আলী রেজা : দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সরকার গঠনের পর সরকার দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই হবে সরকারের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। নতুন সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো দায়িত্ব নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিলেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার মনিটরিং জোরদার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তখন। কিন্তু বাজারে সেসব কথার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।
চাল, ডাল, ডিম, সবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি দেশের সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলে দিয়েছে। ফলে দেশের সর্বত্রই সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টিই জোরেসোরে আলোচিত হতে দেখা যায়। পণ্যের সংকট, সরবরাহে ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিও কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে না। কিন্তু কোনো একটি নিত্যপণ্যের মূল্য যখন হঠাৎ করে দ্বিগুণ কিংবা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায় তখন এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না দুটি কারণে। একটি কারণ হলো আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ বেকায়দায় পড়ে। আর একটি কারণ হলো এ ধরনের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকে।
আমরা জানি যে- সরবরাহ সামান্য হ্রাস পেলে ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন- বর্তমানের এই অস্বাভাবিক মূল্য পরিস্থিতি এক দিনে আসেনি। বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতায় কিছু প্রতিষ্ঠান দেশে প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারণ একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণ করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করছে দিনের পর দিন। সরকার এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হম্বিতম্বি করলেও কার্যত তাদের সঙ্গে পেরে ওঠছে না। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব গিয়ে পড়ছে সরাসরি ক্রেতাসাধারণের ওপর।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে দাম যখন বাড়ে তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। কিন্তু যখন কমে তখন ধীরে ধীরে কমে। আমদানিকারকরা আমদানি বন্ধের অজুহাতে কিংবা সরবরাহকারীরা কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। অধিকতর অনুসন্ধানের ফলে এ ধারণার সত্যতাও খুঁজে পাওয়া যায়। যাহোক, বর্তমান প্রসঙ্গ সরকারের ব্যর্থতা কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বিষয়ে নয়। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের প্রভাব কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে একটি সাধারণ আলোচনা করাই এ লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য। বাজার ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞাপন বিষয়ে আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। ভোক্তার অবস্থান থেকে আমি বিষয়টি দেখার চেষ্টা করেছি।
আজকাল শুধু ভোগ্যপণ্য নয়, বিলাসসামগ্রীও নিত্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্টসহ বিভিন্ন বিলাসসামগ্রী বা প্রসাধনসামগ্রী এখন প্রান্তিক মানুষেরাও ব্যবহার করে। মিনিপ্যাকে বাজারজাত করার ফলে সাবান-শ্যাম্পুজাতীয় বিলাসসামগ্রী এখন হতদরিদ্রদেরও হাতের নাগালে চলে এসেছে। কেউ এখন এর বাইরে নেই। দুই টাকা খরচ করে এখন শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারছে মানুষ। ভোক্তা ও ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলো এখন এমনিতেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। তার উপরে এসব কোম্পানি ঘন ঘন পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে চলছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি যুক্তিসংগত হলেও কোনো পণ্যের পাঁচ টাকা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিতে দশ টাকা মূল্যবৃদ্ধি যুক্তিসংগত নয়।
উৎপাদন খরচের সঙ্গে মোটা অঙ্কের বিজ্ঞাপন খরচ যুক্ত হওয়ার ফলে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়। উৎপাদনকারী, পাইকারী বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার লভ্যাংশ এবং পরিবহণ ও বিজ্ঞাপন খরচের পুরোটা ভোক্তাকেই বহন করতে হয়। বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে আনার মাধ্যমে উৎপাদনকারী বা কোম্পানি নিজেদের পণ্যের মূল্য কিছুটা হলেও কমাতে পারে। বর্তমানে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলো ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ার প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিলবোর্ড, লিফলেট ও পোস্টারিং-এর মাধ্যমে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার করে থাকে। কোনো কোম্পানি যদি প্রত্যেকটা প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে তাহলে তার বিজ্ঞাপন খরচের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। আবার কোনো কোম্পানি যদি প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেল, প্রত্যেকটি প্রিন্ট মিডিয়া ও প্রত্যেকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তাহলে তার বিজ্ঞাপন খরচ উৎপাদন খরচের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। আর এই বিজ্ঞাপন খরচের টাকাটাও কিন্তু কোম্পানি ভোক্তাদের নিকট থেকেই তুলে নেয়। এখন প্রশ্ন হলো- কেন এত সীমাহীন বিজ্ঞাপন? বিজ্ঞাপনের খরচটা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় বলেই কি এত বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি? বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে যে হাহাকার চলছে তার জন্য অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন খরচকেও দায়ী করা চলে।
প্রকৃতপক্ষে কোনো পণ্যের ওপর ভোক্তার আস্থা তৈরি হলে ঐ পণ্যের জন্য বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন পড়ে না। ঐ ভোক্তাই নতুন ভোক্তার জন্য বিজ্ঞাপন বা প্রচারক হয়ে ওঠে। উৎপাদিত পণ্য প্রথম বাজারজাত করার সময় বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হলেও পরবর্তী সময়ে খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। পণ্য মানসম্পন্ন হলে ভোক্তা নিজে থেকেই সেটাকে গ্রহণ করে। ভোক্তা নিজেই তখন পণ্যের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠে। আজকাল টিভি চ্যানেলসহ সকল প্রচারমাধ্যম বিজ্ঞাপনে একেবারে ভরে গেছে। কেউ নিজের পছন্দের কোনো অনুষ্ঠান নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছে না।
অনলাইনে পত্রিকা পড়তে গেলেও স্কিনে বার বার বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন চলে আসে। কে মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপন দেখে? অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হলে সাথে সাথে চ্যানেল বদলে ফেলে। সবাই এখন বিজ্ঞাপন স্কিপ করে যায়। অথচ এই বিজ্ঞাপনের কারণে ভোক্তাকে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হয়। এই বাস্তবতায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি চ্যানেলে উৎপাদনকারী তাঁর একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন ঠিক কতবার প্রচার করতে পারবে তার একটি বিধান করা যেতে পারে। একটি কোম্পানি তার পণ্যের বিজ্ঞাপন খরচ উৎপাদন খরচের সর্বোচ্চ কত পারসেন্ট করতে পারবে- সে বিধানও করা যেতে পারে। নাগামহীন বিজ্ঞাপন খরচ এবং পণ্যের দাম বাড়িয়ে সে খরচ ভোক্তাদের নিকট থেকে তুলে নেওয়া ব্যবসায় নৈতিকতার পরিপন্থি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বিজ্ঞাপনের লাগাম টেনে ধরতে পারলে পণ্যের মূল্যও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞাপন ছাড়া মিডিয়ার ব্যবসা চলবে কীভাবে? টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়াসহ সকল মিডিয়ার আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন প্রচার। প্রায় সকল অনুষ্ঠান স্পন্সর করে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি কিংবা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রশ্নের যথার্থতা অস্বীকার করা যায় না। তবে সর্বাগ্রে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করা জরুরি। ভোক্তা বেঁচে থাকলে কিংবা ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা বজায় থাকলেই পণ্যের চাহিদা থাকে। বর্তমানে বাজারে বিলাস সামগ্রীর যে মূল্য এবং দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা তার পেছনে নিঃসন্দেহে বিজ্ঞাপন খরচের প্রভাব আছে।
বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিং-এর উৎপাদন খরচের প্রায় সমপরিমাণ টাকা বিজ্ঞাপন প্রচারের পেছনে খরচ করা হয় বলে শোনা যায়। প্রসাধনসামগ্রীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সাধারণ সাবানের মূল্য প্রায় ৬০ টাকা হওয়ার পেছনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াই মূল কারণ নয়। উৎপাদন খরচ যে হারে বাড়ে পণ্যের মূল্য তার চেয়ে অধিক হারে বাড়িয়ে দেওয়া হয় বলেই সাধারণ লোকের বিশ্বাস। আর এ বিশ্বাস মোটেও অমূলক নয়। কারণ জায়ান্ট কোম্পানিগুলো ভোক্তার নিকট থেকে লভ্যাংশ নিয়েই তো দিন দিন ফুলেফেঁপে উঠছে। বিভিন্নভাবে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে, অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করে তা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সুকৌশলে। এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নিষ্ক্রিয় থাকতেই দেখা যায়। পণ্যের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টির প্রতি সরকারের নজরদারিও চোখে পড়ার মতো নয়। কিছু কিছু বিলাসসামগ্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতি চালানেই মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও বলে থাকেন- ‘এরপর আর এ দামে পাবেন না’।
অর্থনীতির ভাষায় ‘প্রোফিট ম্যাক্সিমাইজেশন’ ব্যবসার মূল লক্ষ্য। উৎপাদনকারী দুইভাবে এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে প্রোফিট ম্যাক্সিমাইজ করতে পারে এবং উৎপাদন খরচ কমিয়ে প্রোফিট ম্যাক্সিমাইজ করতে পারে। দ্বিতীয়টি করা হলে সেটি ভোক্তার স্বার্থের অনুকূলে যায়। কিন্তু পণ্যের মান ঠিক রেখে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব নয়। তাই বিশাল অঙ্কের বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে এনে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা যায়। দ্রব্যমূল্যের ওপর বিজ্ঞাপন খরচের বিরূপ প্রভাব থেকে ভোক্তাগণ রেহাই পাক- সাধারণ মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে।
লেখক: কলামিস্ট. কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়