প্রত্যাশা ডেস্ক : আদালত দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধান শাখা (আই-ইউনিট) বাংলাদেশের সাবেক এই মন্ত্রীকে লন্ডনের ১৪ মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল একটি বাড়িতে খুঁজে পেয়েছে।
গত সোমবার (২১ অক্টোবর) আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান ও উল থর্নের করা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সংযুক্ত আরব আমিরাতে নতুন করে আরও ৩০০টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর আগে, দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর আল জাজিরার প্রকাশিত দ্য মিনিস্টারস মিলিয়নস শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। যা বাংলাদেশি অর্থে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সমান। ব্রিটেন ছাড়াও নিজের রিয়েল স্টেট ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত। সবমিলিয়ে তিনি সাত শতাধিক বাড়ি কিনেছেন। যেগুলোর মূল্য ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। যা বাংলাদেশি ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সোমবার আল জাজিরার আই-ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্রিটেনে কোটি কোটি ডলার পাচারের অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মাঝেই তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। যদিও সাবেক এই মন্ত্রী বর্তমানে লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করছেন। আই-ইউনিটের অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা সম্প্রতি সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে লন্ডনের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন। ওই এলাকায় তার ৯০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ছয়টি সম্পত্তি রয়েছে; যা তার যুক্তরাজ্যে গড়ে তোলা সম্পদের সাম্রাজ্যের ছোট একটি অংশ। সাইফুজ্জামান চৌধুরী ব্রিটেন ছাড়াও নিজের রিয়েল স্টেট ব্যবসার সম্প্রসারণ করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত। চৌধুরী ও তার স্ত্রীর এসব সম্পদ জব্দ করার জন্য বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ছাত্র-জনতার কয়েক সপ্তাহের তুমুল বিক্ষোভের জেরে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ মিত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনই ভারতে পালিয়ে যান। সরকারের পতনের পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেছেন।
দুবাইয়ে আরও সম্পত্তি: দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গত সেপ্টেম্বরে ‘দ্য মিনিস্টারস মিলিয়নস’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে তোলা সম্পদের সাম্রাজ্যের ফিরিস্তি তুলে ধরে আল জাজিরা; যার বাজার মূল্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সাবেক এই মন্ত্রী আল জাজিরার ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের কাছে নিজের রিয়েল স্টেট ব্যবসাকে দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেছেন বলে জানান। ২০১৬ সাল থেকে তিনি কেবল যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টির বেশি বাড়ি কিনেছেন।
দুবাইয়ে চৌধুরীর সম্পত্তির সংখ্যা প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা হয়েছিল, তারচেয়েও বেশি বলে আল জাজিরার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। নতুন করে ফাঁস হওয়া ২০২৩ সালের সম্পত্তির তথ্যে দেখা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৫০টিরও বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক সাইফুজ্জামান চৌধুরী; যার মূল্য ১৪০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আই-ইউনিটের কাছে আসা তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, চৌধুরীর স্ত্রী রুখমিলা জামান দুবাইয়ে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের আরও ৫০টি বাড়ির তালিকাভুক্ত মালিক। অর্থপাচারের অভিযোগে রুখমিলা জামানের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশে তদন্ত চলছে। ২০২০ ও ২০২২ সালের দুবাইয়ে থাকা সম্পত্তির ফাঁস হওয়া ডাটায় এই দম্পতির তালিকাভুক্ত অন্য ৫৪টি সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যায়। আল জাজিরার আন্ডারকভার ফুটেজে মর্যাদাপূর্ণ অপেরা জেলায় একটি পেন্টহাউসের মালিক হওয়ার বিষয়ে গর্ব করতে দেখা যায় পলাতক এই মন্ত্রীকে। আর জমির রেকর্ডেও নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সেখানে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক তিনি; যার মূল্য ৫০ লাখ ডলারের বেশি। ফাঁস হওয়া নতুন তথ্য অনুযায়ী, সাবেক এই মন্ত্রী ও তার স্ত্রী সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩০০টিরও বেশি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন বলে ধারণা করা হয়। সামগ্রিকভাবে এই দম্পতি বিশ্বজুড়ে ৬০০টিরও বেশি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক।
অর্থপাচারের তদন্ত: বাংলাদেশের মুদ্রা আইনে কোনও নাগরিককে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আল জাজিরার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তার অফশোর সম্পদের ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশের কর আইন লঙ্ঘন করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সাবেক মন্ত্রীদের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে। দেশের কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। ব্রিটেনে কয়েক মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগের তদন্ত চলাকালীন এই দম্পতির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছেন আদালত। তবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী আল জাজিরাকে বলেছেন, বাংলাদেশের বাইরে নিজের বৈধ ব্যবসা থেকে পাওয়া অর্থে বিদেশি সম্পত্তি কেনার কাজে ব্যবহার করেছেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে তিনি এই ব্যবসার মালিক। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিকারে পরিণত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলেও রুখমিলা জামানের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। সূত্র: আল জাজিরা আই ইউনিট।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে লন্ডনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সাইফুজ্জামান: আল জাজিরার তদন্তকারী ইউনিট (আই-ইউনিট) জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বর্তমানে লন্ডনে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের একটি বাড়িতে বসবাস করছেন। যুক্তরাজ্যে মিলিয়ন ডলার পাচার ও বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ তদন্তের সময় তার বিদেশ ভ্রমণে নিষাধাজ্ঞা জারি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আই-ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে লন্ডনে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের পাশ দিয়ে হাঁটতে দেখা গেছে। জানা গেছে, লন্ডনে ৯০ লাখেরও বেশি ডলার মূল্যের ছয়টি বাড়ি রয়েছে, যা তার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ছোট একটি অংশ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আল জাজিরা ‘দ্য মিনিস্টার মিলিয়নস’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়েছে, একাধিক দেশে সাইফুজ্জামানের সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি ডলার। সাবেক এই মন্ত্রী আল জাজিরার আন্ডারকভার সাংবাদিকদের কাছে গর্ব করে বলেছিলেন, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও দুবাইতে তার অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সাল থেকে তিনি শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টিরও বেশি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। আল জাজিরার প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, দুবাইয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির সংখ্যা প্রাথমিকভাবে ধারণার চেয়েও বেশি। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রেও আরও কয়েকশ অ্যাপার্টমেন্টের সঙ্গে এই অ্যাপার্টমেন্টগুলো এখন সাবেক মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর সম্পদ জব্দ করার জন্য আদেশ দিয়েছে দুদক।
যুক্তরাজ্যের ফার্মগুলোর ভূমিকা খতিয়ে দেখার তাগাদা: সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে লন্ডনের রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, আইনজীবী ও ঋণদাতা কোম্পানিগুলোর সম্পর্ক কী, তা খুঁজে বের করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে তাগাদা দিয়েছেন দেশটির সংসদ সদস্যরা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্যরা দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এই অনুরোধ জানালেন। দ্য গার্ডিয়ানের সংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ২০ কোটি পাউন্ড মূল্যের ২৫০টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে। যদিও তাঁর আইনজীবী সম্প্রতি বলেছেন, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী এসব সম্পত্তি কিনেছেন। ফলে তাঁর লুকানোর কিছু নেই।
লেবার পার্টির সংসদ সদস্য ফিল ব্রিকেল দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে চিঠি পাঠিয়ে নিশ্চিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যেসব কোম্পানি এসব সম্পত্তি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অর্থের উৎস যথাযথভাবে খতিয়ে দেখেছে কি না। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচার–সংক্রান্ত আইন অনুসরণ বা মান্য করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।