নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ দুই থেকে তিন বছর হওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকরা। তারা মনে করেন, দেশের সংস্কার কাজ করতে যতটুকু যৌক্তিক সময় প্রয়োজন ততটুকু সময় এ সরকারকে দিতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সম্পাদকরা এ মত দেন। মতবিনিময় সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ২০ জন সম্পাদক অংশ নেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৈঠক-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
প্রেস সচিব বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ে তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেন যৌক্তিক সময় পর্যন্ত থাকে। এ বিষয়ে ড. ইউনূস সম্পাদকদের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই যৌক্তিক সময় আসলে কতটুকু? এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কী কী কাজ করতে হবে? ন্যূনতম কতটুকু কাজ করতে হবে?
শফিকুল আলম জানান, সম্পাদকদের তরফ থেকে বিভিন্ন রকম কথা এসেছে, সর্বনিম্ন যে সময়টা এসেছে সেটা হলো ২ বছর। অনেকে আবার দুই থেকে তিন বছরের কথা বলেছেন। শফিকুল আলম বলেন, বেশির ভাগ সম্পাদক বলেছেন, যেসব এজেন্ডার বাস্তবায়ন বা যে কাজটা অন্তর্বর্তী সরকার করবে সেই কাজটাই আসলে নির্ধারণ করবে এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ প্রসঙ্গে সম্পাদকদের বক্তব্যে যেসব পরামর্শ উঠে এসেছে সেগুলো তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, অনেক কথা এসেছে- সংবিধান সংশোধন, সংবিধান নতুন করে লেখা, আইন কমিশন, সংবিধান কমিশন, মিডিয়া কমিশন, পুলিশের জন্য কমিশন, পুলিশকে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়, নির্বাচন কমিশন সংস্কার। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ এসেছে। শফিকুল আলম জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে উল্লেখ করে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ, বাংলাদেশের জন্য, আমাদের সবার জন্য; রাষ্ট্র মেরামত করার জন্য। বাংলাদেশকে নতুন শিখরে নেওয়ার জন্য। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান আমাদের এ সুযোগ দিয়েছে, এটিকে কাজে লাগাতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দোষ-ত্রুটি নিয়ে লেখার অনুরোধ জানিয়ে ড. ইউনূস সম্পাদকদের বলেছেন, আপনারা লিখবেন, প্রচুর লিখেন। আপনারা জানান, আমাদের যদি দোষ-ত্রুটি থাকে এগুলো নিয়েও আপনারা বলেন। আমরা আপনাদের কাছ থেকে শুনতে চাই। প্রেস সচিব বলেন, ড. ইউনূস বারবার বলেছেন, তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন এবং ভাইব্রেন্ট মিডিয়া দেখতে চান। শফিকুল আলম জানান, সম্পাদকরা বলেছেন, মিডিয়াতে যেসব কালা কানুন আছে সেই কালাকানুনগুলো যাতে বাদ দেওয়া হয়, সংশোধন করা হয়। সবাইকে স্বাধীন এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করার অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। মিডিয়া কমিশন করার প্রস্তাব এসেছে জানিয়ে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যাতে কোনো সাংবাদিক কোনো অসুবিধায় না পড়েন সে বিষয়ে একটা মিডিয়া কমিশন করার প্রস্তাব এসেছে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনাধীন আছে।
যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম মাহফুজ আনাম বলেন, “তিনি (ড. ইউনূস) আমাদেরকে বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন এবং আমাদের কাছে তার বিশেষ আবেদন হচ্ছে, আমরা যেন আমাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা, তারপর বিভিন্ন সাজেশন যেটা আমাদের থাকে সেটা তিনি খুব সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন।”
মাহফুজ আনাম আরও বলেন, “তিনি (প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কাছে আহ্বান করেছেন যে, এই সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি যেন আমরা ধরিয়ে দিই। তিনি বলেছেন, আমরা যেন সোচ্চারভাবে এই সরকারের ভুল ত্রুটি নির্দ্বিধায় কাগজে ছাপি এবং এই সরকারকে সহযোগিতা করি।”
ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, “বহির্বিশ্বে আমাদের বাংলাদেশের যে ভাইয়েরা আন্দোলনের শরিক হয়েছিলেন এবং ওখান থেকে আমাদের দেশের পরিবর্তনে ছাত্রদের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, ওখানকার সরকার তাদের ৫৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেখানকার আমিরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত আনন্দের খবর।” তিনি আরও বলেন, “আজকের আলোচনার ব্যাপারে আমরা সম্পাদকরা যারা একসঙ্গে হয়েছিলাম, আমরা প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা এবং এই সরকারের যে কর্মকাণ্ড তার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। আমরা চাই একটা নতুন দিগন্ত বাংলাদেশে উন্মোচিত হোক। সেখানে আমি একজন সম্পাদক হিসেবে যে প্রশ্নটা উপস্থাপন করেছি সেটা হচ্ছে, সাংবাদিকদের নিশ্চয়তা এবং সাংবাদিকদের নামে যে যত্রতত্র খুনের মামলা সেগুলো যেন বন্ধ হয় এবং এই ব্যাপারে সন্তোষজনক সুস্পষ্ট একটা অবস্থান নেন। সাংবাদিকদের যদি সেভাবে দোষ থাকে তারা যদি দুর্নীতির সঙ্গে থাকে সেই ইস্যু নিয়ে আলাদা মামলা হবে কিন্তু এভাবে যেন না হয়।” মাহফুজ আনাম বলেন, “আলোচনার মধ্যে এটা আসছে যে আমরা চাই বাংলাদেশে একটা জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হোক। আমরা বিভিন্নভাবে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত জাতি। আমরা যেন একটা ঐক্য স্থাপন করতে পারি। আমরা এটাও বলেছি যে এই সরকারের কাছ থেকে আমরা কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করছি। এর মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, বিভিন্ন যে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো আছে এন্টি করাপশন কমিশন, হিউম্যান রাইটস কমিশন, নির্বাচন কমিশন, এগুলো রিফর্ম করা। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন যেন ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে জাতির এবং ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটান এমন একটা সংস্থা চাই আমরা।” “আমরা আরেকটা কথা বলেছি, বিএসএস, বিটিভি এবং রেডিও যেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে এদেরকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া, তারা যেন পেশাগতভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।” যোগ করে মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, “যতগুলো কালা-কানুন আছে, সেগুলো যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এ সমস্ত আইন যাতে এটলিস্ট এই মুহূর্তে ঘোষণা হয় যে এইগুলোতে সাংবাদিক নিপীড়নের যে অধ্যায়গুলো আছে এগুলো কার্যকর হবে না এবং এগুলোর রিফর্মটা তারা সময় নিয়ে করবেন।”
ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, “এখানে (বৈঠকে) আরো একটা প্রস্তাব এসেছে যে, কনস্টিটিউটাল রিফর্মের (সংবিধান পরিবর্তন) যে ব্যাপারটা, সেখানে প্রধান উপদেষ্টা যদি মনে করেন একটা গ্রুপ করে দেওয়া, একটা বিশেষ কমিটি করে দিয়ে সব ধরনের আইনের যে পরিবর্তন জুডিশিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্স, পুলিশ রিফর্ম- এগুলো সব কিছু যদি একটা গ্রুপের কাছে হয় বা বিভিন্নভাবে হতে পারে, অথবা এগুলোর আমরা পরিবর্তন চাই এগুলোর আমরা গণতান্ত্রিক রিফর্ম চাই।”