নাটোর সংবাদদাতা: একটা সময় নাটোরের গ্রামাঞ্চলের আনাচে-কানাচে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকত কৃষিজমির পাশের জলমগ্ন জমি। বর্ষাকাল ছাড়াও বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমে থাকায় সেখানে কোনো চাষ হতো না বললেই চলে। এখন ওই জলমগ্ন পতিত জমিতেই বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে পানিফল। ফলে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। এর পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবেই ওই জমি থেকে পাওয়া যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। আবার পানিফল চাষের সঙ্গে একই জমিতে মাছ চাষও করছেন কেউ কেউ। ফলে জলমগ্ন এসব পতিত জমি কৃষকদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এক বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা দেওয়া হলে পানিফল চাষ আরও লাভজনক হবে বলে মনে করছেন চাষিরা।
কৃষি বিভাগ জানায়, দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোসহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে দেশের কোনো জমি আর পতিত রাখা যাবে না। জমিগুলোয় কৃষিকাজের জন্য সময়োপযোগী ফসল চাষের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কৃষি অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হবে দেশ। এ জন্য কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এবার জলমগ্ন ১০ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে। তবে জেলার সদর উপজেলা, নলডাঙ্গা, সিংড়া ও গুরদাসপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পানিফল চাষ হয়েছে। অন্যান্য উপজেলায় একটু কম চাষ হয়েছে।
জলমগ্ন এসব জমিতে প্রায় সারা বছর পানি জমে থাকে। এসব জমিতে জ্যৈষ্ঠ মাসে পানিফলের চারা রোপণ করা হয়। চার মাস পর থেকে ফল আসা শুরু হয় এবং আশ্বিন মাসের প্রথম দিকে ফল তুলে বিক্রি করা শুরু হয়। পানিফল চাষ প্রক্রিয়া সহজ এবং উৎপাদন খরচও কম। ঠিকমতো ফসলের পরিচর্যা করা হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ মণ ফলন পাওয়া যায়।
জেলার সদর ও সিংড়া উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, কেউ গাছ থেকে ফল তুলতে ব্যস্ত, কেউ কেউ ফসল পরিচর্যা ও বালাইনাশক দিচ্ছেন, কেউ বা বিভিন্ন সড়কের পাশে বসে পানিফল বিক্রি করছেন। আর শহরের বাজারগুলোতে পানিফলের চাহিদাও বেশ লক্ষ্য করা গেছে। গ্রাম এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা ও শহরাঞ্চলে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে পানিফল। পাইকারি বাজারে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ক্রেতারা ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা মণ পানিফল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
সদর উপজেলার বরভিটা-দিয়ারভিটা গ্রামের কৃষক হজরত আলী বলেন, এ বছর চার বিঘা জমিতে পানিফলের চাষ করেছি। চারা রোপণের চার মাস পর ফল আসতে শুরু হয়েছে। এক থেকে দুই দিন পর পর দুই মণ করে পানিফল তুলি। পরে স্থানীয় বাজার এবং জমিতেই এসব পানিফল পাইকারি ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। আর স্থানীয় বাজারে খুচরা বিক্রি করছি কেজি প্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। পানিফল চাষ মোটামুটি লাভজনক।
একই এলাকার আরেক কৃষক মো. আসাদ জানান, বর্ষাকালে বিঘা প্রতি ১২০০ টাকায় জমি লিজ নিয়ে পানিফল চাষ করেছেন তিনি। এ ফল চাষে বিঘা প্রতি তার খরচ হয়েছে প্রায় নয় থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতিদিন তিনি ৩০ থেকে ৪০ কেজি করে পানিফল তুলে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, সাধারণত পানিফলের বিঘা প্রতি ফলন হয় ২০ থেকে ২৫ মণ। কোনো কোনো সময় আরও বেশি ফলন হয়। খরচ বাদে প্রতি বিঘায় পানিফল বিক্রি করে লাভ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এছাড়া জলমগ্ন জমিতে পানিফলের পাশাপাশি মাছও চাষ করা যায়। তা না করা হলেও প্রাকৃতিকভাবেই দেশীয় প্রজাতির হরেক রকম মাছ পাওয়া যায়। যা পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে বাজারজাতও করা যায়। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি জলমগ্ন এসব জমিতে পানিফল চাষ করে আসছেন। সঙ্গে মাছও চাষ করছেন। ভবিষ্যতে পানিফল চাষের পরিধি আরও বাড়াতে চান।
দিয়ারভিটা গ্রামের কৃষক মো. আক্তার হোসেন জানান, চার বিঘা জমিতে এবার তিনি পানিফল চাষ করেছেন। পরিচর্যা, বালাইনাশক ভিটামিন ছাড়া তেমন একটা খরচ নেই। এ ফসল চাষে কোনো রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। গত ১০ বছর ধরে বোনা আমন ধান চাষের পাশাপাশি জলমগ্ন পতিত জমি ও পানিতে নিমজ্জিত নিচু জমিতে পানিফল চাষ করে আসছেন তিনি। তার এ চাষ দেখে এলাকার অনেকেই এখন পানিফল চাষ করছেন। তার মতে শুধু দিয়ারভিটা গ্রামের ভেদরার বিলে ৩০ থেকে ৩৫ জন চাষি পানিফল চাষ করছেন।
কৃষক শরিফুল ইসলাম, হাবলু, রমজান আলী, আমিন ও রহিম জানান, তারা প্রত্যেকে দুই থেকে তিন বিঘা করে জমিতে পানিফলের চাষ করেছেন। এভাবে তারা গত সাত-আট বছর ধরে পানিফল চাষ করছেন। পানিফল চাষে খরচ ও পরিশ্রম দুটোই কম। এছাড়া বর্ষাকালে অবসর সময় কাটে। এ কাজে শ্রমিক তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। নিজেরাই করা যায়, পাশাপাশি দুই -একজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করা যায়। অনেকে পুকুরেও পানিফল চাষ করছেন।
স্থানীয় শ্রমিক মো. সুকেল জানান, পানিফল চাষের কারণে এ এলাকার অন্তত ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এজন্য প্রতিজন শ্রমিক দিনে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক ও ১০০ টাকা খাওয়া বাবদ পেয়ে থাকেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তারা এ কাজে নিয়োজিত থাকেন। একই কথা জানালেন হাপু নামে অপর এক শ্রমিক।
অন্যদিকে সিংড়া উপজেলার কৈগ্রামের কৃষকরা জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম পানিফলের চাষ শুরু করেন এ গ্রামের কৃষক রইচ উদ্দিন (৬১)। তার সফলতা দেখে এ গ্রামের অনেকেই ঝুঁকে পড়েন পানিফল চাষে।
কৃষক রইচ উদ্দিন জানান, দুই যুগ ধরে এ গ্রামের অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন কৃষক জলমগ্ন পতিত জমি, পুকুর ডোবা ও নালায় পানিফলের চাষ করে আসছেন। এছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় যেসব জমি পানিতে তলিয়ে থাকে, এমন জমিতে পানিফল চাষ করা যায়। তিনি বলেন, শীতের শুরুতে পানিফলের চাহিদা বেশি থাকে। তিন মাস এ ফল পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতি মণ পানিফল ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। আগে শখের বসে পানিফল চাষ করেছেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই।
সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ খন্দকার ফরিদ বলেন, সিংড়া উপজেলার রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়নের কৈগ্রামসহ পৌরসভার চক সিংড়া, সোহাগ বাড়ি, তাজপুর, কলম এবং শেরকোল ইউনিয়নের পতিত ও নিচু জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কৃষকরা পানিফল চাষ করছেন। এতে খরচ ও পরিশ্রম কম, লাভ বেশি। এছাড়া এ ফল চাষে রোগবালাই নাই বললেই চলে। তাই পানিফল চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। উপজেলা কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকদের পাশে থেকে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, পানিফল একটি স্বল্প মেয়াদি অর্থকরী ফসল। এ ফসলে পোকার উপদ্রব কম হয়। চাষে ফলন ভালো হয়, দামও অনেক বেশি এবং বাজারে এর বেশ চাহিদা রয়েছে। এর পাশাপাশি খেতেও অনেক সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ রয়েছে। এ ফল মানুষের পানি শূন্যতা দূর করে। এজন্য এ পানিফল চাষে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। তিনি বলেন, সাধারণত পুকুর, ডোবা-নালায় যেখানে ধান ও মাছ চাষ হয় না। সেখানে পানিফল চাষ করে সহজেই একজন কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। নাটোর জেলায় পানিফল চাষে কৃষকরা সফলতা পেয়েছেন। আর পানিফল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ থেকে মাঠ দিবসের মাধ্যমে নানা রকম পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।