গাজীপুর প্রতিনিধি : গাজীপুরে বকেয়া বেতন পরিশোধ ও কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে মহানগরীর বাসন এলাকায় এলাকায় শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। ৩০ ঘণ্টারও বেশি এই অবরোধে ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে টিএনজেড কারখানার আশপাশের ২০টি কারখানা রোববার দুপুরের পর ছুটি ঘোষণা করেছে। গাজীপুর শিল্পপুলিশ-২-এর পুলিশ সুপার (এসপি) সারোয়ার আলম বিকাল সোয়া ৩টায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ছুটি ঘোষণা করা পোশাক কারখানাগুলো হলো-অমিতি সোয়েটার লিমিটেড, সেপাল গ্রুপ, কাশফি নিটওয়্যার লিমিটেড, অ্যামাজিং ফ্যাশন লিমিটেড, ব্র্যান্ডস অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফাইন সোয়েটার লিমিটেড, রোবা ফ্যাশন লিমিটেড, কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেড এবং রভিয়া কম্পোজিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ ২০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। আন্দোলরত শ্রমিকেরা বলেন, ‘বেতন পরিশোধের জন্য বারবার আশ্বাস দিলেও আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে কারখানা মালিক। এখন আমরা আর প্রতারিত হতে চাই না।’
গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২-এর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘শ্রমিকেরা তাদের বকেয়া পরিশোধের দাবিতে শনিবার সকাল থেকে সড়কে অবস্থান করছেন। এখন আর তারা কোনও কথা শুনছেন না। তাদের বেতন না দেওয়া পর্যন্ত তারা সড়কে অবস্থান করবে।’ তিনি বলেন, ‘টিএনজেড পোশাক কারখানার দুজন মালিক। তাদের মধ্যে একজন দেশের বাইরে রয়েছেন। অপরজন বাংলাদেশে ব্যাংকে টাকার জন্য বসে আছেন। টাকা ব্যবস্থা করতে পারলে শ্রমিকদের তাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। বিজিএমইএ, শ্রম অধিদফতর শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে কাজ করছে।’
আন্দোলনে আসা এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর প্রতিনিধিরা বারবার আমাদের বকেয়া বেতন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে আমাদের দাবি মেটানো হয়নি। বাসাভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করতে পারছি না। ঘরে খাবার নেই, সন্তানকে বাবার কাছে রেখে আমি বেতনের দাবিতে সারা রাত সড়কে কাটিয়েছি। গত তিন মাস যাবৎ একটা টাকাও বেতন পাইনি। মালিকের আশ্বাসে এতদিন অপেক্ষা করেছি, আর পারছি না। বকেয়া বেতন না নিয়ে বাসায় ফিরবো না।’
আরেক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্টের কথা বুঝতে পারছি। আমাদের কষ্টের কথাও সবাইকে বুঝতে হবে। আমরা শখ করে গত শনিবার থেকে সড়কে রাত জেগে বসে থাকিনি। আমরা আমাদের বকেয়া বেতন পেলেই অবরোধ তুলে নেবো।’
সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলমান রয়েছে। এ আন্দোলন কবে শেষ হবে জানি না। বিষয়টি নিয়ে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে। একাধিকবার তারিখ দিয়েও মালিক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করছে না। পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও আশ্বাস ও কথা শুনতে নারাজ আন্দোলনরত শ্রমিকরা। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা সড়কেই অবস্থান করবেন বলে জানান।’ গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, ‘শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধের কারণে সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরি¯ি’তি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
৩০ ঘণ্টার শ্রমিক অবরোধে স্থবির গাজীপুর: বকেয়া বেতনের দাবিতে ৩০ ঘণ্টা ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন গাজীপুর মহানগরীর মালেকের বাড়ি এলাকার টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকরা। অবরোধের কারণে মহাসড়কে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে যানজট। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারী যাত্রীরা।
গত শনিবার (৯ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় শ্রমিকদের এই বিক্ষোভ শুরু হয়। এরপর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এরপর শ্রমিকরা কয়েকবার অবরোধ তুলে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও মালিকপক্ষ তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ না করায় তারা অবরোধ তুলে নেননি। তবে গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে বিকল্প সড়ক ব্যবহারে অনুরোধ করে একটি ট্রাফিক আপডেট দেওয়া হয়েছে। ওই আপডেটে বলা হয়েছে, সম্মানিত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ব্যবহারকারী যাত্রীবৃন্দের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকগণ কর্তৃক ভোগড়া বাইপাস ও মালেকের বাড়ির মাঝামাঝি কলম্বিয়া গার্মেন্টসের সামনে গত শনিবার সকালে শুরু করা মহাসড়ক অবরোধ এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বিধায়, সম্মানিত যাত্রীগণকে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, আমরা শনিবার আন্দোলনের শুরু থেকেই গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের ক্রাইম ডিভিশন, ট্রাফিক ডিভিশন, আমাদের শিল্পপুলিশ ও যৌথবাহিনী সবাই মিলে কলম্বিয়া গার্মেন্টসের সামনে টিএনজেডের শ্রমিক ভাইয়েরা যে অবরোধ করে রেখেছেন, আমরা তাদের বারবার বলেছি রাস্তাটা ছেড়ে দিয়ে সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তা ছাড়তে রাজি হননি। আমরা মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। মালিকপক্ষ গত মঙ্গলবার বলেছিল, বৃহস্পতিবার তাদের স্যালারি দেবে। কিন্তু দেয় নাই। এরপরও আমরা শ্রমিকদের রাস্তা ছাড়তে অনুরোধ করেছি, কারণ এই মহাসড়ক দিয়ে প্রচুর লোক যাতায়াত করেন। এ ছাড়াও এই এলাকাটি শিল্প অধ্যুষিত এলাকা। বিকল্প সড়ক ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ময়মনসিংহ বা টাঙ্গাইল থেকে যে গাড়িগুলো আসছে সেগুলোকে আমরা ভোগড়া থেকে ডাইভারশন দিচ্ছি। ঢাকা বাইপাস, কাঞ্চন ব্রিজ বা তিনশ ফিট হয়ে যাতে ঢাকায় যেতে পারে। অপরদিকে, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহমুখী গাড়িগুলো স্টেশন রোড বা মিরের বাজার হয়ে ওদিক দিয়ে ঢাকা বাইপাস হয়ে তারা আসতে পারে। কিন্তু গাড়ির চাপ এতই বেশি, দুই দিকেই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যারা রাস্তাগুলো ভেতরে ভেতরে চিনে তারা ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যৌথ বাহিনীসহ আমরা সবাই মিলে শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, তারা যেন মহাসড়ক ছেড়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলেন। মালিকও তাদের আশ্বাস দিয়েছিল নির্দিষ্ট সমেয়ের মধ্যে বেতন পরিশোধ করবে কিন্তু তারা সেটা করতে পারছে না। আমরা এখনো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারবো।