সালেহ উদ্দিন আহমদ : বাংলা একাডেমির সভা ও সেমিনারে পণ্ডিতদের কথা শুনতে খুব ভালো লাগত আমার। প্রায়ই যেতাম, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। মুনীর চৌধুরী এক সেমিনারে বলেছিলেন, এতকাল পরেও কথাটা হুবহু মনে আছে, ‘সব সত্য ঘটনা নিয়ে গল্প লেখা যায় না, আবার কোনো কোনো ঘটনা আছে, যেগুলো নিয়ে গল্প না লিখে পারা যায় না।’
তেমনি একটা ঘটনা ইমদু কাহিনী, সত্তরের দশক থেকে আশির দশকেও বিস্তৃত। আমি তখনও দেশে ছিলাম, ইমদুকে নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ। কোনো কোনো পত্রিকা অফিসে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম, তারা তো পত্রিকায় প্রকাশের জন্য খবরটা যতটুকু লিখতে পারত, জানত তার চেয়ে অনেক বেশি। এই ঘটনা এখনও এই জন্য প্রাসঙ্গিক যে, আমাদের দেশে সন্ত্রাস ও রাজনীতির মিশ্রণ, তখনও যেমন বড় সমস্যা ছিল, এখনও তেমনটাই আছে। এর প্রতিকার প্রয়োজন।
আমার হঠাৎ করে ইমদু কাহিনী মনে এল অন্য একটা কারণে। আসছে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমার একটা গল্পের বই প্রকাশ পাচ্ছে নাম– ‘বেচু সরাদারের ট্রুথ কমিশন’। সেখানে একটা গল্প আছে, ‘এয়ী’। ‘ত্রয়ী’র প্রধান চরিত্র, বারুলিয়ার ইমদু। এই ইমদুকে নিয়ে গল্প লিখতে গিয়ে আমার মনে পড়ল আরেক ইমদুর কথা, কালীগঞ্জের ইমদু। বই প্রকাশের আগে বারুলিয়ার ইমদুকে নিয়ে কিছু লিখতে চাই না। কিন্তু কালীগঞ্জের ইমদু কাহিনী তারচেয়েও কম আকর্ষণীয় নয়, যেমনটা মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো ঘটনা আছে, যেগুলো নিয়ে গল্প না লিখে পারা যায় না’ তেমন। আমি অবশ্য গল্প নয় বাস্তবের ইমদুর কথাই লিখছি এখানে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কতিপয় সেনা অফিসারের হাতে নিহত হন ১৯৮১ সালের ৩০ মে। এরপর রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তিনিও জিয়াউর রহমানের দ্বারা গঠিত বিএনপির দলীয় লোক।
মিন্টো রোডে মন্ত্রীদের পাড়ায় চল্লিশ নম্বর বাড়িটি ছিল বিএনপি সরকারের যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন। ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর হওয়ার আগেই বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ বাড়িটি ঘিরে ফেলল। দারুণ তাজ্জব কাণ্ড, বিএনপি সরকারের একজন মন্ত্রীর বাড়ি কেন সরকারি পুলিশ ঘেরাও করবে? তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আবদুল মতিন।
জানা গেল সেখানে মন্ত্রী আবুল কাশেমের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকেন একজন দুর্দান্ত সন্ত্রাসী। তার নাম এমদাদুল হক ইমদু, বাড়ি কালীগঞ্জের সাতানীপাড়া গ্রামে।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সালÑ এই পাঁচ বছর ইমদু অপ্রতিরোধ্য গতিতে সন্ত্রাস চালিয়েছেন কালীগঞ্জ-গাজীপুর ও ঢাকা শহরে। তার সন্ত্রাসের কোনো সীমারেখা ছিল না; যেখানেই তার প্রতিপক্ষ সেখানেই ইমদুর বন্দুকের নল। সে রাজনীতিও করত, প্রথমে জাসদ, পরবর্তীকালে যোগ দেয় বিএনপিতে। জাসদ বা বিএনপির রাজনীতি যেখানেই হোক, তার সন্ত্রাস ও নৃশংসতায় কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি কেউ। সে রাজনীতি করত সন্ত্রাসের জন্য আবার সন্ত্রাস করত রাজনীতির জন্য।
কালীগঞ্জের জাসদ নেতা আলী হোসেন তালুকদারের সঙ্গে যখন তার মতবিরোধ তৈরি হয়, তারপরই শুরু হয় খুনোখুনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আলী হোসেনের সঙ্গে ইমদুর দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে, মাঝে মাঝে চেষ্টা হতো রফাদফার। এর মধ্যে ইমদুকে জাসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর সে যোগ দেয় বিএনপিতে।
১৯৮১ সালে আলী হোসেন খুন হন ইমদুর হাতে ঢাকা শহরের তেজগাঁও রেলস্টেশনের এক বাসায়; যেখানে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। কালীগঞ্জ থেকে দূরে এসে নিজেকে বেশ নিরাপদ ভাবছিলেন তিনি। এরই আগে-পরে আরও কত লোক যে খুন হলেন ইমদুর হাতে! ২২টি খুনের আসামি ছিলেন ইমদু। পুলিশ মাঝে মধ্যে চেষ্টা করেছে তাকে ধরতে। কিন্তু তার রাজনৈতিক খুঁটি এতই শক্ত ছিল যে, পুলিশের সাধ্য ছিল না তা ডিঙিয়ে তাকে ধরা।
জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি, পুবাইল রেলস্টেশনের কাছে তার একটা জনসভা ছিল। ওই সভামঞ্চে ছিলেন মাত্র দুজন মানুষÑ জিয়াউর রহমান ও এমদাদুল হক ইমদু। বিএনপির বড় বড় নেতা ও মন্ত্রীরা সবাই ছিলেন মঞ্চের নিচে সাধারণ মানুষের কাতারে। বিএনপির অন্য এক জনসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখা যায় নিজের গলার মালা ইমদুকে পরিয়ে দিতে। এ ঘটনাগুলোর সবই তখনকার পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ পেয়েছিল।
১৯৮১ সালে কালীগঞ্জে আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটে ইমদু বাহিনীর হাতে। ইমদু খুন করে কালীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আওয়াল ভূঁইয়াকে। তারপর আওয়ালের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি বা বাইরের জগতের কেউই জানত না তাদের খবর। যারা ভেতরের খবর জানতেন তারা বলতেন, ইমদু আওয়ালের স্ত্রীকে নিয়ে ঘর সংসার করতেন এবং তার দুই সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো আদর যত্ন করতেন।
জিয়াউর রাহমানের মৃত্যুর পর, যখন বিচারপতি সাত্তার ক্ষমতা নিলেন, তখনই এটা স্পষ্ট ছিল, এরশাদ ক্ষমতা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ক্ষমতার কলকাঠির অনেক কিছুই এরশাদই নাড়াতেন। বেগম জিয়া তখনও রাজনৈতিক মঞ্চে আসেননি।
সাত্তার সরকার দেশের অবস্থা সামাল দিতে পারছিলেন না, জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সত্তার সরকার সিদ্ধান্ত নিল, নিজেদের ভাবমূর্তি ভালো করতে ইমদুকে ধরে জেলে পুরতে হবে। মন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়ি তিনদিন ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল ইমদুকে ধরতে। তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল, এতই শক্ত ছিল ইমদুর রাজনৈতিক শেকড়। রাষ্ট্রপতি সাত্তার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন আবুল কাশেমের সঙ্গে, শক্ত করে বললেন কাশেম যেন তার বাড়ির আশ্রয় থেকে ইমদুকে বের দেন। তারপর ইমদু আত্মসমর্পন করে।
ইমদু গ্রেফতার হবার পর ১৯৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি একদল উচপদস্থ সেনা অফিসার রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে চাপ দেয়। সাত্তার ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেন। ইমদুর ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাগুলো দিনের পর দিন খবর ছাপাতে থাকে, জনগণের আগ্রহও ছিল তুঙ্গে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন। তিনি যে ইমদু কাহিনীর সুযোগ নিয়েছিলেন তা তার বক্তৃতায় স্পষ্ট ছিল, ইমদুর ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘সীমাহীন দুর্নীতির ফলে দেশে এমন এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তার সরকারি বাসভবনে একজন ঘৃণ্য খুনি আসামিকে আশ্রয়দান করতে দ্বিধাবোধ করে নাই। আপনারা জানিয়া বিস্মিত হবেন যে, এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা যাতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হয়, সে জন্য সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ সেদিন যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন।’
এরশাদ যখন সামরিক শাসন জারি করে দেশ চালাচ্ছিলেন, তখন সামরিক আদালতেই ইমদুর বিচার হলো। ইমদুর ফাঁসি হয়ে গেল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, ১৯৮২ সালের ৪ অগাস্ট।
ইমদুর কাহিনী তখনই শেষ হতে পারত, কিন্তু রাজনীতির কাহিনী কি এত সহজে শেষ হয়? সন্ত্রাসের গল্প শেষ হলেও এর রাজনীতির গল্প অনেকদিন ধরেই চলল। যেসব সরকারি কর্মচারী ও পুলিশ কর্মকর্তা ইমদুকে ধরতে কাজ করেছিলেন তারা বিবৃতি, সাক্ষাৎকার ও বইপত্র লিখে নিজেদের অবদান জাহির করলেন।
ইমদুর উত্থান ও পতনের সঙ্গে বিএনপি রাজনীতির মেরুকরণ এবং ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক বিষয় বলতে গেলে অপরটা না বলে পারা যায় না।
ইমদুর পতনের পরও রাজনীতিবিদদের মধ্যে ইমদুকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলতেই থাকল। অনেকেই বললেন ষড়যন্ত্রের কথা, ইমদুকে ধরিয়ে সরকারকে নাজেহাল করার কথা। মওদুদ আহমেদ ছিলেন তখনকার রাজনীতির একজন প্রবাভশালী লোক। তিনি বলেছেন বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল ও ষড়যন্ত্র নিয়ে। ‘চলমান ইতিহাস’ বইয়ে তিনি ইমদু আটকের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, ‘সাত্তারের মন্ত্রিসভার দুটি গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করে। জামালউদ্দিন আর হাসনাতকে টার্গেট করা হলো— দেশের মধ্যে যেন শুধু তারাই দুর্নীতিবাজ। একই চক্রান্তের ফলে আবুল কাশেমের বাড়ি থেকে খুনের আসামি ইমদাদুল হক ইমদুকে পাওয়া গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিনের সঙ্গে কাশেমের মনোমালিন্য ছিল.ৃমতিন ছিলেন শাহ আজিজের গ্রুপের সদস্য, আর কাশেম ছিলেন জামালউদ্দিন-হাসনাত গ্রুপের।’
জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর বেগম খালেদা জিয়া অনেকটা ছিলেন রাজনীতিবিমুখ। তাছাড়া তখন অনেকেই চাইত না বেগম জিয়া রাজনীতিতে আসুন। মওদুদ সাহেব তার বইতে লিখেছেন, তিনি দলের চেয়ারম্যান হোন এটি সামরিক নেতারা, দুই গোয়েন্দা বিভাগ এবং মন্ত্রিসভার দুই গ্রুপ— কেউই চায়নি। তাই বিচারপতি সত্তারই হলেন বিএনপির চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারণের পর বিচারপতি সাত্তার বিএনপি রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেন। বিএনপির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারানোর সব গ্লানি তাকেই বহন করতে হলো। বেগম জিয়াও তার ওপর খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন।
বিচারপতি সাত্তার ১৯৮৪ সালের জানুয়ারির ১৩ তারিখ বিএনপি প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর বেগম খালেদা জিয়া হন বিএনপির চেয়ারপারসন। অনেক রাজনৈতিক নেতাই যেমন মওদুদ আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ, পরে দাবি করেছেন তারাই বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে আসতে প্রভাবিত করেছিলেন। আমার বন্ধু বর্তমানে প্রয়াত, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, আমি তাকে ডাকতাম ‘রাজনীতির অ্যান্টেনা’, রাজনীতির সব খবর তার কাছে কেমন করে যেন আগেভাগে চলে আসত। সে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বিবিসি বাংলাকে বলেছিল, খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম শিশু এবং একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। যার যাই ভূমিকা হোক না কেন, বেগম খালেদা জিয়া গত চল্লিশ বছর ধরে বিএনপির চেয়ারপারসন।
অনেকের কাছে ইমদু কাহিনী সন্ত্রাসের গল্প, আবার অনেকের কাছে এটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের গল্প। যে যেভাবেই দেখুন না কেন, ইমদু কাহিনী হলো সন্ত্রাস ও রাজনীতির গাঁট্টাগোট্টা গল্প।
লেখক: কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক