজনক কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত পুঁজির জন্য বাজারে আসতে পারছে না।
গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তাদের বাজারে আনার ব্যবস্থা করা উচিত। যেসব পদক্ষেপ দেশের পুঁজিবাজারে আস্থা পুনরুদ্ধার হতে পারে তা হলোÑ
১. দেশের পুঁজিবাজারে কার্যরত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো যেমন আর্থিক খাতের সকল নিয়ন্ত্রক, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) শেয়ার বাজার দুটিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর, বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
২. সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ক্রেডিট রেটিং, সিএ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস) ফার্মকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।
৩. কোম্পানি আইন জানা অভিজ্ঞ বিচারগণের দ্বারা গঠিত পৃথক আদালতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের উপযুক্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. অবিলম্বে প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯৬, ২০২০ সালসহ সকল শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় চিহ্নিতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
৫. দেশের পুঁজিবাজারকে সরকারি রাজনৈতিক দল এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে।
লেখক: সম্পাদক, অর্থকাগজ