নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্দিষ্ট আইনে পরিচালিত। কিন্তু আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক স্টাডি সেন্টার পরিচালনার অনুমোদন রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে অলাভজনক, সেখানে মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টার লাভজনক হতে পারে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে—আইন অনুযায়ী লাভজনক স্টাডি সেন্টার পরিচালনার সুযোগ নেই। আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার পরিচালনার অনুমোদনও দেওয়া হয়নি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৪(৭) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাইবে না।’
আইনটির ৩৯-এর ২ ধারার উপধারা-১ এ বলা হয়েছে ‘(২) উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত কোনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের নামে ক্যাম্পাস স্থাপন অথবা কোনও প্রোগ্রাম বা কোর্স অনুমোদন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় সরকার প্রণীত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে।’ আইনের ৫০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে।’
আইনের এই ধারাগুলোর ক্ষমতাবলে ২০১৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগ ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাতিষ্ঠানের শাখা বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা প্রণয়ন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের আলোকে ২০১৪ সালের ৩১ মে ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা-২০১৪’ জারি করেছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
ওই বিধিমালার অনুচ্ছেদ ৭ এর (ঝ)’তে বলা হয়ছে, ‘উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ উদ্যোক্তা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিভাজিত হইতে হইবে’। অর্থাৎ এতে স্টাডি সেন্টারকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করা হয়েছে, যা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অথচ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধিমালা তৈরি করা যায় না। এই কারণেই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় ও বর্তমান মন্ত্রী ডা. দীপু মনির সময়ের প্রথম দিকে কেউ স্টাডি সেন্টার খুলতে পারেনি।
বিধিমালাটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে দেয়। ওই কমিটি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর ওই বছরের মার্চে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা সংশোধন করে নতুন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়।
এরই মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো আলমগীর বলেন, ‘আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় নীতিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা কোনও স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন দেইনি। বিধিমালা সংশোধন ছাড়া অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া স্টাডি সেন্টার পরিচালনারও সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘মোনাস কলেজের যে স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেটা অনেকটা কোচিং সেন্টারের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার মতো নয়।’
এদিকে মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টার অনুমোদনের পর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সংগঠনটি বলছে—বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনার বিভিন্ন বিধিমালা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অলাভজনক উচ্চশিক্ষার নীতির পরিপন্থী।
সার্বিক বিবেচনায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনার অনুমোদন স্থগিত করে দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে বৈষম্যহীন একক নীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধি প্রণয়নের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন—একবার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি দেওয়া হলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না ইউজিসি। ইউজিসির সেই সামর্থ নেই। তখন সার্টিফিকেট বাণিজ্যও ঠেকাতে পারবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, শর্তারোপ করে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা ক্যাম্পাস আনা গেলে উচ্চশিক্ষায় প্রতিযোগিতা বাড়বে। মান্নোনয়নও হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তা হলে বিদেশি শাখা ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি না দেওয়াই ভালো। বরং দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নার্সিং করে আরও উন্নত করাই হবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, ‘র্যাকিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাখা ক্যম্পাস খুলতে চায় না। নীতিমালায় শর্তারোপ করে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা ক্যাম্পাস আনলে উচ্চশিক্ষায় প্রতিযোগিতা বাড়বে। গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। তবে যেকোনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে শাখা ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি দেওয়া যাবে না।’