ঢাকা ০১:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : পর্যবেক্ষণ এবং উত্তরণ

  • আপডেট সময় : ০৫:২৯:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
  • ৬৫ বার পড়া হয়েছে

খন্দকার ফারজানা রহমান: জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম অগ্রাধিকার ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মনোবল পুনরুদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন করা। যদিও আন্দোলন পরবর্তী শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীকে পুলিশিংয়ের ক্ষমতা দিয়েছেন; তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এখন পর্যন্ত প্রশাসন বিক্ষিপ্ত ভাঙচুর, মব কিলিংস ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না! এর একটি প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখনো অনেকখানি ভঙ্গুর। আন্দোলনের সময় পুলিশকে ইচ্ছামতো ব্যবহার ও পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের জনরোষের ফলাফল হিসেবে এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না এবং এই সুযোগে বেশকিছু অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড ঘটেই চলছে।
বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে যে, জনতার হামলায় কমপক্ষে ৪২ জন পুলিশ প্রাণ হারিয়েছে। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ৬ আগস্ট বিকেলের মধ্যে বাংলাদেশের ২ লাখ ১০ হাজার পুলিশ অফিসারের একজনও সারা দেশের কোনো থানায় উপস্থিত ছিলেন না। এতে বোঝা যায়, আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অপরাধ দমনের আনুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল, একই সাথে এটাও সত্য যে, সামাজিক নিরাপত্তা (কমিউনিটি সেফটি) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অনেক বছরের চাপা ক্ষোভ থেকে সাধারণ মানুষ অসহনশীল হয়ে পড়ছে যার মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিটিয়ে হত্যা বা রাজনৈতিক নেতাদের পরিকল্পিত হত্যা বা তাদের ওপর আক্রমণ বা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিমা ভাঙচুর এই ঘটনাগুলো দেখে অনুমান করা যায় সমাজে অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং বন্ধন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক অস্থিরতা চলছে; যার প্রভাব সমগ্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন-পরবর্তী সহিংসতা ও কার্যকারণ অনুসন্ধান
সমাজে অপরাধ বাড়ার মূল কারণ আমরা ধরতে পেরেছি কি?
দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মূল পন্থা হলো একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা; যার মধ্যে রয়েছে একটি সুকার্যকরী পুলিশ বাহিনী, একটি ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার শক্তিশালী সমন্বয়, পাশাপাশি অপরাধের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে এমন অন্তর্নিহিত সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা, আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা ও শিক্ষার প্রচার করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
আমি মনে করি, বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখন যেই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকার দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা এবং সুরক্ষা সাধনের জন্য সামাজিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি ও কার্যকর করবেন এবং একই সাথে সাধারণ মানুষদের আইন মেনে চলা এবং অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ করার ক্ষেত্রে সচেতন করার কার্যক্রম নেবেন। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি—
স্বাধীন-নিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা: সরকারকে একটি স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। একইসাথে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে পুলিশের নিজস্ব দুর্নীতি, বর্বরতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ পুলিশের অসদাচরণের সব অভিযোগের যাচাই বাছাই করা উচিত। তদন্ত অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং বিচারের সুপারিশসহ শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃত্ব বাহিনীর থাকতে হবে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করা: বাংলাদেশে যেহেতু সভ্যতার পর সভ্যতা ধরে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল, অন্য ধর্মের প্রতি মানবিকতা কিংবা সহনশীল আচরণকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ নির্দেশনা দিতে হবে।
ধর্মীয় সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য, সামাজিক সম্প্রীতি চর্চার সুযোগ তৈরি করার দায়িত্ব মূলত একটি সমাজের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে থাকে, তাই সরকারের উচিত স্থানীয় মুসলিম নেতাদের সামাজিক বন্ধন বিকাশের জন্য দ্রুত নির্দেশনা দেওয়া।
তথ্যচালিত জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন: সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তা যারা বছরের পর বছর কোনো কারণ ছাড়াই সাবেক সরকারের অন্যায় আচরণের ভুক্তভোগী হয়েছেন তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে, সরকারি শাসন ব্যবস্থার (স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে) মধ্যে সব ধরনের দুর্নীতি বা দায়িত্বে অবহেলা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অসদাচরণের ঘটনা তদন্তের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তবে এটাও নিশ্চিত করতে হবে শুধু মাত্র রাজনৈতিক কারণে কেউ যাতে অবমূল্যায়ন শিকার না হয় এবং প্রশাসনিক প্রতিটি স্তরে প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্ব কার্যকরভাবে এবং ন্যায্যভাবে কাজ করছে কিনা।
স্বচ্ছতা ও জনসাধারণের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া: পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উচিত এই সংস্থার নিয়মিতভাবে ভালো উদাহরণ (বেস্ট প্র্যাকটিস) এবং অসদাচরণের প্রতিক্রিয়ায় গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের মাঝে প্রকাশ করা।
কমিউনিটি পুলিশিংকে শক্তিশালী করা: বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম প্রধান ব্যর্থতা হলো নাগরিক সম্প্রদায়গুলোয় কাজ করে তাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে অক্ষম। কমিউনিটি পুলিশিং; যা বিশ্বের অনেক অংশে সফল হয়েছে, তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
এই পদ্ধতির সঙ্গে পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা গড়ে তোলা জড়িত, যেখানে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা পুলিশ সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে তাদের উদ্বেগের সমাধান এবং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। যেহেতু কোটা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ এবং পুলিশের মধ্যে অনাস্থা এবং বিশ্বাসহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং আশা তৈরি করতে হলে সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনে পুলিশকে দ্রুত সময়ে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর রেসপন্স বাড়ানো এবং একই সাথে অপরাধ দমনে সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
পুলিশের ও সরকারি চাকরি নিয়োগ অরাজনীতিকরণ: বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব প্রতিষ্ঠানটিকে জর্জরিত করেছে, যেটা তাদের দুর্নীতি ও অসদাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এর সমাধানের জন্য, পুলিশ নিয়োগ এবং পদোন্নতি অবশ্যই রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে।
একটি স্বাধীন সংস্থাকে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ার তদারকি সুস্থভাবে করতে হবে যাতে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া ন্যায্য ও স্বচ্ছ হয় এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের বদলে সত্যিকারের মেধাবীরা সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াতে চাকরি প্রাপ্ত হয়।
একটি অপরাধ দিয়ে আরেকটি অপরাধকে ন্যায্যতা যেমন দেওয়া যায় না, তেমনি সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে বর্তমানে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলোরও ন্যায্যতা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ একটি সংকটময় মুহূর্ত থেকে উত্তরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। তাই রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার, অখণ্ডতা ও আইনের শাসনকে সমর্থন করে এমন একটি নিরপেক্ষ পুলিশি ব্যবস্থা তৈরি করা খুবই প্রয়োজন।
তেমনি সরকার সংবিধান সংস্কারসহ বিচার বিভাগ, পুলিশ সংস্কারের জন্য কিছু শক্তিশালী কমিটি করেছেন। যদিও কমিটিগুলোয় লিঙ্গ, আদিবাসী বা ধর্মের ভিত্তিতে সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রতিনিধিত্ব নেই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কমিশনগুলো নাগরিক সম্প্রদায় এবং প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের এর সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে গণশুনানি করে কার্যকর সুপারিশ সরকারকে দিতে পারে এবং সেই অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করে সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সেসব বাস্তবায়িত করতে পারে, তাহলে বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আমি আশা রাখি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : পর্যবেক্ষণ এবং উত্তরণ

আপডেট সময় : ০৫:২৯:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

খন্দকার ফারজানা রহমান: জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম অগ্রাধিকার ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মনোবল পুনরুদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন করা। যদিও আন্দোলন পরবর্তী শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীকে পুলিশিংয়ের ক্ষমতা দিয়েছেন; তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এখন পর্যন্ত প্রশাসন বিক্ষিপ্ত ভাঙচুর, মব কিলিংস ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না! এর একটি প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখনো অনেকখানি ভঙ্গুর। আন্দোলনের সময় পুলিশকে ইচ্ছামতো ব্যবহার ও পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের জনরোষের ফলাফল হিসেবে এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না এবং এই সুযোগে বেশকিছু অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড ঘটেই চলছে।
বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে যে, জনতার হামলায় কমপক্ষে ৪২ জন পুলিশ প্রাণ হারিয়েছে। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ৬ আগস্ট বিকেলের মধ্যে বাংলাদেশের ২ লাখ ১০ হাজার পুলিশ অফিসারের একজনও সারা দেশের কোনো থানায় উপস্থিত ছিলেন না। এতে বোঝা যায়, আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অপরাধ দমনের আনুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল, একই সাথে এটাও সত্য যে, সামাজিক নিরাপত্তা (কমিউনিটি সেফটি) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অনেক বছরের চাপা ক্ষোভ থেকে সাধারণ মানুষ অসহনশীল হয়ে পড়ছে যার মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিটিয়ে হত্যা বা রাজনৈতিক নেতাদের পরিকল্পিত হত্যা বা তাদের ওপর আক্রমণ বা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিমা ভাঙচুর এই ঘটনাগুলো দেখে অনুমান করা যায় সমাজে অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং বন্ধন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক অস্থিরতা চলছে; যার প্রভাব সমগ্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন-পরবর্তী সহিংসতা ও কার্যকারণ অনুসন্ধান
সমাজে অপরাধ বাড়ার মূল কারণ আমরা ধরতে পেরেছি কি?
দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মূল পন্থা হলো একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা; যার মধ্যে রয়েছে একটি সুকার্যকরী পুলিশ বাহিনী, একটি ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার শক্তিশালী সমন্বয়, পাশাপাশি অপরাধের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে এমন অন্তর্নিহিত সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা, আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা ও শিক্ষার প্রচার করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
আমি মনে করি, বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখন যেই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকার দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা এবং সুরক্ষা সাধনের জন্য সামাজিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি ও কার্যকর করবেন এবং একই সাথে সাধারণ মানুষদের আইন মেনে চলা এবং অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ করার ক্ষেত্রে সচেতন করার কার্যক্রম নেবেন। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি—
স্বাধীন-নিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা: সরকারকে একটি স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। একইসাথে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে পুলিশের নিজস্ব দুর্নীতি, বর্বরতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ পুলিশের অসদাচরণের সব অভিযোগের যাচাই বাছাই করা উচিত। তদন্ত অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং বিচারের সুপারিশসহ শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃত্ব বাহিনীর থাকতে হবে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করা: বাংলাদেশে যেহেতু সভ্যতার পর সভ্যতা ধরে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল, অন্য ধর্মের প্রতি মানবিকতা কিংবা সহনশীল আচরণকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ নির্দেশনা দিতে হবে।
ধর্মীয় সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য, সামাজিক সম্প্রীতি চর্চার সুযোগ তৈরি করার দায়িত্ব মূলত একটি সমাজের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে থাকে, তাই সরকারের উচিত স্থানীয় মুসলিম নেতাদের সামাজিক বন্ধন বিকাশের জন্য দ্রুত নির্দেশনা দেওয়া।
তথ্যচালিত জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন: সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তা যারা বছরের পর বছর কোনো কারণ ছাড়াই সাবেক সরকারের অন্যায় আচরণের ভুক্তভোগী হয়েছেন তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে, সরকারি শাসন ব্যবস্থার (স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে) মধ্যে সব ধরনের দুর্নীতি বা দায়িত্বে অবহেলা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অসদাচরণের ঘটনা তদন্তের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তবে এটাও নিশ্চিত করতে হবে শুধু মাত্র রাজনৈতিক কারণে কেউ যাতে অবমূল্যায়ন শিকার না হয় এবং প্রশাসনিক প্রতিটি স্তরে প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্ব কার্যকরভাবে এবং ন্যায্যভাবে কাজ করছে কিনা।
স্বচ্ছতা ও জনসাধারণের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া: পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উচিত এই সংস্থার নিয়মিতভাবে ভালো উদাহরণ (বেস্ট প্র্যাকটিস) এবং অসদাচরণের প্রতিক্রিয়ায় গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের মাঝে প্রকাশ করা।
কমিউনিটি পুলিশিংকে শক্তিশালী করা: বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম প্রধান ব্যর্থতা হলো নাগরিক সম্প্রদায়গুলোয় কাজ করে তাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে অক্ষম। কমিউনিটি পুলিশিং; যা বিশ্বের অনেক অংশে সফল হয়েছে, তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
এই পদ্ধতির সঙ্গে পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা গড়ে তোলা জড়িত, যেখানে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা পুলিশ সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে তাদের উদ্বেগের সমাধান এবং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। যেহেতু কোটা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ এবং পুলিশের মধ্যে অনাস্থা এবং বিশ্বাসহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং আশা তৈরি করতে হলে সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনে পুলিশকে দ্রুত সময়ে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর রেসপন্স বাড়ানো এবং একই সাথে অপরাধ দমনে সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
পুলিশের ও সরকারি চাকরি নিয়োগ অরাজনীতিকরণ: বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব প্রতিষ্ঠানটিকে জর্জরিত করেছে, যেটা তাদের দুর্নীতি ও অসদাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এর সমাধানের জন্য, পুলিশ নিয়োগ এবং পদোন্নতি অবশ্যই রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে।
একটি স্বাধীন সংস্থাকে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ার তদারকি সুস্থভাবে করতে হবে যাতে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া ন্যায্য ও স্বচ্ছ হয় এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের বদলে সত্যিকারের মেধাবীরা সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াতে চাকরি প্রাপ্ত হয়।
একটি অপরাধ দিয়ে আরেকটি অপরাধকে ন্যায্যতা যেমন দেওয়া যায় না, তেমনি সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে বর্তমানে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলোরও ন্যায্যতা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ একটি সংকটময় মুহূর্ত থেকে উত্তরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। তাই রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার, অখণ্ডতা ও আইনের শাসনকে সমর্থন করে এমন একটি নিরপেক্ষ পুলিশি ব্যবস্থা তৈরি করা খুবই প্রয়োজন।
তেমনি সরকার সংবিধান সংস্কারসহ বিচার বিভাগ, পুলিশ সংস্কারের জন্য কিছু শক্তিশালী কমিটি করেছেন। যদিও কমিটিগুলোয় লিঙ্গ, আদিবাসী বা ধর্মের ভিত্তিতে সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রতিনিধিত্ব নেই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কমিশনগুলো নাগরিক সম্প্রদায় এবং প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের এর সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে গণশুনানি করে কার্যকর সুপারিশ সরকারকে দিতে পারে এবং সেই অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করে সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সেসব বাস্তবায়িত করতে পারে, তাহলে বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আমি আশা রাখি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ