অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ : ২০০৭ সালের ১/১১ কেন এসেছিলো? উত্তরটা খুবই সহজ: মনোয়ন বাণিজ্য ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে সহানুভূতির রাজনীতিকে নির্মূল করবার প্রচেষ্টা। বিগত ১৪ বছর আমরা কি সেই দুরবস্থা থেকে উত্তরণ লাভ করতে পেরেছি কি? না, বরং সত্যিকার ত্যাগী নেতা- যিনি নিজের ঘুম হারাম করে, পরিবারের সুখ শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে,পরিবারকে সময় না দিয়ে, নিজের অর্জনকে সমাজকে বিলিয়ে দিয়ে সুখী হতে চেষ্টা করেছেন যে মানুষগুলো, জনকল্যাণে নিবেদিত সত্যিকার ত্যাগী নেতাদের ক্ষমতার সিঁড়িতে নানা বাঁধা নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। এখন বাণিজ্য রাজনীতির এক চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সারা দেশে। এই বাণিজ্য রাজনীতির ফলেই ঘটেছিলো ৯/১১ এবং ইরাক -আফগানিস্তান যুদ্ধ। আজ সেই যুদ্ধে রিক্ত হয়ে ফিরেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুরা। সেখানে স্থান পেয়েছে সহানুভূতির রাজনীতি (চড়ষরঃরপং ড়ভ ঊসঢ়ধঃযু)।
বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট জোবাইডেন নিজেকে তালেবানদের চোখে দেখেছেন। এবং সে অবস্থা থেকে উপলব্ধি করেছেন তালেবান তথা আফগানদেরমনোভাব, সংস্কৃতি , রাজনীতি , সমাজ নীতি প্রভৃতিকে। তাই তিনি দ্রুততম সময়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফিরিয়েনিয়েছেন। তিনি বিশ্বকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে চান। সহানুভূতি হবে আন্তির্জাতিক রাজনীতির চালিকাশক্তি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সহানুভূতির রাজনীতি চালু করেছিলেন এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করে শান্তি ও সহানুভূতির রাজনীতি চালু করেছিলেন। তিন সেই সহানুভূতির রাজনীতিকে গ্রহণ করে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার ফল ভালো হয় না সেটা আমরা দেখেছি আমাদের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে। আমরা আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলন, মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সংগ্রাম ও যুদ্ধের কথা কম বেশি সকলেই জানি।আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে চালুকরা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জিয়া ও এরশাদের রাজনীতি দেখেছি।তারা একদিকে সংগ্রামের ও সহানুভূতির রাজনীতির পথ বেয়ে জন্ম নেয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মাটিচাপা দিতে চেয়েছেন সামরিক ও বাণিজ্যিক রাজনীতির পথকে প্রশস্ত করতে। এবং সেটা এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে বাংলার মানুষ ক্ষোভে গর্জেউঠে।আর তাই জাতীয় পার্টি ও বিএনপিকে হারাতে হয় অনেক কিছু।ধার করা আমদানিকৃত রাজনীতি ধর্মহীন সমাজতন্ত্র বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষ যেমন গ্রহণ করেনি তেমনি প্ৰত্যাখান করেছে জামায়াত বা তাদের সমমনা দলগুলোকে। বাংলাদেশে যারাই বাণিজ্য রাজনীতিতে পা দিয়েছে তাদেরই পতন হয়েছে।
দিন দিন আবার যেন ধর্ম ও বাণিজ্য আমাদের রাজনীতিকে গ্রাস করতে বসেছে। আমরা কেবল কোরোনার কারণেই সংকটকাল অতিক্রম করছি না- বরং লক্ষ্য করছি রাজনীতিতে সহানুভুতির জায়গাটা যেন উবে গেছে এবং বাণিজ্য পাকাপোক্ত হয়ে গেছে।আজ বাণিজ্য মন্ত্রী ও বাণিজ্য উপদেষ্টা দুজনেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। সুতরাংরাষ্ট্রর রাজনীতিতে অর্থ ব্যাপক প্রভাব ফেলবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।আমাদের হয়তো আশা ছিল রাজনীতিতে সহানুভূতির জায়গাটা থাকবে সবার উপরে।সেইসহানুভূতি যেমন চীন হংকং, তাইওয়ান, এবং উইঘর জনগণের এর বেলায় দেখতে ব্যর্থ তেমনি ব্যর্থ ইসরাইল প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি কিংবা ভারত কাশ্মীরিদের প্রতি।
আগামী নির্বাচন যে অর্থ নিয়ন্ত্রণ করবে তা এখনই পূর্বাভাস করা যায়। সকল দলই চেষ্টা করবে ভোট কেনার প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করতে।সুতরাং,বছরের পর বছর যারা জনগণকে সেবা দিয়েছেন তাদেরকে আমরা আর হয়তো পার্লামেন্ট, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ বা জেলা পরিষদে দেখতে পারবোনা। আর তার পরিনাম আমরা সকলেই ভোগ করবো।
যে সহানুভূতির আন্তর্জাতিক রাজনীতি জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে চালু করবার চেষ্টা করছেন তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে আশা করা যায়। সেজন্যই বাংলাদেশের যারা সহানুভূতির রাজনীতি করেন তাদের মনে আশা জেগেছে। যদি সেটি কাজ করে তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে বাণিজ্য ঢুকেছে সেখান থেকে মুক্ত হতে পারবে।আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শর কথা বলি সেই আদর্শ আবার বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাতে সংযোজিত হবে।
আজ রাজনীতির আলোচনায় হাইব্রিড-কাউয়ার আগমন নিয়ে কথা শুনি। একজনসহানুভূতিরহাইব্রিড বা কাউয়া ভালো? না কি একজন বাণিজ্যিক চিন্তার রাজনীতিবিদ ভালো? নিজেকে প্রশ্নটা করা এখন খুবই জরুরি।
আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো বাণিজ্যিক সংস্থার তল্পিবাহক হয়ে গেছে।এই অবস্থা থেকে বের না হয়ে আসলে মানবতা পরাজিত হবে যা আমাদের কাম্য নয়।
আমাদের শিশুরা যেভাবে মাদক কিংবা টিক টক এ আসক্ত হচ্ছে সেটা ওই বাণিজ্য রাজনীতির ফসল। এবং এই কঠিন বাণিজ্য জাল থেকে মুক্ত করতেই আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। বাংলার রাজনীতিতে সহানুভূতিকেফিরিয়েআন্তে তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শর সৈনিকদের দায় নিতে হবে। এবং এখনই সেটা শুরু করতে হবে।
সহানুভূতি থেকে যারা রাজনীতি করে তাদেরকে স্থান করে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রর ও বর্তমান শাসকদের উপরও বর্তায়। সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য সুশীল সমাজের ভূমিকা আছে। আমরা রাজনীতিতে ব্যাবসায়ীদের স্থান করে দিয়েছি সামান্য কিছু পেয়ে।কিন্তু তারা তাদের পদকে ব্যবহার করে লাভবান হবার প্রতিযোগিতা করছেন কি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আচার্য আবদুল হামিদআমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনসমস্যাটিকেএকথা বলে রাজনীতি “এখন গরিবের ভাউজ (ভাবি)”। তিনি আরও বলেছিলেন, “এখানে যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে। কোনো বাধা-বিঘœ নেই। আমি যদি বলি আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিকসেরলেকচারারঅইতাম চাই বা প্রফেসর অইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব আমারে ঢুকাইতো না”। তিনি বলেন, “কই যাইবেন, রাজনীতি আসলে হয়ে গেছে গরিবের ভাউজ। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বিজনেসম্যানরা তো আছেই। শিল্পপতি, লগ্নিপতিদের আগমন এভাবেই হয়ে যায়। কী করবেন? এগুলোকে থামানো দরকার”। কিন্তু সেটা আমরা ভুলে যেতে বসেছি।সকল রাজনৈতিক দলের এখানে একমত হওয়া জরুরি।বাংলাদেশে যারাই বাণিজ্য রাজনীতিতে পা দিয়েছে তাদেরই পতন হয়েছে। সুতরাং-সঠিক পথে ফেরার সময় এখনই।
লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
‘রাজনীতি যেন গরিবের ভাবি’ ও জো বাইডেনের সহানুভূতির রাজনীতি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ