চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে কারাগারে প্রেরণে বাধা দেওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট সংঘর্ষে চট্টগ্রাম আদালতের এক শিক্ষানবিশ আইনজীবী নিহত হয়েছেন। এ সময় অনেকে আহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নিবেদিতা ঘোষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহত আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম আলিফ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভরত লোকজন আদালত চত্বরে প্রায় তিন ঘণ্টা পুলিশের প্রিজনভ্যান আটকে রাখেন। পরে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ লাটিচার্জ করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে অবস্থান নেন। আদালত প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে আইনজীবী ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর সমর্থকরা একে অন্যকে লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করেন। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অনেকে আহত হন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের হামলায় গুরুতর আহত হন শিক্ষানবিশ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। তাকে সহকর্মীরা উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম আলিফকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ ঐক্যজোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম তার জামিন নামঞ্জুর করেন। একইসঙ্গে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। তার অন্যতম আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ জানান, ‘এই মামলা ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক। আমরা আজ জামিন আবেদন করেছি। শুনানি শেষে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। আমরা কারাগারে ওনার ডিভিশন ও ধর্মীয় বিধান পালনের দুটি আবেদন করেছিলাম। আবেদন দুটি মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজকের আদেশে আমরা সংক্ষুব্ধ। আগামীকালই আবার জামিনের আবেদন করব।’ এদিকে, জামিন আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় চিন্ময় দাশের ক্ষুব্ধ অনুসারীরা আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন। এর আগে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে তাকে আদালতে হাজির করা হয়।
প্রসঙ্গত, জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে হওয়া মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে গত সোমবার রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মঙ্গলবার ভোরে তাকে চট্টগ্রাম আনার পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর সকাল ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে নেওয়া হয়। দুপুর ১২টার দিকে জামিন আবেদন না মঞ্জর করে ৬ষ্ঠ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালত চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে জনসভার পর ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়, সেখানে চিন্ময় দাশকেও আসামি করা হয়।
‘শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপে’ ইসকন থেকে জুলাইয়ে বহিষ্কার চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ: রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের কারণে গত জুলাই মাসে বহিষ্কার করেছিল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণবানামৃত সংঘ (ইসকন)।
চট্টগ্রামের হাজারি গলির ঘটনা প্রসঙ্গে গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর স্বামীবাগ ইসকন আশ্রমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাশ ব্রহ্মচারী একথা জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, গত জুলাইয়ে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইসকনের যাবতীয় কার্যক্রম থেকে চট্টগ্রামের পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ, প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌরদাশ ও সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাশকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীসহ বহিষ্কৃতদের মাধ্যমে সংঘটিত কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে ইসকন জড়িত নয় বলেও দাবি করেছিলেন চারু চন্দ্র দাশ ব্রহ্মচারী। সেদিন তিনি এ-ও বলেছিলেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সহিংসতার মতো বেআইনি কাজের সঙ্গে ইসকনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
সাম্প্রতিক সময়ে সনাতনীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বক্তব্যের জন্য ব্যাপক আলোচিত চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী সদ্য গড়ে তোলা বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাংলাদেশে ইসকনের সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে ভক্তরা ‘চিন্ময় প্রভু’ নামে ডাকেন। গত সোমবার (২৫ নভেম্বর) ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারের পর নিন্দা জানিয়ে বিভিন্ন সনাতনী সংগঠন বিবৃতি দিলেও নীরব রয়েছে ইসকন বাংলাদেশ। এদিকে গ্রেপ্তারের পর চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বেলা ১১টার দিকে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে বেলা পৌনে ১২টার দিকে শুনানি শেষে চিন্ময় কৃষ্ণকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে মহাসমাবেশ করে। ওই সমাবেশে চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলা থেকে হাজারো মানুষ যোগ দেন। ওইদিন নিউমার্কেট মোড়ের জিরো পয়েন্ট স্তম্ভ ও আশপাশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপর ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা স্থাপন করা হয়। এ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় ৩১ অক্টোবর বিএনপি নেতা ফিরোজ খান (পরে বহিষ্কৃত) বাদী হয়ে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় চিন্ময় দাশসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পরই দুজনকে রাজেশ চৌধুরী ও হৃদয় দাশ নামে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ সোমবার গ্রেপ্তার হয়ে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) কারাবরণ করেন চিন্ময় দাশ ব্রহ্মচারী।