আহসান হাবিব : বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’। বলা যায়, ‘মব জাস্টিস’ হলো যখন কোনো উত্তেজিত জনতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাউকে শাস্তি দেয়। এই শাস্তি প্রায়শই মারধর, নির্যাতন বা হত্যা পর্যন্ত যেতে পারে। এসব ঘটনা সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলোয় বলা হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’। মব জাস্টিস অনুৎসাহিত করতে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ মব জাস্টিস বলতে সাধারণভাবে বোঝায়— জনতা যদি আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে যখন তুলে নেয়, তাই মব জাস্টিস। এ ধরনের ঘটনায় যদি কেউ মারা যায় বা জনতার গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে তাকে মব লিঞ্চিংও বলে থাকে। এর অর্থ বিচারবহির্ভূত হত্যা। অর্থাৎ পথ একই— কিন্তু কৌশল ভিন্ন। যেমন— গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে শিক্ষার্থীদের হাতে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
তিন ধাপে দফায় দফায় নির্মম নির্যাতন করে তাকে মারা হয়। আসলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ শব্দ দুটির ব্যবহার ইদানীং বেড়েছে। ‘কান নিয়েছে চিলে’, আসলে কান না হাতিয়ে চিলের পেছনে ছুটছে মানুষ। কোনো ঘটনার পূর্বাপর না ভেবে জনতা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কী করতে হবে কিংবা না বুঝেই ছুটছে ঘটনার পেছনে। যার ফলাফল হত্যা, হেনস্তা কিংবা লাঞ্ছনা। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখ রবিবার ছাত্রলীগ সংগঠনের কর্মীরা বিশ্বজিৎ দাসকে বিনা কারণে প্রকাশ্য-দিবালোকে শত শত মানুষ ও আইনরক্ষা বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৫ বছর বয়সী বিশ্বজিৎ দাস পেশায় দর্জি। নির্বিচারে কিল-ঘুষি-লাথি ছাড়াও ওই যুবককে লৌহশলাকা দিয়ে পেটানো হয়। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
কুষ্টিয়ার ছেলে আবরার ফাহাদ বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শিবির সন্দেহে তাকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে মেরেছে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই হত্যাগুলোকে বলা হয় ‘মব জাস্টিস’। ইতিপূর্বে বিচারবহির্ভূত অনেক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কারও মুখে মব জাস্টিস শব্দটি উচ্চারণ হয়নি। রাজবাড়ীর কালুখালীতে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত নাজমুল মোল্লা ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার পূর্ব গাড়াকোলা গ্রামের মৃত আহাম্মদ মোল্লার ছেলে। তিনি কালুখালীতে তার মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। শনিবার ভোরে উপজেলার মাধবপুর বাজারে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। পরে হাসপাতালে মারা যান নাজমুল। যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে পুলিশের যে নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া ভূমিকা— এর কারণে ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক জায়গায় থানা, পুলিশ ফাঁড়িগুলো আক্রান্ত হয়েছিল। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী পুলিশের অনেক সদস্য ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে অতি-উৎসাহী হয়েছিল। পট-পরিবর্তনের কারণে তারা কাজে যোগ দেননি। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে জনগণকে আগলে রাখার ক্ষেত্রে ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর যে জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার ছিল, সেটা করতে অনেকটাই তারা ব্যর্থ হয়। আদালতে যখন রাজনৈতিক আসামিদের তোলা হয়, সেসময় তাদের ওপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। এ কাজে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরাও। শুরুর দিকে মব জাস্টিস উসকে দেয়ার ক্ষেত্রে আদালতে আসামিদের ওপর হামলার ঘটনা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ‘মব জাস্টিস’ যে কতা ভয়াবহ হতে পারে, গত কয়েকদিন আমরা তার বেশ কয়েকটা ঘটনা দেখেছি। যেখানে-সেখানে যার যেমন ইচ্ছা লাঠিসোটা হাতে নিয়ে নেমে পড়েছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে মাজার ভাঙার মতো ঘটনা ঘটেছে। মব জাস্টিস শেষ পর্যন্ত ‘মব লিঞ্চিংয়ের’ মতো হৃদয়বিদারক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। রাজশাহীতে পা হারানো সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, মাত্র কয়েকদিন আগে সন্তানের বাবা হয়েছেন তিনি। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদারকে হত্যা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হামলার শিকার হয়ে সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা নিহত হয়েছেন। এ হত্যার প্রতিবাদে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে হরেদরে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও ব্যর্থতাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। কেননা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বিকাল থেকেই বঞ্চিত একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা মানুষের বাড়িঘর লুটপাট, বসতবাড়ি, দোকানপাট ও বাজার দখল শুরু করেন। পরিবহন সমিতি থেকে শুরু করে ঘাট, জলমহাল, হাটবাজার সব জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজন পালিয়ে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, অর্পিত দায়িত্বজ্ঞানেই তা পূরণে তারা নেমে পড়েন। কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যে সংঘাতেও তারা জড়ান। বিএনপির কেন্দ্র থেকে একের পর এক বহিষ্কার করেও এই দখলবাজির সংস্কৃতি তারা ঠেকাতে পারেনি।
গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের যে উচ্ছ্বাস এবং অন্তর্র্বতী সরকারের যে কর্মযজ্ঞ, সেটাই পুরো সমাজের চিত্র নয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এখন প্রধান দুটি উদ্বেগের বিষয় হলো জিনিসপত্রের দাম আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আসলে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যেসব জনআকাক্সক্ষা সামনে নিয়ে এসেছে, তার অন্যতম ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অবসান। কেউ অপরাধ করলে আদালতের মাধ্যমে তার বিচার হতে হবে। কিন্তু জনতার বিচারের নামে পিটিয়ে হত্যা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নির্যাতনে মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনের বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর এর আগে ৭ (জানুয়ারি-জুলাই) মাসে ৩৩ জন নিহত হন গণপিটুনিতে। এ অবস্থায় পুলিশ সদর দপ্তর এক বার্তায় জানায়, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভারসাম্যহীনতার কারণেই ‘মব কালচার’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণে এমন অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।
‘চুরি করলেও যেখানে হত্যা করা যায় না, সেখানে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হলো মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীকে। আমরা দেশের নানা জায়গার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলি। সেই জঘন্য ঘটনা এবার দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কথিত শিক্ষার্থীরা ঘটালো। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’ এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যান আর সেটা যদি খুন হিসাবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে দণ্ডবিধির ১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করা যায়। সে হিসাবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দণ্ড হবে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’। মানুষ যদি মনে করে যে বিচারব্যবস্থা দ্রুত এবং সঠিকভাবে কাজ করছে, তাহলে তারা মব জাস্টিসের পথ বেছে নেবে না। তাই বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং এর কার্যকারিতা বাড়ানো জরুরি। মামলা নিষ্পত্তির সময় কমানো, তদন্তের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মব জাস্টিস অনেক সময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে ঘটে। তাই সমাজে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, এবং সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে অপরাধের প্রবণতা কমে। মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা সঠিক খবর এবং তথ্য প্রদান করে জনগণকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহার করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তাহলে মব জাস্টিসের মতো অপরাধসমূহ ধীরে ধীরে সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ৫৩ বছর ধরে প্রতিটি সরকার পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে আসছে। আওয়ামী লীগের সময়ে সেটি চূড়ান্ত মাত্রা পেয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ পুলিশকে তাদের দলীয় বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিল। রাষ্ট্র সংস্কার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের যে উদ্যোগ চলছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ মানুষই উপকৃত হবে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেকটা প্রতিশ্রুতির চোখে হাত— আলোহীন নিরাপত্তা। এটি বড় শঙ্কার বিষয় যে দীর্ঘদিন যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকে, তাহলে তার সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। খেয়ে-পরে নিরাপদে বাস করতে পারছেন কি না, তাদের কাছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে অন্তর্র্বতী সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন অন্তর্র্বতী সরকারই ভেবে দেখবেন কিভাবে মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণে আনবেন। নাগরিকদের মানবাধিকারের মৌলিক প্রশ্নের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট