চারদিকে শুধু পানি আর পানি। অসহনীয় জনদুর্ভোগ, এক কথায় মানবিক বিপর্যয়। ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, খাল-বিল সবই পানিতে একাকার। শোয়ার ঘর, রান্নাঘর ও গোয়ালঘরে পানি। উঠানে কোমর-সমান পানি। বাজারঘাট, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বা সরকারি ভবনে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
রান্না করার মতো শুকনো জায়গাটুকুও নেই। কোনোমতে খাবারই যোগাড় করতে পারলেও টয়লেট করা বিশাল ঝামেলার। অনেকে উঁচু স্থানে পলিথিন ব্যাগে টয়লেট করে। ঠিকমত না ফেললে, তা আবার ভাসতে ভাসতে ঘরবাড়িতে চলে আসে।
মানুষ নিজেরাই যখন মহাবিপদে তখন তাদের গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে আরও এক ঝামেলায়, কোথায় রাখবে তাদের। বিষাক্ত পানির সঙ্গে বসবাসের ফলে অনেকেই চর্ম রোগসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত। ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বর, পেটের পীড়া, আমাশয়ের মতো রোগ নিত্যসঙ্গী।
কৃষি জমি পানির নিচে, বিষাক্ত পানিতে মাছও মারা যাচ্ছে, কাজকর্মও নাই, চারদিকে হাহাকার। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ভিন্ন কোনো স্থানে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বা শহর-বন্দরে। এমন যখন অবস্থা এলাকার মানুষের তখন মরেও শান্তি নেই। সব জায়গায় পানি, মাটি খুঁড়ে মরদেহ দাফন করা বা শ্মশানে তোলার কোনো সুযোগও নেই। মনে হয় শুধু মানুষের চোখের পানিটুকুই বিশুদ্ধ, আর বাকি সব বিষাক্ত।
প্রকল্পের পর প্রকল্প আর কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬০ লাখ মানুষের পিছু ছাড়ছে না দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা। ভারি বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, প্রায় দুই যুগ ধরে চলা জলাবদ্ধতার দুঃখ স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা, তালা, কলারোয়া, যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর, খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও পাইকগাছার মানুষ প্রতি বছর পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। ভারী বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে কপোতাক্ষ, বেতনাপাড়ের ও ভবদহের জনপদ। ২০০০ ও ২০১১ সালে এ অঞ্চলে এমন বড় ধরনের বন্যা ও জলাবদ্ধতা হয়েছিল। কিন্তু তখন মানুষ এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি, কেননা ইতোমধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার অনেক প্রকল্প শেষ হয়েছে বা চলমান রয়েছে। প্রকল্পের পর প্রকল্প যখন ব্যর্থ, জলাবদ্ধতা নিরসনের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় মানুষ বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, আসলে এরপর কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে, তাদের কী হবে?
কেন এই অবস্থা: ইউনেস্কো স্বীকৃতি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এই অঞ্চলে অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এই প্রশস্ত সুন্দরবন যেমন বিশ্বের প্রাকৃতিক বিষয়াবলীর অন্যতম, তেমনি এর পার্শ্ববর্তী এলাকার জীব-বৈচিত্র্য ও জনপদ তেমন সমৃদ্ধ।
বিগত কয়েক দশক বা তার আগে দেশের এই অঞ্চলে যে বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবনধারা ছিল, বর্তমানে তা আর নেই। নদী, খালবিল, নৌকা, ম্যানগ্রোভ গাছ, ঝোপঝাড়, কৃষিপণ্য, মাছ, পশুপাখি এবং আরও অনেক কিছুর আর দেখা মেলে না। জোয়ার-ভাটার খেলা, গয়না নৌকা, টাবুরে নৌকা, পাল নৌকা, ভাটিয়ালি সুরে গান আর নেই। একসময় কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থান পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভিড়ত পাটকেলঘাটা, চৌগাছা জাহাজ বন্দরে। ঘাটে ঘাটে ভিড়ত স্টিমার, লঞ্চ। কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে আর অধিকাংশটা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সবই নষ্ট হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অসংখ্য নদী ও তার শাখা-প্রশাখা দিয়ে গঠিত, যার পানি বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানিতে মিশে যেত। পোতাক্ষ, বেতনা, শালতা, মরিচাপ, গোয়ালঘেশিয়া, খোলপেটুয়া ইত্যাদি একসময় প্রবহমান ও গতিশীল ছিল, জনপদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনত; কিন্তু এখন এগুলো মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়েছে। এখন ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত হয় না।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এই সরু নদীগুলো দিয়ে সাগরের পানি উপরে উঠে আসছে। উপরের উজান প্রবাহ না থাকায় পলি জমে নদী ভরাট প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নদী মৃত্যুর পেছনে প্রধান দুটি কারণ দেখছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, এই অঞ্চলের নদী এবং এর উপনদীগুলো পদ্মা নদী এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কয়েকটি নদীর সাথে যুক্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা ব্যারেজ এবং আরও কিছু বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত পানি প্রত্যাহার করায় এ অঞ্চলের নদীগুলো উজানের পানির প্রবাহ ও উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উজানের পানির অভাবে নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে গতি হারিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, নদী ও তার পার্শ্বে অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্থাপনা নির্মাণ যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিশেষত ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে ১৯৬০ সালের দিকে শুরু হয় উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণের কাজ। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালের উপর্যুপরি ভয়াবহ বন্যার পর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানের লক্ষ্যে ১৯৫৭ সনে জাতিসংঘের অধীনে গঠিত ক্রগ মিশন’র সুপারিশক্রমে উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়। এই পানিনীতিতে এ অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদীর গতি প্রকৃতি, জীববৈচিত্র ও জীবনযাত্রার প্রণালীর বিষয়টি বিবেচিত হয়নি।
সবুজ বিপ্লব লবণাক্ততা, বন্যা এবং ক্ষয় থেকে নদীর পার্শ্ববর্তী জমিগুলিকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। আগে জোয়ার-ভাটার সময় পলি নদীর পার্শ্ববর্তী জমিতে ছড়িয়ে পড়ত এবং উর্বরতা বৃদ্ধি করত। কিন্তু বাঁধগুলোর কারণে পলি পার্শ্ববর্তী জমিতে না ছড়িয়ে নদীর তলদেশে জমা করতে থাকে। একসময় দেখা যায়, আশপাশের অববাহিকার চেয়ে অনেক জায়গায় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। এরপর ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে বাস্তবায়িত খুলনা-যশোর ড্রেনেজ পুনর্বাসন প্রকল্প (কেজেডিআরপি) পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। বিভিন্ন সময়ে অপরিকল্পিতভাবে পোলডার, বাঁধ, বেড়িবাঁধ তৈরি, নদী ও নদীর সাথে সংযুক্ত খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো নদী ভরাটের প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুততর করেছে।
কপোতাক্ষের ওপর সেতু রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে ১৫টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে, এ অঞ্চলের নদী ও তার শাখা প্রশাখাসমূহ মরে গেছে বা যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সুন্দরবনে কোনো নদী থাকবে না বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্পের পর প্রকল্প: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকার অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিগত কয়েক দশকে ভবদহ এলাকায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর ভরাট রোধ এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে চার বছর মেয়াদী ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৪ হাজার টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
সবচেয়ে বড় হচ্ছে, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের ১ম পর্যায় ও ২য় পর্যায়। স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত চারদলীয় জোট সরকার একটি প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ২০১১ সালে শেখ হাসিনা সরকার প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা করে এবং নাম দেওয়া হয় ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)’। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পটির প্রধান দুটি বিষয় ছিল নদী খনন এবং তালা উপজেলার জালালপুর, খেশরা ও মাগুরা ইউনিয়নে অবস্থিত পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন। খনন কাজ ও টিআরএম বাস্তবায়নে পাখিমারা বিলে পলি অবক্ষেপিত হয়ে কপোতাক্ষ কিছুটা গতিশীল হলেও তা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের ২য় পর্যায় গ্রহণ করে সরকার। প্রকল্পের ২য় পর্যায়ের বিষয়টি খাতা কলমে থাকলেও, অর্থ ছাড়সহ নানা জটিলতার কারণে বাস্তবে কোনো কর্মকাণ্ড লক্ষণীয় নেই। ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়া প্রকল্পটি এক বছর বাড়ানো হয়েছে ও বর্তমান পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে চলমান প্রকল্প হিসেবে দেখা যায়।
দ্বিতীয় পর্বের নদী খনন, পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার, টিআরএম চালু করাসহ নানা কাজ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে। টিআরএম-ভুক্ত বিলের জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় তারা তাদের জমি নিজেদের দখলে চাষাবাদ ও মাছ চাষ করছেন। ফলে সরকারের প্রায় ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প এক প্রকার ভেস্তে গেছে।
প্রকল্প নিয়ে নয়ছয়: প্রথম থেকে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় লোকদের দাবি ছিল, যেহেতু বিষয়টি এই এলাকার মানুষের জীবনমরণ সম্পর্কিত; অতএব প্রকল্পটি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো প্রকার নয়ছয় সহ্য করা হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সেটাই ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের নামে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও ঠিকাদারসহ একটি স্বার্থবাদী চক্রের অবৈধ অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
প্রথম থেকে অভিযোগ ওঠে, কপোতাক্ষ নদের মূল ডিজাইন অনুযায়ী খনন, পলি অপসারণ ও অন্যান্য কাজ করা হয়নি। খননে খননযন্ত্র ব্যবহারের কোনো অবকাশ ছিল না, ম্যানুয়ালি করার কথা ছিল, কিন্তু তা মানা হয়নি। ঝুড়ি-কোদাল দিয়ে নদ খননের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, কিন্তু সেটাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয়। প্রকল্পের বছর অনুযায়ী কাজ ঠিকমত শুরু ও শেষ না করা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নদীর সীমানা চিহ্নিত করে, কাদা এবং পলি নদের তলদেশের পরিবর্তে সঠিক সীমানায় রাখার কথা ছিল। অনেক জায়গায় গেছে কোনমতে খনন করে মাটি নদের মধ্যেই রাখা হয়েছে। ফলে বৃষ্টিতে মাটি আবার নদে এসে পড়ছে। না হয় কৃষকের জমি নষ্ট করছে। কোথাও যতটুকু খননের কথা, সেটা না করারও অভিযোগ রয়েছে। অপরিকল্পিত সেতুর কারণে অনেক স্থানে খনন করা যায়নি। কচুরিপানা পরিষ্কারের কথা থাকলেও তা সরানো হয়নি। বৃক্ষরোপণের কথা থাকলেও অনেক স্থানে নদের তীরে কোথাও গাছ লাগাতে দেখানো যায় না। আর এই সব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে আইএমইডি প্রতিবেদনে। ইস্কার্ফ কনসালটিং সার্ভিসেস নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। তাছাড়া বিষয়গুলো নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
অনেকের অভিযোগ ছিল, প্রকল্পের কোনো কাগজপত্র সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন বা তালা উপজেলা প্রশাসনের কাছে দেওয়া হয়নি ও তাদের কিছু জানানোও হয়নি। প্রকল্পের কাজ হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলায় আর অফিস যশোরে। ফলে বিষয়টি নিয়ে অনেকে অন্ধকারে ছিল।
কপোতাক্ষ সমস্যা সমাধানের পথ: অনেকের মতে, উজানের সাথে কপোতাক্ষের সংযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। পদ্মার পানি পেলে নদ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খনন হয়ে যাবে।
মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে ভৈরব নদীর একটি সংযোগ তৈরি করে উজানের পানি ভৈরব এবং কপোতাক্ষে নিয়ে আসার প্রস্তাবটি সরকারী দপ্তরে ফাইলবন্দী রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
আবার উৎপত্তিগত কারণে পদ্মার সাথে কপোতাক্ষের সংযোগ দেওয়া বেশ জটিল। কপোতাক্ষ নদ ভৈরব নদীর একটি শাখা নদী। ইছামতী নদী কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি শাখা ভৈরব নামে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কোটচাঁদপুরের দক্ষিণে ভৈরব থেকে একটি শাখা বের হয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে খুলনা জেলার পাইকগাছার কাছে শিবসা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভৈরবের এ শাখাই কপোতাক্ষ। আবার কপোতাক্ষের উৎপত্তি মাথাভাঙ্গা নদী থেকে। এ উৎপত্তি স্থলে মাথাভাঙ্গার একটি বিরাট বাঁক ছিল। নদীর পথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য একটি খাল খনন করে মাথাভাঙ্গার মূল স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করা হলে মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কপোতাক্ষের সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে ভৈরব থেকে মূল স্রোতধারা পেয়ে থাকে। পদ্মা নদীর সঙ্গে মাথাভাঙ্গা এবং মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কপোতাক্ষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে কপোতাক্ষের স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মাথাভাঙ্গা নদী দর্শনা থেকে ভারতে চলে গেছে। ভারত তাদের অংশ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বৃষ্টি এবং চোয়ানো পানিই এর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায় এবং কপোতাক্ষ অধিকাংশ স্থানেই নাব্যতা হারায়।
আবার অর্থ খরচ করে প্রকল্প করে পদ্মার সাথে সংযোগ দিলেও উজানের পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই পানি পায় না। যে কারণে দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের পাম্পগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে।
নদী-খাল দখল ও প্রকল্পের সমন্বয়হীনতা: একটা নদীর শাখা-প্রশাখাগুলো তার জীবন। এগুলো অচল হয়ে গেলে নদীও অচল হয়ে যায়। সরকারের ভুলনীতি, অবহেলা ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে এই অঞ্চলের হাজার হাজার খাল, ছোট নদী ও জলমহাল দখল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা প্রভাবশালীরা এই এলাকার খাল, ছোট নদী ও জলমহালগুলো দীর্ঘ মেয়াদী ইজারা নিয়ে আসছে। ইজারা নেওয়ার পর সেগুলো আবার খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়, অনেকে আবার স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করে একেবারে পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে।
পুরো অঞ্চলে গড়ে উঠেছে নদী-খাল-জলমহাল-খাস জমি দখলকারী চক্র। সম্প্রতি পেপার-পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের হরিহরনগর মৌজার ৩৩ বিঘা জলমহাল প্রায় সাত বছর ধরে দখল করে আছে। ২০১৭ সালে ওই ব্যক্তি জাল দলিল ও কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয় এবং স্থানীয় প্রশাসন ও জনসাধারণকে বোকা বানিয়ে উক্ত জলমহাল দখল করে নেয়। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত দলিলটি জাল হিসেবে ঘোষণা করে জব্দ করে এবং খাস খাল হিসেবে নতিভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জাল দলিলকারী চক্র বিষয়টি সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে ও হাইকোর্টে আপীল করে। সেখানেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে। এসব কিছুর পরও প্রভাব খাটিয়ে এই চক্র এই জলমহাল দখল অব্যাহত রেখেছে। জাল দলিল বা কাগজপত্র বানিয়ে নদী-খাল-জলমহাল-খাস জমি দখলের এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে এই এলাকায়।
খাল বা নদী কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না। দেখা যায়, অনেকে রাজনৈতিক প্রভাবে বা টাকার বিনিময়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের অফিস বা সচিবালয় থেকে নদী-খাল-জলমহাল দীর্ঘমেয়াদী ইজারা নিয়ে যায়। আর একবার এগুলো দখলবাজদের হাতে চলে গেলে তারা যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার শুরু করে। বিশেষ করে ঘনঘন বাঁধ দেওয়ার কারণে পানির সাধারণ প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
কপোতাক্ষ প্রকল্পের সুফল না পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল সমন্বয়হীনতা। একটা প্রকল্প তৈরি করা, কিছু কাজ করা আর টাকা ছাড়-উত্তোলন করাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সংগঠন ও স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সমন্বয় থাকে না। একদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নদী খনন করা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই নদীর প্রাণ ছোট ছোট খালগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি, ৯৯ বছরের জন্য বা চিরস্থায়ীভাবে ইজারা দেওয়া হচ্ছে।
কপোতাক্ষ প্রকল্পে টিআরএম বাস্তবায়ন হল পাখিমারা বিলে। অথচ এই বিলের পাশে চরের বিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চরের বিলের সব খাল ২-৩ বিঘা করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ৯৯ বছর মেয়াদী ইজারা দেওয়া হয়েছে। সবাই এমনভাবে কাজ করছে, কোনোমতে বোঝার উপায় নেই, এই বিলে কোন সময় খাল ছিল। সরকারি বিধিতে আছে, ভূমিহীন পরিবারের লোকেরা তিন বিঘা করে খাসজমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিতে পারবে। কিন্তু প্রকৃত ভূমিহীনরা এটা পেয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে। তাছাড়া প্রবহমান নদী, খাল বা জলমহাল খাস দেখিয়ে ভূমিহীনদের দিতে হবে কেন? এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি হচ্ছে।
প্রসারিত হচ্ছে চিংড়ি চাষ: চারদিকে শুধু পানি আর পানি। বেড়েই চলেছে লবণাক্ত, তখন মাছ চাষই ভরসা। আশির দশকের মাঝামাঝি শুরু হয় চিংড়ি চাষ। প্রাথমিকভাবে চিংড়ি চাষ উপকূলীয় অঞ্চলে পরিচালিত হয়েছিল। তবে বর্তমান পরিবেশের কারণে কৃষিজমি অঞ্চলে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে নতুন কৃষিজমি চিংড়ি চাষের আওতায় নিয়ে আসা বা কৃত্রিম লবণাক্ততা সৃষ্টি করে পরিবেশের অবনতি ও জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদনে জ্ঞানের অভাব, ভাইরাস ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব, মাছের পোনা ও খাবারের উচ্চমূল্য, সরকারের যথাযথ সহায়তার অভাব, সহজলভ্য ঋণ সুবিধা, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি, হেক্টর প্রতি কম উৎপাদন ইত্যাদি কারণে চিংড়ি চাষিরা নাভিশ্বাসে থাকে। এরপর প্রতি বছর জলাবদ্ধতা আর বন্যায় ভেসে যায় শেষ আশাটুকুও। জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় পানি হয়ে ওঠে বিষাক্ত, মাছ চাষের পরিবেশ থাকে না।
কৃষি উৎপাদন নেই, মাছ চাষও ঠিকমত হচ্ছে না, যা সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র কৃষকদের চরম দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। এই অঞ্চলের ৬০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। তাদের নিয়ে কীভাবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (গউএং) অর্জন সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকার একের একের প্রকল্প নিচ্ছে, আর টাকা ঢালছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। আসলে আমাদের মূল সমস্যা ও কারণগুলো সনাক্ত করা সময়ের দাবি। এই অঞ্চলের এ সংকট জিইয়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক উপায়ে এর সমাধান না খোঁজা। কারণ, কপোতাক্ষসহ এ এলাকার নদীগুলো সাগরের সঙ্গে সংযোগ ও জোয়ার–ভাটার সম্পর্ক। জলবায়ু পরিবর্তন বা সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবের বিষয়টাও বিবেচনায় আনতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সংকট সমাধানে সরকারকে গবেষণাভিত্তিক ও যথাযথ মনোযোগ দিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত।
অনেক পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে অনেক রয়েছে। যদি সংকট সমাধানের কোন পথ না থাকে, তাহলে শুধু মুখস্থ প্রকল্প আর অর্থ অপচয় নয়। জলাবদ্ধতাকে যদি আমাদের মেনে নিতে হয়, তাহলে জলের সাথে কীভাবে বসবাস করা যায়, সেই ধরনের প্রকল্প নেওয়ার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
মনজুরুল আলম মুকুল: গণমাধ্যমকর্মী
দৈনিক আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ