ঢাকা ১১:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভিয়েতনামি সাহিত্যে অ্যালান পো

  • আপডেট সময় : ০৬:৫৬:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪
  • ২০ বার পড়া হয়েছে

মৃত্তিকা তৃণ: ১৯৬৪ সালের আগে ভিয়েতনাম প্রায় এক দশক ধরে বিভক্ত ছিল। মার্কিন-সমর্থিত দক্ষিণপন্থি ও কমিউনিস্ট-উত্তর অংশের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ দেশটিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। ওই বছরের আগস্টে মার্কিন বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায়
হানয়ের পশ্চিম লেক অঞ্চলের কবি চে লান ভিয়েন আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের নিন্দা এবং তাদের অপরাধী করে লেখেন-
No! It is not Edgar Poe who herded us into strategic fences,
Not Lincoln who dropped thousand-kilogram bombs on the faces of men,
Not Whitman who fired three thousand nights of cannons.

প্রাথমিকভাবে এডগার অ্যালন পোর নাম থাকাটা বেমানান ঠেকছে। লিংকন ও হুইটম্যানের নাম উল্লেখ করারও যথেষ্ট কারণ আছে, কেননা তারা আমেরিকার আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ভিয়েতনামে নিষ্ঠুর অপরাধের পক্ষে অবস্থান করেন। কিন্তু অ্যালন পো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বিশ শতকের শুরুর দিকে ভিয়েতনামের আধুনিক সাহিত্যের পোর উল্লেখ্যযোগ্য অবদানের মধ্যেই। ভিয়েতনামের ইতিহাসে পো ছিলেন ‘আমেরিকার সাহিত্য-জায়ান্ট’, যিনি এমন এক প্রজন্মের লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন যারা পরে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভিয়েতনাম প্রথম পোর সাথে পরিচিত হয়েছিল। সাম্রাজ্যের জন্য স্থানীয় কর্মী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঔপনিবেশিকরা একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে, যেখানে যুবকরা শুধু ফরাসি ভাষায় পড়াশোনা করত। ক্লাসে তারা লা ফন্টেইন ও মলিয়েরের ক্লাসিক সাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করত এবং লাইব্রেরিতে তারা আরো বৈচিত্র্যময় লেখাগুলো পড়তে পারত, যার মধ্যে ছিল ফরাসি ব্যতীত অন্যান্য লেখকদের অনুবাদ, যেগুলো মেট্রোপোলে জনপ্রিয় ছিল। ১৯১৭ সালে বোদলেয়ারের ওপর এক প্রবন্ধে, ফাম কুইন উল্লেখ করেন যে, বোদলেয়ার ‘আমেরিকার সাহিত্য-জায়ান্ট এডগার পো’-এর কাজগুলো অনুবাদ করেছিলেন। মূলত পোর সাথে ভিয়েতনামের এটাই হলো উল্লেখ্যযোগ্য পরিচিতি।
১৯৪১ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে নুয়েন তুয়ান এমন একটি আফিমখানার বর্ণনা দিয়েছিলেন, যেখানে লেখকেরা যেতেন, নেশা করতেন, রেডিওতে গান শুনতেন এবং একে অন্যকে বলতেন-
This is so Edgar Poe!Ó Indeed, PoeÕs name evoked liberation of the mind, and he was praised as someone who had ascended from the mundane by the power of imagination. This perception of Poe came from French writers like Baudelaire, who had remarked that Òfor [Poe], imagination is the queen of faculties.

এ থেকে আঁচ করা যায়, বাস্তব ও অবাস্তবের সীমা মুছে ফেলার গল্পের প্রতি ভিয়েতনামের মানুষের আগ্রহ আগে থেকেই ছিল।
গল্পগুলো মূলত চীনা ঈযঁধহয়র ধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলÑ ঈশ্বর, আত্মা এবং দানবের সাথে অদ্ভুত ঘটনার সংক্ষিপ্ত গল্প- যাতে সামাজিক নানান ভাষ্য পাওয়া যেত। এইভাবে, পো যখন কল্পনাপ্রবণ লেখক হিসেবে বোদলেয়ারের প্রশংসা পাওয়া অবস্থায় ভিয়েতনামে আসেন, তখনই তার ‘Pentient houses’ ও ‘Premature burials’ গল্পগুলোর প্রতি পাঠকরা মুগ্ধ হয়। দ্রুতই পো আধুনিক ভিয়েতনামি সাহিত্যের প্রারম্ভে প্রভাব বিস্তারকারী একমাত্র আমেরিকান লেখক হয়ে ওঠেন।
পো দ্বারা প্রভাবিত লেখকদের মধ্যে থে ল্যু ছিলেন অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী ইয়ুথ লিগের সদস্য ছিলেন এবং চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। ফরাসিদের দ্বারা পরিচালিত ফাইন আর্টস কলেজের শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাই ১৯২৯ সালে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে তিনি একটি সাহিত্য সংগঠন চালু করেন এবং লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
১৯৩৪ সালে থে ল্যু তার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘Vàng và máu’ (স্বর্ণ ও রক্ত) প্রকাশ করেন। সংকলনের শিরোনাম গল্পটি পো-এর ‘The Gold-Bug’ থেকে অনুপ্রাণিত- এর মূল বিষয়বস্তু সাউথ ক্যারোলাইনার এক দ্বীপে গুপ্তধন খোঁজার গল্প। গুপ্তধন খোঁজার ইতিহাস ১৫ শতকের চীনা দখলদারিত্বের সাথে সম্পর্কিত।
১৯৩৭ সালে পো দ্বারা প্রভাবিত আরেকজন লেখককে পাওয়া যায়, সতেরো বছর বয়সী চে লান ভিয়েন । তিনি বেড়ে ওঠেছিলেন ইল্ডহয Bình Định প্রদেশে; যা ছিল চাম জনগণের আদি রাজ্য। মধ্যযুগীয় ভিয়েতনামি বিজেতাদের হাতে তারা জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়েছিল। লাল ইটের চাম ধ্বংসাবশেষের মাঝে বসবাস করার ফলে তিনি এই পতিত রাজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং চাম নামের মতো শোনায় এমন ছদ্মনাম চে লান ভিয়েন গ্রহণ করেন। তার প্রথম কাব্য সংকলন Điêu tàn (ধ্বংসাবশেষ)। Điêu tàn-এ চে লান ভিয়েন আট অক্ষরবিশিষ্ট চতুষ্পদী ছন্দে শুকনো খুলি, ছিটানো রক্ত এবং ভগ্নস্তূপের কথা বলেন, গৌরবময় চাম শাসনের জন্য শোক প্রকাশ করেন এবং অবশিষ্ট নিঃসঙ্গ আত্মাদের জন্য কাঁদেন-যা এক ধরনের মর্মান্তিক উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিচ্ছবি।
‘Những sợi tơ lòng’ (হৃদয়ের রেশমি সুতো) কবিতায় তিনি এক অস্থির

Give me a frigid stellar sphere,
A lonely star at the skyÕs far end!
There, I shall spend my time in hiding
From sorrow, anguish and dismay!

হান মাক তু এবং বিছ খে ছিলেন চে লান ভিয়েনের আত্ম-ঘোষিত ‘ম্যাড পোয়েট্রি স্কুল’-এর সহকর্মী; তারা উভয়েই তাদের কবিতায় গথিক রক্ত, হাড় এবং মৃত কুমারীদের প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলেন এবং উভয়েই অল্প বয়সে অসুস্থতায় মারা যান। এক্ষেত্রে জুয়ান দিউ ছিলেন ‘ভালোবাসার কবিতার রাজা’; যদিও তিনি ফরাসি প্রতীকবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, তার ঠộর াপ্পহম (ব্যস্ততায়) কবিতায় পোর প্রভাবের আভাস দেখা যায়। শেষ দিকে রয়েছেন নুয়েন তুয়ান, যিনি চল্লিশের দশকের শুরুতে পোর মতো অদ্ভুত গল্প লেখার চর্চা করেছিলেন।
ভিয়েতনামের সাহিত্যের জন্য যতটা বিপ্লবী ছিলেন পো, শিগগিরই মূল বিপ্লবের উত্থানের মাঝে তিনি তার অবস্থান হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট, হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন ভিয়েত মিন জোট সদ্য পরাজিত জাপান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এর কিছুদিন পরেই ফ্রান্সের সাথে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। থে ল্যু তখন সাধারণ নাগরিক ও সৈন্যদের জন্য প্রতিরোধমূলক নাটক মঞ্চস্থ করেন। চে লান ভিয়েনও তার কলমকে এই কাজে নিয়োজিত করেন, প্রচারপত্রের সম্পাদক হন এবং কমিউনিস্ট পার্টি বা হো চি মিনের কাজের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন। পোর ভক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় ভিয়েত মিন-এ যোগদান করেন এবং তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন শিল্প-কর্মজীবন বেছে নেন। কিন্তু ফাম কুইনকে ফরাসিদের সাথে ষড়যন্ত্রের সন্দেহে স্থানীয় ভিয়েত মিন বাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং তাকে বনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মৃতদেহ একটি খাদে ফেলে দেওয়া হয়।
ভিয়েতনামে পোর প্রভাবের অবসানের একটি উপযুক্ত সময়চিহ্ন হিসেবে কাজ করে প্রথম ভিয়েতনামি লেখক ফাম কুইনের মৃত্যু। ফ্রান্স পরাজিত এবং ভিয়েতনাম বিভক্ত হওয়ার পর, দক্ষিণে নতুনতর পশ্চিমা সাহিত্য আসতে থাকে, আর উত্তরে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ প্রাধান্য পায়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে উত্তর ভিয়েতনামে লেখকরা যখন আরো সৃজনশীল স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তখন দমনকারীদের মধ্যে পো প্রভাবিত লেখকরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে কেন ১৯৬৪ সালে চে লান ভিয়েন আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের নিন্দায় পোর কথা বলেছিলেন? হয়ত তিনি পোর প্রাচীন প্রভাবকে স্মরণ করাচ্ছিলেন, অথবা পাঠকদের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আমেরিকার প্রভাব সত্যিই মানসিক মুক্তির জন্য উপকারী ছিল। হয়ত তিনি তার প্রিয় লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। উদীয়মান কবি হিসেবে তার জন্য পো হয়ত অনেক অর্থপূর্ণ ছিল।
অনুবাদ: ওয়াহিদ কায়সার

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ভিয়েতনামি সাহিত্যে অ্যালান পো

আপডেট সময় : ০৬:৫৬:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪

মৃত্তিকা তৃণ: ১৯৬৪ সালের আগে ভিয়েতনাম প্রায় এক দশক ধরে বিভক্ত ছিল। মার্কিন-সমর্থিত দক্ষিণপন্থি ও কমিউনিস্ট-উত্তর অংশের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ দেশটিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। ওই বছরের আগস্টে মার্কিন বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায়
হানয়ের পশ্চিম লেক অঞ্চলের কবি চে লান ভিয়েন আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের নিন্দা এবং তাদের অপরাধী করে লেখেন-
No! It is not Edgar Poe who herded us into strategic fences,
Not Lincoln who dropped thousand-kilogram bombs on the faces of men,
Not Whitman who fired three thousand nights of cannons.

প্রাথমিকভাবে এডগার অ্যালন পোর নাম থাকাটা বেমানান ঠেকছে। লিংকন ও হুইটম্যানের নাম উল্লেখ করারও যথেষ্ট কারণ আছে, কেননা তারা আমেরিকার আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ভিয়েতনামে নিষ্ঠুর অপরাধের পক্ষে অবস্থান করেন। কিন্তু অ্যালন পো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বিশ শতকের শুরুর দিকে ভিয়েতনামের আধুনিক সাহিত্যের পোর উল্লেখ্যযোগ্য অবদানের মধ্যেই। ভিয়েতনামের ইতিহাসে পো ছিলেন ‘আমেরিকার সাহিত্য-জায়ান্ট’, যিনি এমন এক প্রজন্মের লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন যারা পরে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভিয়েতনাম প্রথম পোর সাথে পরিচিত হয়েছিল। সাম্রাজ্যের জন্য স্থানীয় কর্মী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঔপনিবেশিকরা একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে, যেখানে যুবকরা শুধু ফরাসি ভাষায় পড়াশোনা করত। ক্লাসে তারা লা ফন্টেইন ও মলিয়েরের ক্লাসিক সাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করত এবং লাইব্রেরিতে তারা আরো বৈচিত্র্যময় লেখাগুলো পড়তে পারত, যার মধ্যে ছিল ফরাসি ব্যতীত অন্যান্য লেখকদের অনুবাদ, যেগুলো মেট্রোপোলে জনপ্রিয় ছিল। ১৯১৭ সালে বোদলেয়ারের ওপর এক প্রবন্ধে, ফাম কুইন উল্লেখ করেন যে, বোদলেয়ার ‘আমেরিকার সাহিত্য-জায়ান্ট এডগার পো’-এর কাজগুলো অনুবাদ করেছিলেন। মূলত পোর সাথে ভিয়েতনামের এটাই হলো উল্লেখ্যযোগ্য পরিচিতি।
১৯৪১ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে নুয়েন তুয়ান এমন একটি আফিমখানার বর্ণনা দিয়েছিলেন, যেখানে লেখকেরা যেতেন, নেশা করতেন, রেডিওতে গান শুনতেন এবং একে অন্যকে বলতেন-
This is so Edgar Poe!Ó Indeed, PoeÕs name evoked liberation of the mind, and he was praised as someone who had ascended from the mundane by the power of imagination. This perception of Poe came from French writers like Baudelaire, who had remarked that Òfor [Poe], imagination is the queen of faculties.

এ থেকে আঁচ করা যায়, বাস্তব ও অবাস্তবের সীমা মুছে ফেলার গল্পের প্রতি ভিয়েতনামের মানুষের আগ্রহ আগে থেকেই ছিল।
গল্পগুলো মূলত চীনা ঈযঁধহয়র ধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলÑ ঈশ্বর, আত্মা এবং দানবের সাথে অদ্ভুত ঘটনার সংক্ষিপ্ত গল্প- যাতে সামাজিক নানান ভাষ্য পাওয়া যেত। এইভাবে, পো যখন কল্পনাপ্রবণ লেখক হিসেবে বোদলেয়ারের প্রশংসা পাওয়া অবস্থায় ভিয়েতনামে আসেন, তখনই তার ‘Pentient houses’ ও ‘Premature burials’ গল্পগুলোর প্রতি পাঠকরা মুগ্ধ হয়। দ্রুতই পো আধুনিক ভিয়েতনামি সাহিত্যের প্রারম্ভে প্রভাব বিস্তারকারী একমাত্র আমেরিকান লেখক হয়ে ওঠেন।
পো দ্বারা প্রভাবিত লেখকদের মধ্যে থে ল্যু ছিলেন অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী ইয়ুথ লিগের সদস্য ছিলেন এবং চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। ফরাসিদের দ্বারা পরিচালিত ফাইন আর্টস কলেজের শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাই ১৯২৯ সালে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে তিনি একটি সাহিত্য সংগঠন চালু করেন এবং লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
১৯৩৪ সালে থে ল্যু তার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘Vàng và máu’ (স্বর্ণ ও রক্ত) প্রকাশ করেন। সংকলনের শিরোনাম গল্পটি পো-এর ‘The Gold-Bug’ থেকে অনুপ্রাণিত- এর মূল বিষয়বস্তু সাউথ ক্যারোলাইনার এক দ্বীপে গুপ্তধন খোঁজার গল্প। গুপ্তধন খোঁজার ইতিহাস ১৫ শতকের চীনা দখলদারিত্বের সাথে সম্পর্কিত।
১৯৩৭ সালে পো দ্বারা প্রভাবিত আরেকজন লেখককে পাওয়া যায়, সতেরো বছর বয়সী চে লান ভিয়েন । তিনি বেড়ে ওঠেছিলেন ইল্ডহয Bình Định প্রদেশে; যা ছিল চাম জনগণের আদি রাজ্য। মধ্যযুগীয় ভিয়েতনামি বিজেতাদের হাতে তারা জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়েছিল। লাল ইটের চাম ধ্বংসাবশেষের মাঝে বসবাস করার ফলে তিনি এই পতিত রাজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং চাম নামের মতো শোনায় এমন ছদ্মনাম চে লান ভিয়েন গ্রহণ করেন। তার প্রথম কাব্য সংকলন Điêu tàn (ধ্বংসাবশেষ)। Điêu tàn-এ চে লান ভিয়েন আট অক্ষরবিশিষ্ট চতুষ্পদী ছন্দে শুকনো খুলি, ছিটানো রক্ত এবং ভগ্নস্তূপের কথা বলেন, গৌরবময় চাম শাসনের জন্য শোক প্রকাশ করেন এবং অবশিষ্ট নিঃসঙ্গ আত্মাদের জন্য কাঁদেন-যা এক ধরনের মর্মান্তিক উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিচ্ছবি।
‘Những sợi tơ lòng’ (হৃদয়ের রেশমি সুতো) কবিতায় তিনি এক অস্থির

Give me a frigid stellar sphere,
A lonely star at the skyÕs far end!
There, I shall spend my time in hiding
From sorrow, anguish and dismay!

হান মাক তু এবং বিছ খে ছিলেন চে লান ভিয়েনের আত্ম-ঘোষিত ‘ম্যাড পোয়েট্রি স্কুল’-এর সহকর্মী; তারা উভয়েই তাদের কবিতায় গথিক রক্ত, হাড় এবং মৃত কুমারীদের প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলেন এবং উভয়েই অল্প বয়সে অসুস্থতায় মারা যান। এক্ষেত্রে জুয়ান দিউ ছিলেন ‘ভালোবাসার কবিতার রাজা’; যদিও তিনি ফরাসি প্রতীকবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, তার ঠộর াপ্পহম (ব্যস্ততায়) কবিতায় পোর প্রভাবের আভাস দেখা যায়। শেষ দিকে রয়েছেন নুয়েন তুয়ান, যিনি চল্লিশের দশকের শুরুতে পোর মতো অদ্ভুত গল্প লেখার চর্চা করেছিলেন।
ভিয়েতনামের সাহিত্যের জন্য যতটা বিপ্লবী ছিলেন পো, শিগগিরই মূল বিপ্লবের উত্থানের মাঝে তিনি তার অবস্থান হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট, হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন ভিয়েত মিন জোট সদ্য পরাজিত জাপান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এর কিছুদিন পরেই ফ্রান্সের সাথে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়। থে ল্যু তখন সাধারণ নাগরিক ও সৈন্যদের জন্য প্রতিরোধমূলক নাটক মঞ্চস্থ করেন। চে লান ভিয়েনও তার কলমকে এই কাজে নিয়োজিত করেন, প্রচারপত্রের সম্পাদক হন এবং কমিউনিস্ট পার্টি বা হো চি মিনের কাজের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন। পোর ভক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় ভিয়েত মিন-এ যোগদান করেন এবং তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন শিল্প-কর্মজীবন বেছে নেন। কিন্তু ফাম কুইনকে ফরাসিদের সাথে ষড়যন্ত্রের সন্দেহে স্থানীয় ভিয়েত মিন বাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং তাকে বনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মৃতদেহ একটি খাদে ফেলে দেওয়া হয়।
ভিয়েতনামে পোর প্রভাবের অবসানের একটি উপযুক্ত সময়চিহ্ন হিসেবে কাজ করে প্রথম ভিয়েতনামি লেখক ফাম কুইনের মৃত্যু। ফ্রান্স পরাজিত এবং ভিয়েতনাম বিভক্ত হওয়ার পর, দক্ষিণে নতুনতর পশ্চিমা সাহিত্য আসতে থাকে, আর উত্তরে সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ প্রাধান্য পায়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে উত্তর ভিয়েতনামে লেখকরা যখন আরো সৃজনশীল স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তখন দমনকারীদের মধ্যে পো প্রভাবিত লেখকরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে কেন ১৯৬৪ সালে চে লান ভিয়েন আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের নিন্দায় পোর কথা বলেছিলেন? হয়ত তিনি পোর প্রাচীন প্রভাবকে স্মরণ করাচ্ছিলেন, অথবা পাঠকদের মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আমেরিকার প্রভাব সত্যিই মানসিক মুক্তির জন্য উপকারী ছিল। হয়ত তিনি তার প্রিয় লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। উদীয়মান কবি হিসেবে তার জন্য পো হয়ত অনেক অর্থপূর্ণ ছিল।
অনুবাদ: ওয়াহিদ কায়সার

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ