ঢাকা ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একমাস: নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশায়

  • আপডেট সময় : ১১:২০:১১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ২৫ বার পড়া হয়েছে

ইমতিয়াজ মাহমুদ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একমাস ধরে ক্ষমতায় আছে। এই একমাসে ওদের কোনো রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়নি, উল্লেখযোগ্য কোনো বাধাবিঘ্ন আসেনি তাদের কাজে। কেউ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি বা এখনো কেউ সরকারকে পদত্যাগ করতে বলেনি।
যে পরিস্থিতিতে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে এবং যে রূপে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সেইসব কারণে কোনো রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ বা ব্যক্তি ওদের প্রতি অসন্তোষ অনুভব করছে না। আর দেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে বড় শক্তি, আওয়ামী লীগ ও ওদের মিত্ররা, ওরা তো সদ্য ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছে, ওদের দলের প্রধানকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ওদের শীর্ষ নেতারা হয় পালিয়েছে অথবা কারাগারে আছে।
ওরা তো ব্যাকফুটেই আছে, এই মুহূর্তে পদের পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের বিরোধ করা বা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তাছাড়া ওদের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে জনমতও অত্যন্ত প্রবল। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধুচন্দ্রিমাকাল চলছে, এই সময় ওদের কোনো কাজ বা নীতি ইত্যাদি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না।
একমাস খুব দীর্ঘ সময় না হলেও একটি সরকারের নীতি, লক্ষ্য এবং কার্যপ্রণালী ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশের জন্য একমাস নিতান্ত কম নয়। যেকোনো সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে প্রথম কিছুদিনের মধ্যেই সরকারের নীতিগত অবস্থান কোনো না কোনোভাবে স্পষ্ট হয়। সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোই সরকার গঠন করে থাকে ফলে যারা সরকারে যায় ওদের রাজনৈতিক নীতি আদর্শ এইসব এমনিতেই মানুষের কিছুটা জানা থাকে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর বোঝা যায় এরা কোনদিকে যাবে। এই সরকার কোনো একটি রাজনৈতিক দলের বা জোটের সরকার নয়। আমাদের জানা কোনো আইন বা বিধিবিধান দ্বারাও এই সরকার গঠিত হয়নি। সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে সব উপদেষ্টাই দেশের চেনাজানা পরিচিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তি। ওদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামতও আমরা জানি।
তথাপি সরকার হিসেবে ওরা কী করতে চান, কীভাবে করতে চান, কোন পদ্ধতিতে করতে চান সেগুলো তো আর আপনি এইসব ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত থেকে অনুমান করতে পারবেন না। এর মধ্যে সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাজশাহীতে ইসলামি ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সম্প্রতি কিছু কিছু ব্যক্তি জাতীয়সংগীত পরিবর্তনের দাবি উত্থাপন করেছে তা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. খালিদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা হলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমাদের দায়িত্ব আইন-পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করা। আগে সবকিছু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনব। এরপর আমরা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজিয়ে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করব। এরপর নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেব।’
ধর্ম উপদেষ্টার কথাটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৌলিক নীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে এবং এই নীতিটা বর্তমান সরকারের কাজের ধরনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণও বটে। কেননা সরকারের ধরন যেখানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সেখানে সরকারের আসলেই মৌলিক কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পরিবর্তন করার কথা নয়।

পুরোনো নীতি পরিবর্তন বা নতুন নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সরকার কোনটা করতে পারে আর কোনটা করতে পারে না এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে, তর্ক হতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে কোনো তর্ক নেই, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা।
এটা নিয়ে কোনো বিবাদ নেই যে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনেরও অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্যায় ও নির্মম হস্তক্ষেপ বা অন্যভাবে বললে, মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে ৩১ জুলাই ২০২৪ ঢাকা পোস্ট-ই ‘আরব বসন্ত আমাদের কী শেখায়?’-এই শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম।
তাতে বলেছিলাম, উন্নয়ন যে অর্থেই হোক বা যত ব্যাপকই হোক, উন্নয়ন দিয়ে কোনো সরকার চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মানুষের অধিকারে যখন কেউ হস্তক্ষেপ করে তখন মানুষ তাকে উৎখাত করবেই। ইতিহাসে এর উদাহরণ রয়েছে অজস্র। ইংরেজিতে লিবার্টি বলে একটা কথা আছে, কথা বলার অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার এবং আদালত কর্তৃক সেইসব অধিকারের প্রয়োগ এইসব অধিকার মিলিয়েই-লিবার্টি।
বাকস্বাধীনতা কী? ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লব হয়। বিপ্লবের কিছুদিন পরেই জার্মান কমিউনিস্ট নেতা রোজা লুক্সেমবার্গ (জড়ংধ খীঁবসনঁৎম) রুশ বিপ্লবের ওপর ছোট একটা বই লিখেছিলেন, সেই বইয়ের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টি (ইড়ষংযবারশং) যদি নাগরিকদের লিবার্টি নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে বিপ্লব ব্যর্থ হবে।
আর লিবার্টি কী, সেটা তিনি বলেছিলেন এইভাবে যে, লিবার্টির অর্থ হলো, ভিন্নমতের লিবার্টি। সংখ্যাগুরুর স্বাধীনতা কোনো স্বাধীনতা নয় বা ক্ষমতাসীন দলের স্বাধীনতা কোনো স্বাধীনতা নয়। যে লোকটি সংখ্যাগুরুর মুখের ওপর সংখ্যাগুরুর অপছন্দের কথাটা বলে তার স্বাধীনতাই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। রোজা লুক্সেমবার্গ জার্মান ভাষায় লিখেছেন কিন্তু ইংরেজিতে তার এই কথাটা একটা জনপ্রিয় উদ্ধৃতিতে পরিণত হয়েছে যে, ‘ষরনবৎঃু সবধহং ষরনবৎঃু ড়ভ ঃযব ফরংংবহঃবৎ’
সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি দল রোজা লুক্সেবার্গের কথাটি সিরিয়াসলি নেয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নে কার্যত কোনো বাকস্বাধীনতা ছিল না, এমনকি ওদের পার্টির অভ্যন্তরেও নয়। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে নানারকম ঠাট্টা তামাশা চলতো।
একটা কৌতুক ছিল এরকম যে, মস্কো থেকে কয়েকজন বড় বড় পণ্ডিত সম্পাদক পদবীর ব্যক্তি গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি সফরে। ওয়াশিংটন এয়ারপোর্টে ওদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক সম্পাদক। তিনি রাশিয়ার সম্পাদককে বললেন, দেখুন কমরেড, আমাদের দেশে আমরা যা খুশি তাই বলতে পারি, আমরা চাইলে আমাদের প্রেসিডেন্টকেও তীব্র সমালোচনা করতে পারি, চাইলে দুটা গালিও দিয়ে দিতে পারি। সে কথা শুনে গম্ভীর কণ্ঠে মস্কোর সম্পাদক বললেন, এ আর এমনকি, আমরা তো রাতদিন আপনাদের প্রেসিডেন্টকে গালিই দিই।
এই যে লিবার্টি না থাকা, এর ফল কি হয়েছিল সেটা আপনারা জানেন। মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা, মানুষের প্রাণ রক্ষা করা, মানুষের জন্যে আইনের শাসনের অধিকার রক্ষা করা এইগুলো কোনো নতুন সিদ্ধান্ত নয় বা কোনো অভিনব বিষয় নয়। এইসব হচ্ছে যেকোনো সরকারের অনিবার্য দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তো সেই সরকার কার্যত ব্যর্থ।
ধর্ম উপদেষ্টা যে কথাটি বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করণীয় সম্পর্কে, সেখানে কিন্তু তিনি এই কথাটিই বলছেন-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি স্থিতিশীল করা। এই কাজটি কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিকঠাক করতে পেরেছে?

মাত্র একমাস পার হয়েছে, এখনো হয়তো এই কথাটি বলার সময় আসেনি। কিন্তু সরকার কি শুভ সূচনা করতে পেরেছে? এইখানে আমি বলবো যে না, সরকার এই বিষয়টিতে শুভ সূচনা করতে বা সে রকম কোনো ইঙ্গিত দিতে এখনো সমর্থ হয়নি। ভিন্নমতের কারণে এখনো মানুষের ওপর হামলা হচ্ছে। টেলিভিশনের খবরগুলো দেখে এখনো মনে হয় না যে ওরা স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করতে পারছে।
খুলনায় উৎসব মণ্ডলের সাথে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে কি তার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে? উৎসব মণ্ডল বেঁচে আছে কিনা আমরা কেউ নিশ্চিত নই। ছেলেটা কোথায় আছে জানি না। এইটুকু কেবল নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, উৎসব মণ্ডলের লিবার্টি নিশ্চিত করতে পারেনি আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একমাস: নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশায়

আপডেট সময় : ১১:২০:১১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ইমতিয়াজ মাহমুদ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একমাস ধরে ক্ষমতায় আছে। এই একমাসে ওদের কোনো রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়নি, উল্লেখযোগ্য কোনো বাধাবিঘ্ন আসেনি তাদের কাজে। কেউ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি বা এখনো কেউ সরকারকে পদত্যাগ করতে বলেনি।
যে পরিস্থিতিতে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে এবং যে রূপে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সেইসব কারণে কোনো রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ বা ব্যক্তি ওদের প্রতি অসন্তোষ অনুভব করছে না। আর দেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে বড় শক্তি, আওয়ামী লীগ ও ওদের মিত্ররা, ওরা তো সদ্য ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছে, ওদের দলের প্রধানকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ওদের শীর্ষ নেতারা হয় পালিয়েছে অথবা কারাগারে আছে।
ওরা তো ব্যাকফুটেই আছে, এই মুহূর্তে পদের পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের বিরোধ করা বা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তাছাড়া ওদের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে জনমতও অত্যন্ত প্রবল। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধুচন্দ্রিমাকাল চলছে, এই সময় ওদের কোনো কাজ বা নীতি ইত্যাদি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না।
একমাস খুব দীর্ঘ সময় না হলেও একটি সরকারের নীতি, লক্ষ্য এবং কার্যপ্রণালী ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশের জন্য একমাস নিতান্ত কম নয়। যেকোনো সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে প্রথম কিছুদিনের মধ্যেই সরকারের নীতিগত অবস্থান কোনো না কোনোভাবে স্পষ্ট হয়। সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোই সরকার গঠন করে থাকে ফলে যারা সরকারে যায় ওদের রাজনৈতিক নীতি আদর্শ এইসব এমনিতেই মানুষের কিছুটা জানা থাকে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর বোঝা যায় এরা কোনদিকে যাবে। এই সরকার কোনো একটি রাজনৈতিক দলের বা জোটের সরকার নয়। আমাদের জানা কোনো আইন বা বিধিবিধান দ্বারাও এই সরকার গঠিত হয়নি। সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে সব উপদেষ্টাই দেশের চেনাজানা পরিচিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তি। ওদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামতও আমরা জানি।
তথাপি সরকার হিসেবে ওরা কী করতে চান, কীভাবে করতে চান, কোন পদ্ধতিতে করতে চান সেগুলো তো আর আপনি এইসব ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত থেকে অনুমান করতে পারবেন না। এর মধ্যে সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাজশাহীতে ইসলামি ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সম্প্রতি কিছু কিছু ব্যক্তি জাতীয়সংগীত পরিবর্তনের দাবি উত্থাপন করেছে তা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. খালিদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা হলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমাদের দায়িত্ব আইন-পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করা। আগে সবকিছু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনব। এরপর আমরা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজিয়ে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করব। এরপর নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেব।’
ধর্ম উপদেষ্টার কথাটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৌলিক নীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে এবং এই নীতিটা বর্তমান সরকারের কাজের ধরনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণও বটে। কেননা সরকারের ধরন যেখানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সেখানে সরকারের আসলেই মৌলিক কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পরিবর্তন করার কথা নয়।

পুরোনো নীতি পরিবর্তন বা নতুন নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সরকার কোনটা করতে পারে আর কোনটা করতে পারে না এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে, তর্ক হতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে কোনো তর্ক নেই, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা।
এটা নিয়ে কোনো বিবাদ নেই যে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনেরও অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্যায় ও নির্মম হস্তক্ষেপ বা অন্যভাবে বললে, মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে ৩১ জুলাই ২০২৪ ঢাকা পোস্ট-ই ‘আরব বসন্ত আমাদের কী শেখায়?’-এই শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম।
তাতে বলেছিলাম, উন্নয়ন যে অর্থেই হোক বা যত ব্যাপকই হোক, উন্নয়ন দিয়ে কোনো সরকার চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মানুষের অধিকারে যখন কেউ হস্তক্ষেপ করে তখন মানুষ তাকে উৎখাত করবেই। ইতিহাসে এর উদাহরণ রয়েছে অজস্র। ইংরেজিতে লিবার্টি বলে একটা কথা আছে, কথা বলার অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার এবং আদালত কর্তৃক সেইসব অধিকারের প্রয়োগ এইসব অধিকার মিলিয়েই-লিবার্টি।
বাকস্বাধীনতা কী? ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লব হয়। বিপ্লবের কিছুদিন পরেই জার্মান কমিউনিস্ট নেতা রোজা লুক্সেমবার্গ (জড়ংধ খীঁবসনঁৎম) রুশ বিপ্লবের ওপর ছোট একটা বই লিখেছিলেন, সেই বইয়ের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টি (ইড়ষংযবারশং) যদি নাগরিকদের লিবার্টি নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে বিপ্লব ব্যর্থ হবে।
আর লিবার্টি কী, সেটা তিনি বলেছিলেন এইভাবে যে, লিবার্টির অর্থ হলো, ভিন্নমতের লিবার্টি। সংখ্যাগুরুর স্বাধীনতা কোনো স্বাধীনতা নয় বা ক্ষমতাসীন দলের স্বাধীনতা কোনো স্বাধীনতা নয়। যে লোকটি সংখ্যাগুরুর মুখের ওপর সংখ্যাগুরুর অপছন্দের কথাটা বলে তার স্বাধীনতাই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। রোজা লুক্সেমবার্গ জার্মান ভাষায় লিখেছেন কিন্তু ইংরেজিতে তার এই কথাটা একটা জনপ্রিয় উদ্ধৃতিতে পরিণত হয়েছে যে, ‘ষরনবৎঃু সবধহং ষরনবৎঃু ড়ভ ঃযব ফরংংবহঃবৎ’
সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি দল রোজা লুক্সেবার্গের কথাটি সিরিয়াসলি নেয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নে কার্যত কোনো বাকস্বাধীনতা ছিল না, এমনকি ওদের পার্টির অভ্যন্তরেও নয়। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে নানারকম ঠাট্টা তামাশা চলতো।
একটা কৌতুক ছিল এরকম যে, মস্কো থেকে কয়েকজন বড় বড় পণ্ডিত সম্পাদক পদবীর ব্যক্তি গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি সফরে। ওয়াশিংটন এয়ারপোর্টে ওদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক সম্পাদক। তিনি রাশিয়ার সম্পাদককে বললেন, দেখুন কমরেড, আমাদের দেশে আমরা যা খুশি তাই বলতে পারি, আমরা চাইলে আমাদের প্রেসিডেন্টকেও তীব্র সমালোচনা করতে পারি, চাইলে দুটা গালিও দিয়ে দিতে পারি। সে কথা শুনে গম্ভীর কণ্ঠে মস্কোর সম্পাদক বললেন, এ আর এমনকি, আমরা তো রাতদিন আপনাদের প্রেসিডেন্টকে গালিই দিই।
এই যে লিবার্টি না থাকা, এর ফল কি হয়েছিল সেটা আপনারা জানেন। মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা, মানুষের প্রাণ রক্ষা করা, মানুষের জন্যে আইনের শাসনের অধিকার রক্ষা করা এইগুলো কোনো নতুন সিদ্ধান্ত নয় বা কোনো অভিনব বিষয় নয়। এইসব হচ্ছে যেকোনো সরকারের অনিবার্য দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তো সেই সরকার কার্যত ব্যর্থ।
ধর্ম উপদেষ্টা যে কথাটি বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করণীয় সম্পর্কে, সেখানে কিন্তু তিনি এই কথাটিই বলছেন-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি স্থিতিশীল করা। এই কাজটি কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিকঠাক করতে পেরেছে?

মাত্র একমাস পার হয়েছে, এখনো হয়তো এই কথাটি বলার সময় আসেনি। কিন্তু সরকার কি শুভ সূচনা করতে পেরেছে? এইখানে আমি বলবো যে না, সরকার এই বিষয়টিতে শুভ সূচনা করতে বা সে রকম কোনো ইঙ্গিত দিতে এখনো সমর্থ হয়নি। ভিন্নমতের কারণে এখনো মানুষের ওপর হামলা হচ্ছে। টেলিভিশনের খবরগুলো দেখে এখনো মনে হয় না যে ওরা স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করতে পারছে।
খুলনায় উৎসব মণ্ডলের সাথে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে কি তার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে? উৎসব মণ্ডল বেঁচে আছে কিনা আমরা কেউ নিশ্চিত নই। ছেলেটা কোথায় আছে জানি না। এইটুকু কেবল নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, উৎসব মণ্ডলের লিবার্টি নিশ্চিত করতে পারেনি আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট