গাজী সালাউদ্দীন : বাংলাদেশের ইতিহাসে সব পটপরিবর্তনে ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৫২ ’৬৯, ‘৭১, ‘৯০, ২০২৪ সহ সবগুলো আন্দোলনে ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তবে ছাত্রদের এই সম্পৃক্ততার সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭১ আর ২০২৪-এর বিপ্লব। আমরা দেখেছি এ সময় দেশের প্রয়োজনের সামনে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ এক হয়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতেও তাই হবে। দেশের ছেলেরা দেশের প্রয়োজনে জীবন বাজী রেখে এগিয়ে আসবে। তাই বলে এ জন্য এখনই ছাত্রদেরকে রাজনীতি করতে দিয়ে তাদের মূল্যবান ভবিষ্যৎ নষ্ট করার মতো বোকামি করা ঠিক হবে না।
পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই ছাত্ররা শিক্ষা জীবনে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয় না। ইউএসএ, ইউকে, জাপান, চীন, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নত দেশেই ছাত্ররা পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তবে ঐসব দেশেও দেশের প্রয়োজনে ছাত্ররা ঠিকই এগিয়ে আসে।
আসুন, দেখি বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে আমাদের দেশে আসলে কি হয়Ñ
ছাত্র রাজনীতিতে জড়িতদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মূল দলের পাবলিক মিটিংয়ে লোক জড়ো করা। যেভাবে সম্ভব, ভাড়া করে হোক, ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে হোক। সার্বিকভাবে মূল দলের পেশি শক্তি হিসেবে কাজ করা।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে অনেকগুলো সিট জোড় জবরদস্তি করে দখল করে রাখা, যাতে করে নিজ দলের ছাত্ররা আরামে থাকতে পারে। প্রয়োজনে দলের বহিরাগত অ-ছাত্র কর্মীরাও থাকতে পারে।
ছাত্র সংগঠনের যারা নেতৃত্ব দেবে তাদের পড়াশোনা করে পাশ করার দরকার নেই। তারা আদু ভাই হয়ে বছরের পর বছর ছাত্র রাজনীতি করতে থাকবে।
পূজা-পার্বণ, ঈদ, নববর্ষ অথবা বিভিন্ন জাতীয় বা স্থানীয় অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদাবাজি করে অর্থ জোগান দেওয়া।
ডাইনিং হলে বা ক্যান্টিনে সিট রিজার্ভ করে রাখা, দল বেধে খেতে আসা, জোড় করে বাকিতে খাওয়া, খেয়ে বিল না দেওয়া, দীর্ঘ সময় ধরে বিল পরিশোধ না করা।
আমরা অভিভাবকরা নিশ্চয় এসব করার জন্য আমাদের বাচ্চাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদের বাচ্চারা হচ্ছে বন বাদরে বেড়ে উঠা জংলি ফলমূলের মতো, যে ইচ্ছা সে তাদের ব্যবহার করতে পারে। অথবা বন্যায় ভেসে আসা মাছের মতো, যে দল তাকে ধরতে পারবে সে যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারবে।
আমরা অভিভাবকরা আমাদের বাচ্চাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে আতঙ্কে থাকি। তাই সরকারের উচিত অভিভাবকদেরকে দুশ্চিন্তা মুক্তভাবে তাদের বাচ্চাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবার নিশ্চয়তা দান করা। হয় আইন করে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে অথবা ছাত্র রাজনীতির একটা আইন বা গাইড লাইন তৈরি করতে হবে। ‘পলিটিকাল পার্টিস অ্যাক্ট-১৯৬২’ এর মতো করে ‘স্টুডেন্ট পলিটিক্স অ্যাক্ট’ তৈরি করতে হবে। যেখানে নিম্ন বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা যেতে পারেÑ
১. রাজনীতি করতে আগ্রহী ছাত্রদের অবশ্যই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো এবং নিয়মিত ছাত্র হতে হবে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা আর রাজনীতি শেখার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে।
২. রাজনীতিকে আয় রোজগারের পেশা নয় বরং পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে নিতে হবে। নিজের একটা আলাদা পেশা বা ক্যারিয়ার তৈরি করতে হবে আয় রোজগারের জন্য।
৩. আবাসিক হলের সিট দখল করার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত বর্তমান ছাত্র ছাড়া বহিরাগত কোনো ছাত্র বা অছাত্রকে হলে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে না।
৪. চাঁদাবাজি করে সংগঠন চালানো যাবে না। সংগঠন চলবে রাজনীতি করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের মাসিক চাঁদা আর সংগঠনের প্রতি অনুরাগী জনগণের অর্থে। কোনোভাবেই কারো ওপর জোড় খাটানো যাবে না।
৫. ছাত্রনেতা নির্বাচনের সময় অবশ্যই ব্যক্তি চরিত্র, অতীত ইতিহাস বিবেচনায় নিতে হবে। পড়াশোনায় খারাপ করা ছাত্রদের অবশ্যই নেতৃত্বের উঁচু ধাপে স্থান দেওয়া যাবে না।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া)
ছাত্র রাজনীতি
ট্যাগস :
ছাত্র রাজনীতি
জনপ্রিয় সংবাদ