নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে সরকার পতনের ২৭ দিনের মাথায় পদত্যাগ করলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
গতকাল সোমবার তিনি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে বঙ্গভবনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। পরদিন সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়া হলেও স্পিকারের পদ তাৎক্ষণিভাবে শূন্য হয় না। পরবর্তী স্পিকারের শপথ পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে থেকে যান। তবে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে পদত্যাগ করছেন শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে যান। সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। তবে শিরীন শারমিন চৌধুরী আর প্রকাশ্যে আসেননি। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও তিনি যাননি। বিগত সরকারের হোমরা চোমরা কয়েকজনসহ কয়েকশ মানুষ ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রাণভয়ে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে অনেকে নিজে থেকে চলে যান। এখনও অন্তত দুজন এবং তাদের পরিবার সেনা হেফাজতে রয়েছে বলে এর আগে নিশ্চিত করেছিল আইএসপিআর। তাদের মধ্যে একজন শিরীন শারমিন চৌধুরী বলে গুঞ্জন রয়েছেন। তবে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসাবে জাতীয় সংসদে আসেন শিরীন শারমিন। তাকে দেওয়া হয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। নবম সংসদের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর সেই জায়গায় আসেন তখনকার স্পিকার আবদুল হামিদ। এরপর ২০১৩ সালে ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন। তারপর থেকে তিন মেয়াদে তিনিই টানা স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন।
স্পিকার পদে শূন্যতার প্রশ্ন: দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করায় স্পিকার পদে শূন্যতা তৈরি হলো কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ কে করাবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন এসেছে।
বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, পদত্যাগ করলেও নতুন স্পিকার দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত শিরীন শারমিন চৌধুরীই পদে থাকছেন বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংসদের নির্বাচিত স্পিকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত শিরীন শারমিনই স্পিকার হিসেবে গণ্য হবেন। তিনিই নতুন সংসদের সদস্যদের শপথ পড়াবেন। সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদে স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ কীভাবে শূন্য হবে, সে বিধান বলা আছে। সেখানে সংসদ সদস্য পদ না থাকা, পদত্যাগ করাসহ ৫টি কারণে স্পিকারের পদ শূন্য হবে বলে বলা আছে। তবে একই অনুচ্ছেদে বলা আছে, এসব বিধান সত্ত্বেও ক্ষেত্রমতে স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তাঁর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদ জাতীয় সংসদের স্পিকার। সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘স্পিকারের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন’। সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদে সংসদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের বিষয়ে বলা আছে। সংবিধান বলছে, কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সংসদ একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করবে। স্পিকারের পদ শূন্য হবে, যদি তিনি সংসদ সদস্য পদে না থাকেন, মন্ত্রী হন, অপসারণের প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়, পদত্যাগ করেন অথবা কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনো সদস্য তাঁর কার্যভার গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগের ফলে স্পিকার পদে কী হবে, সেটা সংবিধানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। নতুন কেউ দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত তিনিই স্পিকার রয়েছেন বলে গণ্য হবে। নিজাম উদ্দিন বলেন, নতুন নির্বাচন ছাড়া স্পিকার নির্বাচনের সুযোগ সংবিধানে নেই। সংবিধান বাতিল হলে সেটা ভিন্ন কথা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। ৮ আগস্ট অর্ন্তবর্তী সরকার শপথ নেয়। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ২৭ দিনের মাথায় পদত্যাগ করলেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্পিকার নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল স্পিকার নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর পর থেকে তিনিই এ দায়িত্বে রয়েছেন। ৭ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর শিরীন শারমিন চৌধুরীকে আবার স্পিকার নির্বাচিত করা হয়। দেশে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ও সরকার পতনের পরে সহিংসতায় ৭৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্র–জনতা নিহত হওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। রংপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বর্ণশ্রমিক মুসলিম উদ্দিন (৩৮) নিহত হওয়ার ঘটনায় ২৭ আগস্ট শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হককে (টুকু) ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় শামসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একটি হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনি এখন পুলিশ হেফাজতে আছেন। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, পরবর্তী সংসদ না আসা পর্যন্ত স্পিকার তাঁর পদে বহাল থাকেন। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, ডেপুটি স্পিকার বন্দী, তাতে সংবিধান মেনে চলা হলে দেখা যায়, এতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
পদত্যাগ করলেন শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্পিকার পদে শূন্যতার প্রশ্ন
জনপ্রিয় সংবাদ