ঢাকা ০৬:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫

মশার চ্যালেঞ্জ

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৬:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ অগাস্ট ২০২১
  • ১৭৯ বার পড়া হয়েছে

শেখ আনোয়ার : শরৎকাল। এ সময় প্রকোপ বাড়ে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। বর্ষার শেষ ও শরৎকালের শুরুতে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয় বলেই হয়তো এ সময়ে (২০ আগস্ট) বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মশা দিবস। বাংলাদেশে করোনা মহামারীর মধ্যে ডেঙ্গু মশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে ডেঙ্গু। করোনার জন্য হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্ক পরেও এমনিতে একটু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
করোনার ভ্যাকসিন রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের ভ্যাকসিন নেই। কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মশাবাহিত অন্য রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অক্ষম। কোন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার যন্ত্রণা দেখে পিতা-মাতা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কারও তা উপলব্ধি করার উপায় নেই। তাই ডেঙ্গুতে ভয় খুব বেশিই হয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অত্যন্ত ভয়ের খবর হলো, গত ১৮ আগস্ট নাগাদ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কম ছিল। গত বছর ১ হাজার ৪শ ৫ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ বছর চিকিৎসা নেয়া ৬ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫ হাজার ৭৩৩ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, মশাবাহিত রোগে প্রতিদিন বিশ্বে তিন হাজার লোক মারা যায়। বছরে মারা যায় দশ লাখ লোকের বেশী। রিপোর্ট অনুযায়ী মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর। ডেঙ্গু মশার জীবাণু দ্বারা প্রচন্ড জ্বর, তীব্র মাথা ব্যথা, কাঁপুনি, পেশী সংকোচন ও বমি ইত্যাদি হয়ে থাকে। অ্যানোফেলিস থেকে ম্যালেরিয়া এবং এডিস মশার দংশনে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশাসহ অন্যান্য মশা ডোবা-নালা, জঞ্জাল ও বদ্ধ জলাশয় ইত্যাদিতে জন্মায়। কিন্তু নালা-নর্দমা এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র নয়। এই মশার প্রজনন ক্ষেত্র হলো ফুলের টব এবং ইতস্তত: বিক্ষিপ্তভাবে বাড়ির আশেপাশে ও এখানে-সেখানে পড়ে থাকা টিনের কৌটা প্রভৃতি। বৃষ্টির পানি এসব টবে ও পরিত্যক্ত পাত্রে জমা হলে জন্ম নেয় এডিস মশা।

ডেঙ্গু মশা বা এডিস মশা খালি চোখে দেখা অতি কষ্টকর ব্যাপার। ডেঙ্গু মশা এতোটাই ভয়ঙ্কর যে, এর দংশনে প্রচন্ড কম্প দিয়ে জ্বর উঠে। সহসা জ্বর ছাড়তে চায় না। ক্রমান্বয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। মনে হতে পারে যে, ডেঙ্গু মশার মধ্যে জীবাণু রয়েছে। যেমন বিষধর সাপে রয়েছে বিষ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা নয়। মশার নিজের মধ্যে কোন জীবাণু নেই। এটা বাহক মাত্র। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহে দংশন করে জীবাণু সংগ্রহ করে এবং তা অন্যের দেহে ছড়ায়।

শরীর বিজ্ঞানীদের মতে, ডেঙ্গু জ্বর একটা ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসের নাম গ্রুপ ‘বি’ আরবো ভাইরাস। এই ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। আরবো ভাইরাস বহনকারী মশার নাম এডিস মশা। এই মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এই ভাইরাস বহনকারী স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা যখন কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায় তখন তার দেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ওই ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। সাধারণত মশা কামড়ানোর ৫ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর ৮ থেকে ১২ দিন পর এডিস মশা এই রোগ ছড়াতে পারে এবং এই মশা তার জীবনকালের বাকী সময়ের জন্যও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।

করোনা ভাইরাস সংক্রমণে যেমন জ্বর হয়, ডেঙ্গুতেও তাই হয়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে প্রচন্ড মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, গিরায় ব্যথা, মাংসে ব্যথা-এক কথায় সমস্ত শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। হাড় ভেঙ্গে গেলে নড়াচড়ায় যেমন প্রচন্ড ব্যথা হয় তেমনি ব্যথা হয় এই ডেঙ্গু জ্বরে। এজন্য ডেঙ্গু জ্বরকে হাড় ভাঙ্গা জ্বর বা ব্রেকবোন জ্বর বলে। তিন-চারদিন পর জ্বর কমে যায় এবং এরপর পুনরায় ১২ ঘণ্টা থেকে ৩ দিনের মধ্যে রোগী জ্বরে ও ব্যথায় আক্রান্ত হয়।

এ সময়ে শরীরে লালচে আভা ও ফুসফুড়ি বা র‌্যাশ দেখা যায়। চোখেও লালচে হয়ে যায়। কখনও কখনও শরীরের অভ্যন্তরে অত্যধিক রক্তরণ হয় এবং রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ অবস্থাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলে। তখন ব্লাড প্রেসার অনেক কমে যায়। রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় শ্বেতকণিকা অনেক কমে গেছে। রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটও অনেক কমে যায়। সাধারণ টিসি, ডিসি পরীক্ষায় এগুলো বোঝা যায়। প্লাটিলেট দেখার সর্বোত্তম পন্থা হলো প্রথমে সেল কাউন্টিং মেশিনে এবং পরে মাইক্রোস্কোপে দেখার ফলাফল তুলনা করা। রক্তে এই ভাইরাস সনাক্ত করার জন্য ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষা করা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। অনেক রোগী না বুঝে ব্যয়বহুল ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষা নিজেরাই করেন। যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া করা উচিত নয়।

এ সময়ে জ্বর, কাঁপুনি বা মাথা ব্যথার সঙ্গে বমি হলে বা কোনো লক্ষণ দেখা দিলে বাসায় চিকিৎসা না করে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে স্থানান্তর করা উত্তম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। হাসপাতালে চিকিৎসকরা ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। কারণ ডেঙ্গু জ্বরে কিছু কিছু ওষুধ মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। ডেঙ্গু হেরোরেজিক ফিভারে প¬াটিলেট ট্রান্সফিউশন অথবা ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেয়া হয়। প্রবাদে রয়েছে, ‘নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ সব সময়ই উত্তম।’ ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ ইত্যাদি। স্বাস্থ্যহীন বা নিত্য অসুস্থ লোক বিত্তশালী হলেও জীবন উপভোগ করতে পারে না। তাই এসময়ে ডেঙ্গুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। নাগরিকদেরও নিজস্ব সচেতনতার কথা ভুলে গেলে চলবে না।

সকলেই জানেন, ডেঙ্গু মশা সাধারণত বাসগৃহে বা তার আশেপাশে রক্ষিত টবে, পরিত্যক্ত বাসন-কোসন, কৌটায় জমা-পানিতে ডিম পাড়ে। তাই এ সময়ে বারান্দায় ও ছাদে সংরক্ষিত ফুলের টবে যাতে পানি না জমে এবং ভাঙ্গা কৌটায় পানি জমতে না পারে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শহরের নিচু তলার বাসিন্দাদের মশার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। তাই ফুল স্লিভ জামা-কাপড় পরার অভ্যাস করা, মশারি টানিয়ে ঘুমানো, সন্ধ্যার পর জানালা বন্ধ করে রাখা কিছুটা প্রতিকার হতে পারে। আর হ্যাঁ। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই মশারীর মধ্যে রাখতে হবে। চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কীটনাশক ব্লিচিং পাউডার অথবা অ্যান্টি-লার্ভাল স্প্রে ছিটাতে হবে। প্রচার মাধ্যমগুলো নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখতে পারে। বর্তমানে দেশে বেসরকারী টিভি চ্যানেলসহ অনলাইন নানামুখী প্রচার মাধ্যমের আকাল নেই। এসব মাধ্যমে দিনে অন্তত কয়েক মিনিট ডেঙ্গু নিয়ে জনসচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন প্রচার এবং খবরের কাগজ রেডিওতে নিয়মিতভাবে প্রচার করা হলে সচেতনতা বাড়তে বাধ্য।

ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার রোধের একমাত্র উপায় বাহক এডিস মশা নিধন করা। মশার বিস্তার রোধ করার জন্য বেশীর ভাগ সময় সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লি¬ষ্ট সংস্থাগুলোকে তাগাদা দেয়া হয়ে থাকে। ব্যর্থতা ও সাফল্যের জন্য নিন্দা এবং প্রশংসা বাক্য উচ্চারিত হয়। এর যৌক্তিকতা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর চার-পাঁচটি প্রধান দায়িত্বের মধ্যে মশার বংশ বিস্তার রোধ করার দায়িত্বটা অন্যতম। তাই সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে এ সময়ে নিজস্ব দায়িত্ব অবশ্যই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে।

কিন্তু নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব যাদের, তারা কি তাদের সে কর্তব্যকাজ সঠিকভাবে করছেন? ডেঙ্গুকে এখন আর সহজভাবে নিলে চলবে না। ডেঙ্গু যেনো বাংলার মানুষের চেয়ে শক্তিশালী না হয়। এখন সময় হয়েছে, ডেঙ্গু মশাকে সিরিয়াস চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার। ডেঙ্গু মশা মোকাবিলায় সর্বাত্মক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু মশা নিধনে আন্তরিকভাবে কাজের গতি বাড়িয়ে দিলে খুব সহজেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। করোনাকালে ডেঙ্গু আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করুক, এটাই সকলের কাম্য হোক।
লেখক: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

মশার চ্যালেঞ্জ

আপডেট সময় : ০৯:৪৬:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ অগাস্ট ২০২১

শেখ আনোয়ার : শরৎকাল। এ সময় প্রকোপ বাড়ে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। বর্ষার শেষ ও শরৎকালের শুরুতে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয় বলেই হয়তো এ সময়ে (২০ আগস্ট) বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মশা দিবস। বাংলাদেশে করোনা মহামারীর মধ্যে ডেঙ্গু মশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে ডেঙ্গু। করোনার জন্য হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্ক পরেও এমনিতে একটু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
করোনার ভ্যাকসিন রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের ভ্যাকসিন নেই। কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মশাবাহিত অন্য রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অক্ষম। কোন শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার যন্ত্রণা দেখে পিতা-মাতা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কারও তা উপলব্ধি করার উপায় নেই। তাই ডেঙ্গুতে ভয় খুব বেশিই হয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অত্যন্ত ভয়ের খবর হলো, গত ১৮ আগস্ট নাগাদ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কম ছিল। গত বছর ১ হাজার ৪শ ৫ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ বছর চিকিৎসা নেয়া ৬ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫ হাজার ৭৩৩ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, মশাবাহিত রোগে প্রতিদিন বিশ্বে তিন হাজার লোক মারা যায়। বছরে মারা যায় দশ লাখ লোকের বেশী। রিপোর্ট অনুযায়ী মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর। ডেঙ্গু মশার জীবাণু দ্বারা প্রচন্ড জ্বর, তীব্র মাথা ব্যথা, কাঁপুনি, পেশী সংকোচন ও বমি ইত্যাদি হয়ে থাকে। অ্যানোফেলিস থেকে ম্যালেরিয়া এবং এডিস মশার দংশনে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশাসহ অন্যান্য মশা ডোবা-নালা, জঞ্জাল ও বদ্ধ জলাশয় ইত্যাদিতে জন্মায়। কিন্তু নালা-নর্দমা এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র নয়। এই মশার প্রজনন ক্ষেত্র হলো ফুলের টব এবং ইতস্তত: বিক্ষিপ্তভাবে বাড়ির আশেপাশে ও এখানে-সেখানে পড়ে থাকা টিনের কৌটা প্রভৃতি। বৃষ্টির পানি এসব টবে ও পরিত্যক্ত পাত্রে জমা হলে জন্ম নেয় এডিস মশা।

ডেঙ্গু মশা বা এডিস মশা খালি চোখে দেখা অতি কষ্টকর ব্যাপার। ডেঙ্গু মশা এতোটাই ভয়ঙ্কর যে, এর দংশনে প্রচন্ড কম্প দিয়ে জ্বর উঠে। সহসা জ্বর ছাড়তে চায় না। ক্রমান্বয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। মনে হতে পারে যে, ডেঙ্গু মশার মধ্যে জীবাণু রয়েছে। যেমন বিষধর সাপে রয়েছে বিষ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা নয়। মশার নিজের মধ্যে কোন জীবাণু নেই। এটা বাহক মাত্র। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহে দংশন করে জীবাণু সংগ্রহ করে এবং তা অন্যের দেহে ছড়ায়।

শরীর বিজ্ঞানীদের মতে, ডেঙ্গু জ্বর একটা ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসের নাম গ্রুপ ‘বি’ আরবো ভাইরাস। এই ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। আরবো ভাইরাস বহনকারী মশার নাম এডিস মশা। এই মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এই ভাইরাস বহনকারী স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা যখন কোন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায় তখন তার দেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ওই ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। সাধারণত মশা কামড়ানোর ৫ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর ৮ থেকে ১২ দিন পর এডিস মশা এই রোগ ছড়াতে পারে এবং এই মশা তার জীবনকালের বাকী সময়ের জন্যও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।

করোনা ভাইরাস সংক্রমণে যেমন জ্বর হয়, ডেঙ্গুতেও তাই হয়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে প্রচন্ড মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, গিরায় ব্যথা, মাংসে ব্যথা-এক কথায় সমস্ত শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। হাড় ভেঙ্গে গেলে নড়াচড়ায় যেমন প্রচন্ড ব্যথা হয় তেমনি ব্যথা হয় এই ডেঙ্গু জ্বরে। এজন্য ডেঙ্গু জ্বরকে হাড় ভাঙ্গা জ্বর বা ব্রেকবোন জ্বর বলে। তিন-চারদিন পর জ্বর কমে যায় এবং এরপর পুনরায় ১২ ঘণ্টা থেকে ৩ দিনের মধ্যে রোগী জ্বরে ও ব্যথায় আক্রান্ত হয়।

এ সময়ে শরীরে লালচে আভা ও ফুসফুড়ি বা র‌্যাশ দেখা যায়। চোখেও লালচে হয়ে যায়। কখনও কখনও শরীরের অভ্যন্তরে অত্যধিক রক্তরণ হয় এবং রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ অবস্থাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলে। তখন ব্লাড প্রেসার অনেক কমে যায়। রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় শ্বেতকণিকা অনেক কমে গেছে। রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটও অনেক কমে যায়। সাধারণ টিসি, ডিসি পরীক্ষায় এগুলো বোঝা যায়। প্লাটিলেট দেখার সর্বোত্তম পন্থা হলো প্রথমে সেল কাউন্টিং মেশিনে এবং পরে মাইক্রোস্কোপে দেখার ফলাফল তুলনা করা। রক্তে এই ভাইরাস সনাক্ত করার জন্য ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষা করা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। অনেক রোগী না বুঝে ব্যয়বহুল ইমিউনোলজিক্যাল পরীক্ষা নিজেরাই করেন। যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া করা উচিত নয়।

এ সময়ে জ্বর, কাঁপুনি বা মাথা ব্যথার সঙ্গে বমি হলে বা কোনো লক্ষণ দেখা দিলে বাসায় চিকিৎসা না করে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে স্থানান্তর করা উত্তম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। হাসপাতালে চিকিৎসকরা ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। কারণ ডেঙ্গু জ্বরে কিছু কিছু ওষুধ মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করতে পারে। ডেঙ্গু হেরোরেজিক ফিভারে প¬াটিলেট ট্রান্সফিউশন অথবা ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেয়া হয়। প্রবাদে রয়েছে, ‘নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ সব সময়ই উত্তম।’ ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ ইত্যাদি। স্বাস্থ্যহীন বা নিত্য অসুস্থ লোক বিত্তশালী হলেও জীবন উপভোগ করতে পারে না। তাই এসময়ে ডেঙ্গুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। নাগরিকদেরও নিজস্ব সচেতনতার কথা ভুলে গেলে চলবে না।

সকলেই জানেন, ডেঙ্গু মশা সাধারণত বাসগৃহে বা তার আশেপাশে রক্ষিত টবে, পরিত্যক্ত বাসন-কোসন, কৌটায় জমা-পানিতে ডিম পাড়ে। তাই এ সময়ে বারান্দায় ও ছাদে সংরক্ষিত ফুলের টবে যাতে পানি না জমে এবং ভাঙ্গা কৌটায় পানি জমতে না পারে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শহরের নিচু তলার বাসিন্দাদের মশার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। তাই ফুল স্লিভ জামা-কাপড় পরার অভ্যাস করা, মশারি টানিয়ে ঘুমানো, সন্ধ্যার পর জানালা বন্ধ করে রাখা কিছুটা প্রতিকার হতে পারে। আর হ্যাঁ। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই মশারীর মধ্যে রাখতে হবে। চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কীটনাশক ব্লিচিং পাউডার অথবা অ্যান্টি-লার্ভাল স্প্রে ছিটাতে হবে। প্রচার মাধ্যমগুলো নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখতে পারে। বর্তমানে দেশে বেসরকারী টিভি চ্যানেলসহ অনলাইন নানামুখী প্রচার মাধ্যমের আকাল নেই। এসব মাধ্যমে দিনে অন্তত কয়েক মিনিট ডেঙ্গু নিয়ে জনসচেতনতা মূলক বিজ্ঞাপন প্রচার এবং খবরের কাগজ রেডিওতে নিয়মিতভাবে প্রচার করা হলে সচেতনতা বাড়তে বাধ্য।

ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার রোধের একমাত্র উপায় বাহক এডিস মশা নিধন করা। মশার বিস্তার রোধ করার জন্য বেশীর ভাগ সময় সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লি¬ষ্ট সংস্থাগুলোকে তাগাদা দেয়া হয়ে থাকে। ব্যর্থতা ও সাফল্যের জন্য নিন্দা এবং প্রশংসা বাক্য উচ্চারিত হয়। এর যৌক্তিকতা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর চার-পাঁচটি প্রধান দায়িত্বের মধ্যে মশার বংশ বিস্তার রোধ করার দায়িত্বটা অন্যতম। তাই সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে এ সময়ে নিজস্ব দায়িত্ব অবশ্যই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে।

কিন্তু নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব যাদের, তারা কি তাদের সে কর্তব্যকাজ সঠিকভাবে করছেন? ডেঙ্গুকে এখন আর সহজভাবে নিলে চলবে না। ডেঙ্গু যেনো বাংলার মানুষের চেয়ে শক্তিশালী না হয়। এখন সময় হয়েছে, ডেঙ্গু মশাকে সিরিয়াস চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার। ডেঙ্গু মশা মোকাবিলায় সর্বাত্মক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগ সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু মশা নিধনে আন্তরিকভাবে কাজের গতি বাড়িয়ে দিলে খুব সহজেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। করোনাকালে ডেঙ্গু আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করুক, এটাই সকলের কাম্য হোক।
লেখক: গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।