বিনোদন ডেস্ক: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্যে সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো বড় ধরনের আর্তিক ক্ষতি মুখে পড়েছে অনলাইননির্ভর ওটিটিসহ বিনোদন প্ল্যাটফর্মগুলো। বিনোদন দুনিয়ার সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গত ১৭ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে বৃহস্পতিবার রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার রাতে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা ফেরে। পরদিন বুধবার রাতে সারা দেশে বাসাবাড়িতে ব্রন্ডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হলেও ধীরগতির কারণে অনেকে সমস্যায় পড়ার কথা জানিয়েছেন।
প্রতিদিন অন্তত ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার লোকসান গুণতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বঙ্গ’র হেড অব কনটেন্ট মোহাম্মদ আলী হায়দার। তিনি বলেন, “আমরা মাত্রই একটা ওয়েব সিরিজ ইউটিউবে ছেড়েছিলাম, তারপরই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। এছাড়া ৪টা সিঙ্গেল নাটক, ২টা ধারাবাহিক এবং ২টা সিনেমা অনএয়ার করার পরিকল্পনা ছিল। সেগুলো তো আর সম্ভব হয়নি। “যেগুলো অনএয়ার করেছি, সেগুলো তো আর দর্শক দেখতে পাচ্ছে না। নিয়মিত যে অনুষ্ঠানগুলো করতাম, তাও করা সম্ভব হচ্ছে না।” ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ওটিটি হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গ’। প্ল্যাটফর্মটি বিদেশি নানা কনটেন্টের পাশাপাশি দেশের নাটক, সিনেমা প্রচার করে। পরে ২০১৬ সালে গ্রামীণফোন ‘বায়োস্কোপ’ নামে আরেকটি ওটিটি নিয়ে আসে। বাংলালিংক আজিয়াটার ব্যানারে আসে ‘আইফ্লিক্স’। করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। সেসময় গ্রাহকের সঙ্গে এসব প্ল্যাটফর্মে কনটেন্টেও বাড়ে।
বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়েছে ওটিটি। পাশাপাশি বিনোদনভিত্তিক অনেক প্ল্যাটফর্মও তৈরি হয়েছে। দেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে বঙ্গ, চরকি, আইস্ক্রিন, দীপ্ত প্লে, বিঞ্জ, বায়োস্কোপ। এছাড়া ‘ক্লাব ১১’, ‘সিএমভি’, ‘জি-সিরিজ’সহ অসংখ্য বিনোদন প্লাটফর্ম রয়েছে- যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাটক নির্মাণ করে ইউটিউবে সম্প্রচার করে। এর বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগেও অসংখ্য মানুষ কনটেন্ট তৈরি করছেন, যা থেকে আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন তারা। দেশে কয়েক হাজার ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে জানিয়ে মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, “অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও ইউটিউব চ্যানেল চালায়, তাদের কেউ কেউ প্রতি মাসে ২/৩ লাখ টাকাও আয় করছে। ইন্টারনেট না থাকার কারণে তো তারাও ক্ষতির মুখে পড়েছে। “এখন প্রায় সব টেলিভিশন চ্যানেলও তাদের অনুষ্ঠান ইউটিউব, ফেইসবুকে সম্প্রচার করে। এতে (ইন্টারনেট না থাকায়) মানুষ বিনোদননির্ভর অনুষ্ঠান দেখা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে বড় রকম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে সবাই, এর পরিমাণ আমার ধারণা, শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।” প্রতিষ্ঠার তিন বছরে কেবল মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করছিল ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকি। নতুন সিনেমা, সিরিজ উপহার দিয়ে দর্শকের কাছে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছিল। তবে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে বড় ধাক্কা খেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি মনে করছেন, তারা অন্তত ৫ থেকে ৭ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বেন। সামগ্রিকভাবে দেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে ইন্ডাস্ট্রির যে বিকাশ ঘটছিল, তাতেও বড় রকমের একটা ধাক্কা এসেছে বলে জানান তিনি। রেদওয়ান রনি বলেন, “চরকি প্রতিবছর ১২টি সিনেমাসহ অনেকগুলো নতুন সিরিজ নির্মাণ করছে। এগুলোকে কেন্দ্র করে শত শত মানুষের জীবিকা তৈরি হয়েছে। সেখানে অনেক বড় রকমের একটা ধাক্কা এলো।” “এছাড়া সারা দেশে তো অসংখ্য মানুষ ব্যক্তিগতভাবেও কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে কাজ করছিল। সবার ক্ষতি যোগ করলে আমার ধারণা আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।”
চলতি সপ্তাহে দুটি নাটক ইউটিউবে প্রচার করার পরিকল্পনা ছিল অডিও-ভিডিও প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান সিএমভি’র। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। এছাড়া চলতি মাসেই ১০টি নাটক তারা ইউটিউবে মুক্তি দিয়েছে, যে নাটকগুলোর ভিউ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারি এসকে সাহেদ আলী পাপ্পু। তিনি জানিয়েছেন, ইন্টারনেট বন্ধের কারণে তারা অন্তত কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে শঙ্কায় আছেন। সাহেদ আলী বলেন, “প্রতিটি নাটকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে তো মিনিমাম খরচ হয়। সব মিলিয়ে আমরা তো অলরেডি কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে রেখেছি। গত এক মাসে যে নাটকগুলো অনএয়ার করেছি, সেগুলো তো ভিউ হবে না। আর দুটি নাটক এ সপ্তাহে অনএয়ার করার পরিকল্পনা ছিল, সেটা পারিনি। সামনে ইন্টারনেট স্বাভাবিক হলেও আগের মতো রিচ হবে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। ফলে এই খাতে আমরা বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়েছি।” তবে সাম্প্রতিক সহিংসতায় দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে ওটিটি ফ্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনের ক্ষতি নগন্য বলে মনে করেন এর প্রকল্প পরিচালক চিত্রনায়ক রিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, “এ মাসে আমরা যে পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটি সম্ভব হয়নি। আগামী মাসে নতুন পরিকল্পনা সাজাব। আমরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছি আশা করি সেটি কাটিয়ে উঠতে পারব। তবে দেশের ক্ষতির তুলনায় আমাদের ক্ষতির পরিমাণ নগন্য।”
ইন্টারনেট বন্ধে ওটিটিসহ বিনোদন জগতের ক্ষতি কতটুকু?
জনপ্রিয় সংবাদ