ঢাকা ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

মানুষের বলয়জুড়ে বিষবাস্পের সিলিন্ডার

  • আপডেট সময় : ১১:০৬:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুন ২০২৪
  • ১০৪ বার পড়া হয়েছে

ফারজানা কাশেমী : চল্লিশ বছর ছোয়ার আগেই অভিনেত্রী সীমানা এই পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন অজানা গন্তব্যে মহাকালের স্রোতধারায়। সীমানার মৃত্যুর পর রাগ, ক্ষোভ আর একরাশ অভিমান প্রকাশ করেছেন তার বাবা। হারানো সন্তানকে বাবা-মা কখনো ফিরে পাবেন না। তবুও কষ্টের তীব্রতায় সীমানার বাবা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন সীমানার স্বামীর বিরুদ্ধে। সীমানার স্বামী সীমানাকে তার মৃত্যুর পরে ও শেষবার দেখার জন্যও আসেনি। সীমানার বাবার অভিযোগ-সীমানা তার স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার বাবার বাসায় বসবাস করতেন।
বহতা সময়ের নিয়মে মেয়েরা ঘরহীন। মেয়ে আজ তার বাবার ঘরে, কাল তার স্বামীর ঘরে, পরশু তার ছেলের ঘরে আশ্রয় নেয়। মেয়েদের কোনো ঘর নেই। মেয়েদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। মেয়েরা ভাসমান শ্যাওলাসম। একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে মেয়েরা কোনো না কোনো ঘরের বোঝা হয়ে যায়। জ্ঞানে-গুণে, মান-মর্যাদায় পুর্ণ মেয়েরও প্রকৃত চিত্র প্রায়শই কাছাকাছি। তবুও বাস্তবতা মেয়েরা ঘর খুঁজে। এমন একটি ঘর প্রতিটি মেয়ে চায়-যেন নিরাপদ আশ্রয়সম। দুঃখের বিষয় এই যে, ঘর খুঁজে ফেরা মেয়েগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ঘরের নামে পায় জীবন নামক যাতনা আর নরকযন্ত্রণা। কিছু ঘর হয় মেয়েদের মরণফাঁদ কিংবা মৃত্যুকুপ।
কিছুকাল আগে অভিনেত্রী হুমায়ারা হিমু মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যুর পর জানা গেছে তার ডিপ্রেসন, একাকীত্ব, অসহায়ত্বসহ বহুবিধ কারণ। কেউ কেউ হুমায়ারা হিমুর মৃত্যুর জন্য তার সঙ্গীহীন জীবনকে চিহ্নিত করেছেন। যে মানুষ সঙ্গীহীন তার অস্বাভাবিক পরিণতির জন্য সঙ্গীহীনতাকে চিহ্নিত করা যায়। আবার কখনো সঙ্গীর শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যায়।
চারদিকে কী নির্মমতা। কী নির্লজ্জ আচরণ আমাদের। মানুষ বিচিত্র স্বভাবের। কারো সাথে কারোর সাদৃশ্য নেই। তবে ঘটে যাওয়া অপমৃত্যুর কারণ যেন কাছাকাছি। অসভ্যতা আর নিষ্ঠুরতার বৈচিত্রতা চারদিকে। আশরাফুল নামের এক ব্যক্তি তার স্ত্রী আর শিশু সন্তানকে হত্যার পর সারাদিন খুঁজে বেড়িয়েছে, যাতে নিজের দিকে অভিযোগের তীর যেন না আসে অথবা তাকে নিয়ে যেন সন্দেহ তৈরি না হয়। পৃথিবীর সকল মনোচিকিৎসক কী প্রয়োজন এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডে? বাবার নির্মমতা থেকে শিশু সন্তানের রেহাই নেই যেই সমাজে!
পরকীয়া প্রেমে আসক্ত দুজন চাচাতো ভাই বোন। এদের মধ্যে একজন বিবাহিত। বিবাহিত নারী তার স্বামীকে তালাক প্রদান ব্যতীত প্রেমের গভীরতায় প্রেমিককে বিয়ে করেছেন। অথচ বিবাহবন্ধনের রীতিনীতি সবই উপেক্ষা করল এই যুগল। ভালো থাকার আশায় মন্দ থাকাও হলো না সৌরভ নামের এই ছেলেটির। পরকীয়া, বিয়ে বিষয়ক জটিলতায় সৌরভ খুন হলো। সৌরভের চাচা তাকে খুন করে টুকরো করে লাগেজ করে নদীতে ফেলে দেয়। পরিবারের সম্মতিহীন বিয়ের জন্য সৌরভের চাচা ওরফে তার প্রেমিকার বাবা ডেকে নিয়ে সৌরভকে খুন করেছেন। সম্মতিহীন কিংবা গোপনে বিয়ে যদি অপরাধ হয়, একই অপরাধে অভিযুক্ত একজন কানাডায় পাড়ি জমায় আর একজন খুনের পর টুকরো করে লাগেজ ভর্তি করে নদীতে ফেলে যায়। একই অপরাধে মেয়েকে ক্ষমা করা যায়, কিন্তু ভাতিজাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে না তাকিয়ে খুনের পরেও নৃসংশতা চালায় একই ব্যক্তি। একই ব্যক্তি কারো বাবা, কারো চাচা, কারো ভাই। যে আচরণ নিজের আপনজনের সাথে প্রদর্শন করে, ঠিক তেমনই আচরণ অপরের প্রতি প্রদর্শনে শুধু অনীহা প্রকাশ নয়, ঘোর বিরোধী আচরণ প্রদর্শন পরিলক্ষিত হয় অহরহ।
এই সমাজ নামক কাঠের বাক্সে আমরা সবাই পুতুল। অন্য মানুষের ইচ্ছেমাফিক অনেক সময় অনেক মানুষ নাচতে বাধ্য হয়। এই কাঠের বাক্সের রীতিনীতিতে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি সবই ফ্রেম। একটি ফ্রেম অদেখা ফ্রেমের সন্নিবেশ। এই ফ্রেমবন্দী জীবনে আটপৌর চালচুলোতে প্রতিটি মানুষ কোন না কোনভাবেই পুড়ে যায় বেঁধে দেওয়া নিয়মের করাল গ্রাসে। আমরা মানুষ মূয়র বেশ থাকি। কী সুন্দর আমাদের মুখশ্রী, চালচলন। অথচ মানুষ যেন মূয়র পুঞ্জিভূত কাক। মানুষের বলয়জুড়ে বিষবাস্পের সিলিন্ডার।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মানুষের বলয়জুড়ে বিষবাস্পের সিলিন্ডার

আপডেট সময় : ১১:০৬:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুন ২০২৪

ফারজানা কাশেমী : চল্লিশ বছর ছোয়ার আগেই অভিনেত্রী সীমানা এই পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন অজানা গন্তব্যে মহাকালের স্রোতধারায়। সীমানার মৃত্যুর পর রাগ, ক্ষোভ আর একরাশ অভিমান প্রকাশ করেছেন তার বাবা। হারানো সন্তানকে বাবা-মা কখনো ফিরে পাবেন না। তবুও কষ্টের তীব্রতায় সীমানার বাবা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন সীমানার স্বামীর বিরুদ্ধে। সীমানার স্বামী সীমানাকে তার মৃত্যুর পরে ও শেষবার দেখার জন্যও আসেনি। সীমানার বাবার অভিযোগ-সীমানা তার স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার বাবার বাসায় বসবাস করতেন।
বহতা সময়ের নিয়মে মেয়েরা ঘরহীন। মেয়ে আজ তার বাবার ঘরে, কাল তার স্বামীর ঘরে, পরশু তার ছেলের ঘরে আশ্রয় নেয়। মেয়েদের কোনো ঘর নেই। মেয়েদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। মেয়েরা ভাসমান শ্যাওলাসম। একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে মেয়েরা কোনো না কোনো ঘরের বোঝা হয়ে যায়। জ্ঞানে-গুণে, মান-মর্যাদায় পুর্ণ মেয়েরও প্রকৃত চিত্র প্রায়শই কাছাকাছি। তবুও বাস্তবতা মেয়েরা ঘর খুঁজে। এমন একটি ঘর প্রতিটি মেয়ে চায়-যেন নিরাপদ আশ্রয়সম। দুঃখের বিষয় এই যে, ঘর খুঁজে ফেরা মেয়েগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ঘরের নামে পায় জীবন নামক যাতনা আর নরকযন্ত্রণা। কিছু ঘর হয় মেয়েদের মরণফাঁদ কিংবা মৃত্যুকুপ।
কিছুকাল আগে অভিনেত্রী হুমায়ারা হিমু মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যুর পর জানা গেছে তার ডিপ্রেসন, একাকীত্ব, অসহায়ত্বসহ বহুবিধ কারণ। কেউ কেউ হুমায়ারা হিমুর মৃত্যুর জন্য তার সঙ্গীহীন জীবনকে চিহ্নিত করেছেন। যে মানুষ সঙ্গীহীন তার অস্বাভাবিক পরিণতির জন্য সঙ্গীহীনতাকে চিহ্নিত করা যায়। আবার কখনো সঙ্গীর শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যায়।
চারদিকে কী নির্মমতা। কী নির্লজ্জ আচরণ আমাদের। মানুষ বিচিত্র স্বভাবের। কারো সাথে কারোর সাদৃশ্য নেই। তবে ঘটে যাওয়া অপমৃত্যুর কারণ যেন কাছাকাছি। অসভ্যতা আর নিষ্ঠুরতার বৈচিত্রতা চারদিকে। আশরাফুল নামের এক ব্যক্তি তার স্ত্রী আর শিশু সন্তানকে হত্যার পর সারাদিন খুঁজে বেড়িয়েছে, যাতে নিজের দিকে অভিযোগের তীর যেন না আসে অথবা তাকে নিয়ে যেন সন্দেহ তৈরি না হয়। পৃথিবীর সকল মনোচিকিৎসক কী প্রয়োজন এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডে? বাবার নির্মমতা থেকে শিশু সন্তানের রেহাই নেই যেই সমাজে!
পরকীয়া প্রেমে আসক্ত দুজন চাচাতো ভাই বোন। এদের মধ্যে একজন বিবাহিত। বিবাহিত নারী তার স্বামীকে তালাক প্রদান ব্যতীত প্রেমের গভীরতায় প্রেমিককে বিয়ে করেছেন। অথচ বিবাহবন্ধনের রীতিনীতি সবই উপেক্ষা করল এই যুগল। ভালো থাকার আশায় মন্দ থাকাও হলো না সৌরভ নামের এই ছেলেটির। পরকীয়া, বিয়ে বিষয়ক জটিলতায় সৌরভ খুন হলো। সৌরভের চাচা তাকে খুন করে টুকরো করে লাগেজ করে নদীতে ফেলে দেয়। পরিবারের সম্মতিহীন বিয়ের জন্য সৌরভের চাচা ওরফে তার প্রেমিকার বাবা ডেকে নিয়ে সৌরভকে খুন করেছেন। সম্মতিহীন কিংবা গোপনে বিয়ে যদি অপরাধ হয়, একই অপরাধে অভিযুক্ত একজন কানাডায় পাড়ি জমায় আর একজন খুনের পর টুকরো করে লাগেজ ভর্তি করে নদীতে ফেলে যায়। একই অপরাধে মেয়েকে ক্ষমা করা যায়, কিন্তু ভাতিজাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে না তাকিয়ে খুনের পরেও নৃসংশতা চালায় একই ব্যক্তি। একই ব্যক্তি কারো বাবা, কারো চাচা, কারো ভাই। যে আচরণ নিজের আপনজনের সাথে প্রদর্শন করে, ঠিক তেমনই আচরণ অপরের প্রতি প্রদর্শনে শুধু অনীহা প্রকাশ নয়, ঘোর বিরোধী আচরণ প্রদর্শন পরিলক্ষিত হয় অহরহ।
এই সমাজ নামক কাঠের বাক্সে আমরা সবাই পুতুল। অন্য মানুষের ইচ্ছেমাফিক অনেক সময় অনেক মানুষ নাচতে বাধ্য হয়। এই কাঠের বাক্সের রীতিনীতিতে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি সবই ফ্রেম। একটি ফ্রেম অদেখা ফ্রেমের সন্নিবেশ। এই ফ্রেমবন্দী জীবনে আটপৌর চালচুলোতে প্রতিটি মানুষ কোন না কোনভাবেই পুড়ে যায় বেঁধে দেওয়া নিয়মের করাল গ্রাসে। আমরা মানুষ মূয়র বেশ থাকি। কী সুন্দর আমাদের মুখশ্রী, চালচলন। অথচ মানুষ যেন মূয়র পুঞ্জিভূত কাক। মানুষের বলয়জুড়ে বিষবাস্পের সিলিন্ডার।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ