বিশেষ সংবাদদাতা :কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) যাদের রয়েছে তাদের জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। তবুও টিআইএনধারীদের অনেকেই রিটার্ন দাখিল করেন না। ফলে করযোগ্য ব্যক্তির আয়কর থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। এ অবস্থায় কর জালের আওতা বাড়াতে ও কর আদায়ে ভোগান্তি কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই অংশ হিসেবে এবার অনলাইনে আয়কর গ্রহণ ও রিটার্ন দাখিলে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি। যদিও ২০২১ সাল থেকে অনলাইনে রিটার্ন জমা নিচ্ছে এনবিআর। তবে তাতেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফলাফল, অর্জন হচ্ছে না রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। প্রায় এক কোটি টিআইএনধারীর মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন দিচ্ছেন মাত্র ৩৬ হাজার জন। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে দক্ষতার অভাব এবং অনভ্যস্ততার কারণে ই-রিটার্নে আগ্রহ কম করদাতাদের। এছাড়া অনলাইনে অভ্যস্ত না হওয়ায় জ্যেষ্ঠ অনেক সরকারি কর্মচারী ই-রিটার্ন দিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। এনবিআরের ওয়েব পেজ লোডিংয়ে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বলেও অভিযোগ অনেকের। কয়েক ধরনের পেশার ক্ষেত্রে ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অটোমেশনের অংশ হিসেবে অনলাইন রিটার্ন থেকে পিছু হটছে না এনবিআর। প্রশিক্ষণ, কল সেন্টার, প্রচারসহ নানান উপায়ে করদাতাদের উদ্ভুদ্ধ করছে রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত সংস্থাটি। এবার ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দেশের সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইল ফোন অপারেটর এবং বেশকিছু বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ই-রিটার্ন জমার সময় সহায়ক কোনো নথি বা কাগজপত্র আপলোড করার বাধ্যবাধকতা দূর করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস অ্যাকাউন্ট) মাধ্যমে কর পরিশোধের ফি কমানো হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন করতে বেগ পেতে হয়েছে। ওয়েব পেজ লোডিং হতে সময় লাগছে। আবার সবকিছু পূরণ করার পর সেভ না হয়ে সাইট চলে গেছে। এভাবে কয়েকবার লগইন করতে হচ্ছে ফরম পূরণ করতে। রিটার্ন জমা দিতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগছে। ই-রিটার্ন জমায় অনলাইনে সমস্যা সমাধানে বসানো হয়েছে কল সেন্টার। এসব উদ্যোগের ফলও ইতিবাচক। গত দুই মাসে প্রায় ৪ লাখ করদাতা অনলাইন রিটার্ন দাখিল করেছেন। তবে তা কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক নয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনে রিটার্ন জমা নেওয়া শুরুর কথা জানায় রাজস্ব বোর্ড।
২০২৩-২৪ করবছরে রিটার্ন জমা পড়েছে ৩৬ লাখ ৬২ হাজার। এর আগে ২০২২-২৩ করবছরে যা ছিল ৩০ লাখ ২৮ হাজার। দেখা যাচ্ছে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে অনলাইনে রিটার্নে জোর দেওয়ার ফলে রিটার্ন জমা বেড়েছে। এনবিআর ২০২১ সালে এই সিস্টেম চালু করার পর ২০২১-২২ করবছরে ৬১ হাজার ৪৯১ জন, ২০২২-২৩ করবছরে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৮১ জন এবং ২০২৩-২৪ কর বছরে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৮৭ জন করদাতা ই-রিটার্ন দাখিল করেন। গত ৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরে আড়াই লাখের বেশি করদাতা ই-রিটার্ন দাখিল করেছেন। তবে অনলাইনে রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে নানান সমস্যায় পড়ছেন করদাতারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইন সিস্টেম নতুন হওয়ায় কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে করদাতাদের। সমস্যার কথা স্বীকার করে সেগুলো সমাধানের কথা জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘করদাতারা নিজেরাই কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এ জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি ট্রেনিং মডিউল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও এনবিআরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।’
যেসব সমস্যায় পড়ছেন করদাতা
অনলাইনে রিটার্ন জমা নিয়ে কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। আয়কর আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেন তিনি। চলতি বছর অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
হাবিবুর রহমান বলেন, রেজিস্ট্রেশন করতে বেগ পেতে হয়েছে। ওয়েব পেজ লোডিং হতে সময় লাগছে। আবার সবকিছু পূরণ করার পর সেভ না হয়ে সাইট চলে গেছে। এভাবে কয়েকবার লগইন করতে হচ্ছে ফরম পূরণ করতে। রিটার্ন জমা দিতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগছে। আশরাফুল নামের করদাতা বলেন, ফরম পূরণ হয়ে গেলে সেটা এডিটের সুযোগে নেই। আবার রিটার্ন রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সিস্টেম এরর দেখায়। কিছু জায়গায় কী লিখতে হবে সেটা স্পষ্ট করা হয়নি। যেমন- একজন পেনশন বইয়ের মাধ্যমে পেনশন পান, এটা কোথায় ইনপুট হবে? আবার সঞ্চয়পত্রের রেজিস্ট্রেশন নম্বর বসানো হলেও সেটা আসে না। এটা গুগল, ফেসবুক বা ইউটিউব না। এখানে সবকিছু বুঝেশুনে লিখতে হয়। সামান্য ভুলেও অনেক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অনেকের বেসিক কম্পিউটার লিটারেসি নেই। টাইপ করতেও জানেন না কেউ কেউ। সেগুনবাগিচার কর অঞ্চল-৮ এ গিয়ে কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহিদ হাসানের সঙ্গে। উত্তরায় এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রিটার্ন জমা দেন জাহিদ। তিনি ১০টি রিটার্ন জমা দিয়েছেন অনলাইনে। জাহিদ হাসান বলেন, যখন সোর্স ট্যাক্সের তথ্য দেবো তখন বেতন ফাইলে বেশ কিছু তথ্য দিতে হয়। বেতন কর্তন হয় প্রতি মাসে। এক বছরে একজন কর্মচারীর ১২টি টিডিএস (যে কোনো বিল পরিশোধের সময় যে কর কেটে নেওয়া হয়) চালান হয়। ধরুন, ৫০ হাজার টাকা সোর্সে দিয়েছি। এক লাইনে সেটা পূরণ করা যাচ্ছে না। ১২ জায়গায় ওই চালানের তথ্য দিতে হচ্ছে। আবার রেফারেন্স নম্বর, ব্যাংকের তথ্য দিতে হচ্ছে। সোর্স ফাইলে আবার এআইটি (অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স) দিতে হয়। সেখানেও প্রচুর তথ্য দিতে হয়। অনলাইনে যতই হাত থাকুক না কেন, একেকটা রিটার্ন ফরম জমা দিতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লাগছে। অথচ ম্যানুয়ালি এক ঘণ্টায় আমরা অন্তত তিনজন করদাতার আয়কর ফাইল পূরণ করতে পারি। অনলাইনে রিটার্ন যাদের বাধ্যতামূলক, তাদের পেপার রিটার্ন না নেওয়ার কথা জানিয়েছে এনবিআর। অনলাইনে অভ্যস্ত না হওয়ায় জ্যেষ্ঠ অনেক সরকারি কর্মচারী রিটার্ন দিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। কর অঞ্চল- ৭ এ কথা হয় সাজিদুল ইসলামের সঙ্গে। শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রায় ২৫ বছর কাজ করছেন তিনি। সাজিদুল ইসলাম বলেন, আমরা অনলাইনে ঢুকতে পারি না। লগইনই করতে পারি না। যারা পারে তারা অনলাইনে (রিটার্ন) দেবে, যারা পারবে না তাদের জন্য হাতে-কলমে রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, এটা গুগল, ফেসবুক বা ইউটিউব না। এখানে সবকিছু বুঝেশুনে লিখতে হয়। সামান্য ভুলেও অনেক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অনেকের বেসিক কম্পিউটার লিটারেসি নেই। টাইপ করতেও জানেন না কেউ কেউ।
এসব বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ইন্টারনেট সংযোগ বা এর ধীরগতি বিষয়টি এনবিআর দেখে না। অনলাইনে রিটার্ন জমায় অভ্যস্ত হতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এটা আবশ্যিক করা হয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে আর পেপার রিটার্ন নেবো না। এছাড়া অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সমস্যা সমাধানে কল সেন্টারের শরণাপন্ন ও এনবিআরের ট্রেনিং মডিউল দেখার আহ্বান জানান তিনি। কর মেলার আদলে গত ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে আয়কর তথ্যসেবা মাস। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের ৪১ কর অঞ্চলের ৮৬৯ সার্কেলে অফিস চলাকালীন নিরবচ্ছিন্ন কর সেবা দেওয়া হচ্ছে করদাতাদের। তবে সরকারি কর্মচারীসহ কয়েক পেশার ক্ষেত্রে অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করায় আয়কর তথ্যসেবা মাসে করদাতার সংখ্যা তুলনামূলক কম। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কর অঞ্চল ৪, ৭, ৮ ও ১২ ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
সেগুনবাগিচায় বিভাগীয় কমিশনার অফিসের সামনে ১২ তলা ভবনে কর অঞ্চল-১ এর অফিস। অন্য কর অঞ্চলের মতো এখানেও ম্যানুয়াল রিটার্ন গ্রহণ বুথ ও হেল্প ডেস্ক স্থাপন করে রিটার্ন নেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে কীভাবে রিটার্ন দাখিল করা যায়, সে বিষয়টি হাতে-কলমে দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। করদাতাদের বসার জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থা। পাশাপাশি রিটার্ন দাখিলে স্থাপন করা হয়েছে একাধিক বুথ। কর অঞ্চল-১ এর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম বলেন, হয়রানি কমিয়ে করদাতাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এনবিআরও করদাতাদের হয়রানি কমাতে চায়। এ জন্য তাদের অনলাইনে যেতে হবে, এর বিকল্প নেই। করদাতারা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিলে হয়রানির অভিযোগ কমে যাবে। পুরাতন এনবিআর অফিসে কর অঞ্চল-৪ এর কার্যালয়। এই কর অঞ্চলের আওতায় রয়েছে মোট ২২ কর সার্কেল। গত ১৪ নভেম্বর বিকেলে সেখানে কয়েকজন করদাতাকে দেখা যায়। এই কার্যালয়ে ২ হাজার ৩৬৮ জন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ও ৭ হাজার ৬২৪ জন অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। অন্য কর অঞ্চলের অফিসগুলোতেও করদাতাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।