ঢাকা ০৩:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

বন্ধ হোক নারী-অবয়বের কদর্য শিল্পায়ন

  • আপডেট সময় : ১১:২২:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
  • ১৭৬ বার পড়া হয়েছে

কয়েক বছর আগে রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম। সে বছর আমার বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফর ছিল সেখানে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরটি দেখার। তবে বেশি সময় নিয়ে দেখতে পারিনি তখন। এর কারণ, মিউজিয়ামজুড়ে অসংখ্য নগ্ন নারীমূর্তি ছিল। আমাদের সাথে সম্মান শ্রেণির বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ছিল। ওরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় সংগত কারণেই কিছুক্ষণ দেখার পর আমি অনেকটাই সংকোচবোধ করছিলাম। আসলে এত নগ্ন নারীমূর্তি শিক্ষার্থীদের সাথে একত্রে দেখতে বিব্রতবোধ করাটাই তো স্বাভাবিক। ওরা নিজেরাও বিব্রতবোধ করছিল। স্বীকার করছি যে- উভয় পক্ষের এই বিব্রতবোধ আমাদের সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ ও অনভ্যস্ততার কারণেই। শুধু বরেন্দ্র জাদুঘরেই নয় দেশের ছোটো-বড়ো প্রায় সব জাদুঘরেই এরকম অনেক প্রাচীন ভারতীয় নগ্ন নারী মূর্তি শোভা পায়। এগুলোকে বলা হয় ধ্রুপদী শিল্পকলা। শুধু বঙ্গ-ভারতেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কাল সভ্যতায় দেব-দেবী, অপ্সরী, নর্তকী, কিন্নরীর নগ্নমূর্তি, চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এই মূর্তিগুলো সাধারণত মন্দিরে স্থাপিত হতো অথবা মন্দিরগাত্রে খোদিত ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় দেখা যায় নারী-পুরুষ উভয়ের নগ্নমূর্তি। প্রাচীন গ্রিকে পুরুষের নগ্ন শরীর বেশি দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে পুরুষের পেশিশক্তি ও সামর্থ্য এবং পুরুষের পরাক্রমকে তুলে ধরা হতো।
গ্রিক দেবী আফ্রোদিতির একটি মূর্তি নির্মাণ করেন ভাস্কর প্রক্সিতেলেস খ্রি.পূ. ৪র্থ শতকে। দেবীর মাথা কাটা, হাত বাহু পর্যন্ত কাটা। আবেদনময়ী দেহ ভঙ্গীমায় দাঁড়ানো বেদীর ওপর। দেবীর পীনোন্নত, বর্তুল, সুপুষ্ট স্তন, গভীর নাভী, বিশাল উরু, স্ফীত জঘন ও যোনি যেকোনো পুরুষকে কামনাদগ্ধ করবে। যেন সে নারী নয়। মূর্তিমতী কামনা। মন্দিরে প্রবেশ করে পুরুষরা পুরোহিতকে ঘুষ দিয়ে ওই মূর্তিকে আলিঙ্গন করত।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাস্কর্য শিল্পের মধ্যে ছিল স্বর্গের অপ্সরা, নর্তকীদের মূর্তি, গন্ধর্ব মিথুন, বিষ্ণু-লক্ষ্মী, হর-পার্বতী, চণ্ডী, মারকন্যা, যক্ষী ইত্যাদি। এসকল ভাস্কর্যে নারীদের নগ্ন অথবা অর্ধ-নগ্নমূর্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এরা যেন নারী নয় জ্বলন্ত কামাগ্নী। অজন্তার গুহা চিত্রে যে মারকন্যার চিত্র রয়েছে তাতে তাদের অর্ধ নিমীলিত চোখের দৃষ্টি, সুডৌল স্তন, স্তনবৃন্ত, ক্ষীণ কটি তাদেরকে জীবন্ত করে তুলেছে। তাদের চোখ ও দেহের ভঙ্গীতে রয়েছে উন্মাদনা। সেই পাথরের মূর্তিই পুরুষকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। নন্দনতাত্ত্বিকগণ এই মূর্তিগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের নিকট এগুলো অপূর্ব শিল্প-শৈলীর নিদর্শন। শিল্প যদি মানবমনের সৃজনশীল চিন্তা চেতনার বিকাশ হয়, সৌন্দর্যের রূপায়ণ হয় তাহলে এই মূর্তি অথবা চিত্রগুলোকে কোন প্রেক্ষিতে শিল্প বলা যায়? এই মূর্তিগুলো ছিল তখনকার সমাজের পুরুষের কামনাতাড়িত মনের প্রতিভাস। সাধারণ ঘরের নারীরা সম্ভবত লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। যে সকল নারীরা বাইরে আসতো তারা ছিল নিম্ন শ্রেণির, কর্মঠ, সাজসজ্জাবিহীন রুক্ষ, কর্কশ রমণী। তাই পুরুষরা যেমন নারীকে কামনা করতো, যেমনভাবে কামনা করতো সেভাবেই তাদেরকে উপস্থাপন করতো শিল্পীগণ।

ইউরোপে চতুর্দশ শতকে রেঁনেসাস বা পুনর্জাগরণ ঘটে। এটি ছিল মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তোরণের সময়। মধ্যযুগের ধর্মীয় আবহ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন। শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞানে নতুন ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটে, যার ছিল একটা নিজস্ব শৈলী; যা ১৪০০ সালে ইতালিতে আবির্ভূত হয়। রেঁনেসার চিত্রকলাকে ধ্রুপদী চিত্রকলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধরা হয়। সান্দ্রো বত্তিচেল্লি ইতালির রেঁনেসা যুগের একজন চিত্রকর। যিনি ‘দা বার্থ অফ ভেনাস ’(১৪৮৫) চিত্রকর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন। টিশিয়ান এঁকেছিলেন ‘স্যাক্রেড এন্ড প্রোফেন লাভ’ (১৫১৩-১৪), আলব্রেখট ডুবার এঁকেছিলেন ‘এডাম এন্ড ইভ’ (১৫০৭)। এসকল চিত্রকর্মেও নারীকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নন্দনতাত্ত্বিকদের মতে প্রাচীন ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলার সাথে রেনেসাঁর শিল্পকলার পার্থক্য এতটুকু যে- পূর্বে মূর্তিগুলো ছিল উন্মাদনা সৃষ্টিকারী। পুরুষ তাকে যেভাবে দেখে, যেভাবে পেতে চায়, নারীর যে অঙ্গগুলো তাকে মোহিত করে তারই যেন আলেখ্য। আর রেনেসাঁ শিল্পে নারীকে শরীরী বিষয়ের সাথে সাথে মানবী করেও তোলা হয়েছে। যতই মানবী বলে শরীরকে আড়াল করতে চান বোদ্ধাগণ পুরুষের চোখে মানবী মানেই কামিনী। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে এরকম নগ্ন নারীর মূর্তি ও চিত্র বহু অঙ্কিত হয়েছে। এগুলো মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অথবা অমুল্য চিত্র শিল্প। বত্তিচেল্লির চিত্রকর্মে দেখা যায় সমুদ্রের ফেনার সাথে উঠে আসছে ভেনাস; তার পুরো শরীর নগ্ন, উন্মুক্ত স্তন, এক হাতে চুলের অগ্রভাগ দিয়ে যোনিদেশ ঢাকা।
নারীর জননাঙ্গসমুহকে যুগে যুগে নানান ভঙ্গীতে প্রদর্শন করা হয়েছে। শিল্পবোদ্ধাগণ নারীর এ রকম মূর্তিগুলোকে উর্বরাশক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। এমনকি মা শিশুকে স্তন পান করাচ্ছেন, শিশু কীভাবে স্তন পান করছে সে মূর্তি ও ছবি অঙ্কিত হয়েছে। তারা এগুলোকে বলেন আর্টিস্টিক, অ্যাস্থেটিক ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এগুলো আর্ট এর শিল্প নয়, এগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিল্প। আসলে নারীর শরীর মহামূল্যবান, কেননা নারীর শরীরই একটা ইন্ডাস্ট্রি। বাংলা ভারতের অনেক প্রাচীন রাজমহল, জমিদার বাড়ি এবং হালে বিভিন্ন কৃত্রিম পার্কে দেখা যায় উলঙ্গ এবং অর্ধ উলঙ্গ অনেক নারীমূর্তি। মৎস্যকন্যা, পরী- এ সকল অতিপ্রাকৃত নারীদেরকেও যৌনাবেদনময়ী রূপে অঙ্কন করা হয়।
আমি শুধু একটা উদাহরণ পেশ করছি। আমরা জমিতে ধান চাষ করি, ধান থেকে চাল তৈরি হয়। ধান উৎপাদন হতে চাল হয়ে আসা পর্যন্ত বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমত কৃষক জমিতে ধান বীজ বপন করে। বীজ থেকে চারা গাছ হয়। চারা গাছ খেতে রোপণ করা হয়। জমি রোপণের উপযোগী করার জন্য তাতে চাষ করা হয়। লাঙল অথবা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা হয়। ট্রাক্টর তৈরি হয় কারখানায়। ক্ষেত নিড়ানোর জন্য নিড়ানী, ধান কাটার জন্য কাস্তে ব্যবহৃত হয়। এগুলো তৈরির জন্য রয়েছে কামারের হস্তশিল্প। ধান মাড়াই করার জন্য, মলনের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আছে সেগুলোও কারখানায় তৈরি হয়। সিদ্ধ করার জন্য বিশাল আকৃতির ডেগচি, ধান থেকে চাল করার ধান ভাঙানো মেশিন রয়েছে। এই যে প্রতিটি ধাপে যে সকল সহায়ক যন্ত্র লাগছে সেসকল যন্ত্র তৈরির জন্য আলাদা আলাদা শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। চাল যে বস্তায় সংরক্ষণ করা সেই বস্তা তৈরির জন্যও কারখানা গড়ে উঠেছে। ভাত রান্নার জন্য যে রাইস কুকার ব্যবহার হয় তার জন্য রয়েছে আলাদা শিল্প। অর্থাৎ একটা পণ্য বা দ্রব্য উৎপাদন করতে তার সহায়ক হিসেবে অনেকগুলো শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে।
পণ্য বা দ্রব্য প্রচার করার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। অতীতকাল থেকেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের বিজ্ঞাপন করতো। কিন্তু যুগে যুগে এর মাধ্যম এবং প্রক্রিয়া ছিল আলাদা। প্রাচীনকালে ব্যবসায়ীরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পণ্যের গুণাগুণ বর্ণনা করতো। সেগুলো শুনে লোকজন আকৃষ্ট হয়ে জিনিস কিনতো। তারপর ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপন প্রচার পদ্ধতি পরিবর্তন হতে থাকে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বাণিজ্যিক রূপ নিতে থাকে। এরপর এলো রেডিও, টেলিভিশন। আর বর্তমানে ইন্টারনেট, ইউটিউব, ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিজ্ঞাপন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে পণ্যের গায়ে কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগানো। বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে নারী। দুই চারটা পণ্য বাদে সব পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীকে ব্যবহার করা হয়। দরকার পড়ুক অথবা নাই পড়ুক। পণ্য-দ্রব্য উৎপাদন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পের মতো নারীর শরীরও একটা শিল্প। নারী-শরীরের মূর্তি হোক অথবা নারী-শরীরের অঙ্কিত চিত্র হোক এবং আজকের বিজ্ঞাপনের নারী অথবা নারীর চিত্রযুক্ত স্টিকার সবই শিল্প। জাস্ট ইন্ডাস্ট্রি।
আমার ছোটোবেলায় দেখেছি সানদার মহিলা-পুরুষরা মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রী ফেরি করতে আসতো। তখন ছোটো ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই নারী পুরুষের শরীর সম্পর্কে কৌতুহলী ছিলাম। প্রসাধন সামগ্রীর মধ্যে একটা ছিল বনানী হেয়ার রিমোভার ক্রিম। মোড়কে অর্ধ উলঙ্গ এক নারীর ছবি। যার পরনে আঁটোসাঁটো শাড়ি, হাত দুইটা ওপরে তোলা, কমনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, পরিষ্কার বগল, নাভী, শাড়িটা যেন নিচের দিকে খুলে পড়ছে। তাকিয়ে থাকতাম ছবির দিকে। আর এখন তো নারীর প্রসাধন, সাজসজ্জার দ্রব্যের বৈচিত্র্য এবং প্রতুলতা আশ্চর্য রকমের বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রেসিয়ারে মেয়েদের স্তনের সুডৌল ছবি, লিপস্টিকের মোড়কে কামুক ঠোঁটের ভঙ্গি, মাসকারায়, আই লাইনারে চোখের দৃষ্টিতে কামশর, পেন্টিতে চমৎকার উরু আর নিতম্বের চিত্র, শাড়িতে স্ফীত কোমর, গভীর নাভি, ভরাট স্তনের ছবি। থ্রি পিসেও মাথা থেকে পা পর্যন্ত কামনাময়ী শরীর উপস্থাপনা। টেলিভিশন, মাল্টিমিডিয়া, ইউটিউবের বিজ্ঞাপনে মডেলদের জীবন্ত ছবি দেখি। মেয়েরাও মডেলিং করার জন্য উন্মত্ত। শোবিজের জগতে শরীর দেখিয়ে প্রতিষ্ঠা পেলে নিজেকে ধন্য মনে করে। সাবান, পাউডার, ক্রিম, বডি স্প্রে মেয়েদের নানান রকম প্রসাধন, পুরুষের প্রসাধন সামগ্রীতেও নারীকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করা হয়। পারিবারিক পরিবেশে টেলিভিশন দেখা যায় না। নারীর ব্যবহারযোগ্য পণ্য প্রচারের জন্য নারীর শরীরকেই কেন ব্যবহার করতে হবে? এগুলো ব্যবহার না করলে নারীরা কি তাদের পণ্য চিনবে না?
কমার্শিয়াল ফিল্মগুলোতে দেখা যায় হিরোর শরীর সুট-কোট-টাই দিয়ে জড়ানো; ওদিকে হিরোইনের শরীরে কাপড় নাই বললেই চলে। বরফের দেশে গিয়ে গানের শুটিং করে। সেখানে নায়কের গরম কাপড়ের অভাব নাই। কিন্তু নায়িকার গায়ে একটা কাঁচুলি আর পরনে একটা লেংগুট ছাড়া আর কিছুই নাই। বাস্তবিক নায়িকার শরীরকে পুঁজি করেই বাণিজ্যিক ছবিগুলো নির্মিত হয়। টেলিভিশন নাটকেও একই অবস্থা। কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের পোশাক স্বল্পতা বড়োই অশালীন। বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে, নাটক সিনেমায় শরীর প্রদর্শন করে মেয়েরা সুপারস্টার হয়। শরীর প্রদর্শনীতে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সময় জীবন-যৌবন বিসর্জনও দেয় অনেকে। যুগ যুগ ধরে নারী-স্বাধীনতার কথা শুনে আসছি। স্বাধীনতার জন্য তারা লড়াই করে আসছে। সে লড়াইয়ের ইস্যু তো নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা নয়। ভেবে চিন্তে দেখলে দেখা যায় নারী ছতর-খোলার স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো স্বাধীনতা পায়নি।
ইউটিউব, গুগলে কোনো শিক্ষণীয় বিষয় দেখতে চাইলে, পড়তে চাইলে সার্চ দিলেই নারীর উদাম দেহের ছবি আগে দেখে নিতে হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয় দেখতে চাইলেও আগে নারীর শরীর দেখতে হয় তারপর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক শিল্প যেন নারীর দেহশিল্প। আর সবচেয়ে সস্তা পণ্য হচ্ছে নারীর বিভিন্ন অঙ্গের অশ্লীল ছবি বা বিজ্ঞাপন। এই যে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র নারী-শরীরের কদর্য ব্যবহার সমগ্র নারী সমাজকে কি লজ্জিত করে না? এতে নারী সমাজ কি অপমানিত বোধ করে না? অবশ্যই করে। সেজন্যই তো সাধারণ নারীরা এ সকল ছবি বিজ্ঞাপন দেখে লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়। এক নারীর শরীর দেখা মানে সকল নারীর শরীর দেখা। কিন্তু শিক্ষিত নারীরা এতে বিব্রত হয় না। তারা এগুলোকে নারীর অর্জন, তার ক্যারিয়ার বলে মনে করে। নারীকে যে ইন্ডাস্ট্রি বানানো হয়েছে এগুলো নিয়ে নারীবাদীরাও কিছু বলে না। এটাকে তারা নারীর এগিয়ে যাওয়া এবং সাফল্য মনে করে। নারীদেহের সর্বাত্মক ব্যবহারকে তারা সমর্থন করে। আজকাল পোশাকের শোরুমগুলোতে পোশাক প্রদর্শনীর জন্য নারী পুরুষের ডামি পুতুল ব্যবহার করা হয়। শোরুমের সামনে এরা সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে। কাপড়ে জড়ানো নারী পুতুলগুলোর স্তন সুউচ্চ, সুস্পষ্ট। ছেলেরা কাপড় দেখার অজুহাতে পুতুলের বুকে হাত দেয়। অনেক সময় দোকানের চিপে-চাপায় নষ্ট পুতুলগুলো উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকে। লোকেরা তাদের বুক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে। দোকানের কর্মচারীরা পুতুলের পোশাক পালটায়। ওরা পুতুলের বুক স্পর্শ করে বিকৃত আনন্দ পায়।

পণ্য বাজারজাতকরণে নারীর শরীর অপরিহার্য, অনস্বীকার্য শিল্পে পরিণত হয়েছে। আমি এখানে একটা বিজ্ঞাপনের উদাহরণ দেবো। এটি একটি অনলাইন ব্যাংকের ব্যাংকিং সেবা নিয়ে বিজ্ঞাপন। সেখানে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা অভিনয় করেছেন। পুরুষটির গায়ে জ্যাকেট। আর মহিলার গায়ে একটা শার্ট। পুরুষটি স্বাভাবিক ভঙ্গীতে হাঁটছে। আর মহিলাটি এমন ভঙ্গীতে হাঁটছে তার বুকের মোশন অদ্ভুতভাবে উঠছে নামছে। যাতে দর্শকের দৃষ্টি তার বুকের দিকেই নিবদ্ধ হয় এবং এই বিজ্ঞাপন বারবার এলেও দর্শকের চোখ ক্লান্ত হয় না। সুতরাং তাদের ব্যবসা কত লাভজনক।
এতো গেল বিভিন্ন ব্যবসায়িক দল, গোষ্ঠী ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নারীর শরীর নিয়ে বাণিজ্য। বর্তমানে ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের শরীর দেখিয়ে টাকা কামাচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে তথাকথিত ভাইরাল হবার জন্য, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বাড়িয়ে টাকা উপার্জনের লক্ষ্যে টিকটক, রিল্স বানিয়ে মেয়েরা দেদার শরীর প্রদর্শন করছে। নারীর এই শরীর-বাণিজ্য কতটুকু যৌক্তিক, তা ভাবার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে নারীকেই সচেতনভাবে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নারী নিজে যদি তার শরীরের অনৈতিক প্রদর্শন বন্ধ করে, তাহলে পুরুষ তাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না।
নারীর শরীর তার সম্পদ, তার আত্মমর্যাদা। অথচ পৃথিবীর আদি থেকে আজ অবধি নারী-শরীরকে যেভাবে যত প্রদর্শন করা হয়েছে অন্য কোনো বস্তুকে এত প্রদর্শন করা হয়নি। সেইটা নন্দনশিল্পেই হোক আর উৎপাদন শিল্পেই হোক। নারী জাতি শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিক হয়েছে। কিন্তু তারা মননে-মানসে সর্বোচ্চ আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। নারী বর্তমানে সমাজের লৌহ-শৃঙ্খল অনেকটাই ভেঙেছে বটে কিন্তু তারা নিজের আত্মর্যাদাবোধ সম্পর্কে এখনো সম্পূর্ণ সজাগ নয় বলেই মনে করি। কোথায় তাদের মর্যাদা, কীসে তাদের আত্মসম্মান- সে সম্পর্কে এখনো তারা প্রায় অন্ধকারে। তাদের শিক্ষা ও সচেতনতা তাদের সেই অন্ধকারকে এখনো সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারেনি। নারী যথার্থ অর্থেই শিক্ষিত ও সচেতন হোক, তার আত্মসম্মান এবং মর্যাদাকে নিজেই পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন করতে শিখুক এটাই কাম্য। শিক্ষার আলো তার চেতনার অন্তর্জগৎকে আলোকিত করুক, ঋদ্ধ করুক ও মহিমান্বিত করুক এটাই প্রত্যাশা করি।
নীলুফার ইয়াসমিন: লেখক ও গবেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা, সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, টাঙ্গাইল

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বন্ধ হোক নারী-অবয়বের কদর্য শিল্পায়ন

আপডেট সময় : ১১:২২:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

কয়েক বছর আগে রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম। সে বছর আমার বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফর ছিল সেখানে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরটি দেখার। তবে বেশি সময় নিয়ে দেখতে পারিনি তখন। এর কারণ, মিউজিয়ামজুড়ে অসংখ্য নগ্ন নারীমূর্তি ছিল। আমাদের সাথে সম্মান শ্রেণির বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ছিল। ওরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় সংগত কারণেই কিছুক্ষণ দেখার পর আমি অনেকটাই সংকোচবোধ করছিলাম। আসলে এত নগ্ন নারীমূর্তি শিক্ষার্থীদের সাথে একত্রে দেখতে বিব্রতবোধ করাটাই তো স্বাভাবিক। ওরা নিজেরাও বিব্রতবোধ করছিল। স্বীকার করছি যে- উভয় পক্ষের এই বিব্রতবোধ আমাদের সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ ও অনভ্যস্ততার কারণেই। শুধু বরেন্দ্র জাদুঘরেই নয় দেশের ছোটো-বড়ো প্রায় সব জাদুঘরেই এরকম অনেক প্রাচীন ভারতীয় নগ্ন নারী মূর্তি শোভা পায়। এগুলোকে বলা হয় ধ্রুপদী শিল্পকলা। শুধু বঙ্গ-ভারতেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কাল সভ্যতায় দেব-দেবী, অপ্সরী, নর্তকী, কিন্নরীর নগ্নমূর্তি, চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এই মূর্তিগুলো সাধারণত মন্দিরে স্থাপিত হতো অথবা মন্দিরগাত্রে খোদিত ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় দেখা যায় নারী-পুরুষ উভয়ের নগ্নমূর্তি। প্রাচীন গ্রিকে পুরুষের নগ্ন শরীর বেশি দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে পুরুষের পেশিশক্তি ও সামর্থ্য এবং পুরুষের পরাক্রমকে তুলে ধরা হতো।
গ্রিক দেবী আফ্রোদিতির একটি মূর্তি নির্মাণ করেন ভাস্কর প্রক্সিতেলেস খ্রি.পূ. ৪র্থ শতকে। দেবীর মাথা কাটা, হাত বাহু পর্যন্ত কাটা। আবেদনময়ী দেহ ভঙ্গীমায় দাঁড়ানো বেদীর ওপর। দেবীর পীনোন্নত, বর্তুল, সুপুষ্ট স্তন, গভীর নাভী, বিশাল উরু, স্ফীত জঘন ও যোনি যেকোনো পুরুষকে কামনাদগ্ধ করবে। যেন সে নারী নয়। মূর্তিমতী কামনা। মন্দিরে প্রবেশ করে পুরুষরা পুরোহিতকে ঘুষ দিয়ে ওই মূর্তিকে আলিঙ্গন করত।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাস্কর্য শিল্পের মধ্যে ছিল স্বর্গের অপ্সরা, নর্তকীদের মূর্তি, গন্ধর্ব মিথুন, বিষ্ণু-লক্ষ্মী, হর-পার্বতী, চণ্ডী, মারকন্যা, যক্ষী ইত্যাদি। এসকল ভাস্কর্যে নারীদের নগ্ন অথবা অর্ধ-নগ্নমূর্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এরা যেন নারী নয় জ্বলন্ত কামাগ্নী। অজন্তার গুহা চিত্রে যে মারকন্যার চিত্র রয়েছে তাতে তাদের অর্ধ নিমীলিত চোখের দৃষ্টি, সুডৌল স্তন, স্তনবৃন্ত, ক্ষীণ কটি তাদেরকে জীবন্ত করে তুলেছে। তাদের চোখ ও দেহের ভঙ্গীতে রয়েছে উন্মাদনা। সেই পাথরের মূর্তিই পুরুষকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। নন্দনতাত্ত্বিকগণ এই মূর্তিগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের নিকট এগুলো অপূর্ব শিল্প-শৈলীর নিদর্শন। শিল্প যদি মানবমনের সৃজনশীল চিন্তা চেতনার বিকাশ হয়, সৌন্দর্যের রূপায়ণ হয় তাহলে এই মূর্তি অথবা চিত্রগুলোকে কোন প্রেক্ষিতে শিল্প বলা যায়? এই মূর্তিগুলো ছিল তখনকার সমাজের পুরুষের কামনাতাড়িত মনের প্রতিভাস। সাধারণ ঘরের নারীরা সম্ভবত লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। যে সকল নারীরা বাইরে আসতো তারা ছিল নিম্ন শ্রেণির, কর্মঠ, সাজসজ্জাবিহীন রুক্ষ, কর্কশ রমণী। তাই পুরুষরা যেমন নারীকে কামনা করতো, যেমনভাবে কামনা করতো সেভাবেই তাদেরকে উপস্থাপন করতো শিল্পীগণ।

ইউরোপে চতুর্দশ শতকে রেঁনেসাস বা পুনর্জাগরণ ঘটে। এটি ছিল মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তোরণের সময়। মধ্যযুগের ধর্মীয় আবহ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন। শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞানে নতুন ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটে, যার ছিল একটা নিজস্ব শৈলী; যা ১৪০০ সালে ইতালিতে আবির্ভূত হয়। রেঁনেসার চিত্রকলাকে ধ্রুপদী চিত্রকলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধরা হয়। সান্দ্রো বত্তিচেল্লি ইতালির রেঁনেসা যুগের একজন চিত্রকর। যিনি ‘দা বার্থ অফ ভেনাস ’(১৪৮৫) চিত্রকর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন। টিশিয়ান এঁকেছিলেন ‘স্যাক্রেড এন্ড প্রোফেন লাভ’ (১৫১৩-১৪), আলব্রেখট ডুবার এঁকেছিলেন ‘এডাম এন্ড ইভ’ (১৫০৭)। এসকল চিত্রকর্মেও নারীকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নন্দনতাত্ত্বিকদের মতে প্রাচীন ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলার সাথে রেনেসাঁর শিল্পকলার পার্থক্য এতটুকু যে- পূর্বে মূর্তিগুলো ছিল উন্মাদনা সৃষ্টিকারী। পুরুষ তাকে যেভাবে দেখে, যেভাবে পেতে চায়, নারীর যে অঙ্গগুলো তাকে মোহিত করে তারই যেন আলেখ্য। আর রেনেসাঁ শিল্পে নারীকে শরীরী বিষয়ের সাথে সাথে মানবী করেও তোলা হয়েছে। যতই মানবী বলে শরীরকে আড়াল করতে চান বোদ্ধাগণ পুরুষের চোখে মানবী মানেই কামিনী। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে এরকম নগ্ন নারীর মূর্তি ও চিত্র বহু অঙ্কিত হয়েছে। এগুলো মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অথবা অমুল্য চিত্র শিল্প। বত্তিচেল্লির চিত্রকর্মে দেখা যায় সমুদ্রের ফেনার সাথে উঠে আসছে ভেনাস; তার পুরো শরীর নগ্ন, উন্মুক্ত স্তন, এক হাতে চুলের অগ্রভাগ দিয়ে যোনিদেশ ঢাকা।
নারীর জননাঙ্গসমুহকে যুগে যুগে নানান ভঙ্গীতে প্রদর্শন করা হয়েছে। শিল্পবোদ্ধাগণ নারীর এ রকম মূর্তিগুলোকে উর্বরাশক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। এমনকি মা শিশুকে স্তন পান করাচ্ছেন, শিশু কীভাবে স্তন পান করছে সে মূর্তি ও ছবি অঙ্কিত হয়েছে। তারা এগুলোকে বলেন আর্টিস্টিক, অ্যাস্থেটিক ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এগুলো আর্ট এর শিল্প নয়, এগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিল্প। আসলে নারীর শরীর মহামূল্যবান, কেননা নারীর শরীরই একটা ইন্ডাস্ট্রি। বাংলা ভারতের অনেক প্রাচীন রাজমহল, জমিদার বাড়ি এবং হালে বিভিন্ন কৃত্রিম পার্কে দেখা যায় উলঙ্গ এবং অর্ধ উলঙ্গ অনেক নারীমূর্তি। মৎস্যকন্যা, পরী- এ সকল অতিপ্রাকৃত নারীদেরকেও যৌনাবেদনময়ী রূপে অঙ্কন করা হয়।
আমি শুধু একটা উদাহরণ পেশ করছি। আমরা জমিতে ধান চাষ করি, ধান থেকে চাল তৈরি হয়। ধান উৎপাদন হতে চাল হয়ে আসা পর্যন্ত বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমত কৃষক জমিতে ধান বীজ বপন করে। বীজ থেকে চারা গাছ হয়। চারা গাছ খেতে রোপণ করা হয়। জমি রোপণের উপযোগী করার জন্য তাতে চাষ করা হয়। লাঙল অথবা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা হয়। ট্রাক্টর তৈরি হয় কারখানায়। ক্ষেত নিড়ানোর জন্য নিড়ানী, ধান কাটার জন্য কাস্তে ব্যবহৃত হয়। এগুলো তৈরির জন্য রয়েছে কামারের হস্তশিল্প। ধান মাড়াই করার জন্য, মলনের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আছে সেগুলোও কারখানায় তৈরি হয়। সিদ্ধ করার জন্য বিশাল আকৃতির ডেগচি, ধান থেকে চাল করার ধান ভাঙানো মেশিন রয়েছে। এই যে প্রতিটি ধাপে যে সকল সহায়ক যন্ত্র লাগছে সেসকল যন্ত্র তৈরির জন্য আলাদা আলাদা শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। চাল যে বস্তায় সংরক্ষণ করা সেই বস্তা তৈরির জন্যও কারখানা গড়ে উঠেছে। ভাত রান্নার জন্য যে রাইস কুকার ব্যবহার হয় তার জন্য রয়েছে আলাদা শিল্প। অর্থাৎ একটা পণ্য বা দ্রব্য উৎপাদন করতে তার সহায়ক হিসেবে অনেকগুলো শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে।
পণ্য বা দ্রব্য প্রচার করার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। অতীতকাল থেকেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের বিজ্ঞাপন করতো। কিন্তু যুগে যুগে এর মাধ্যম এবং প্রক্রিয়া ছিল আলাদা। প্রাচীনকালে ব্যবসায়ীরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পণ্যের গুণাগুণ বর্ণনা করতো। সেগুলো শুনে লোকজন আকৃষ্ট হয়ে জিনিস কিনতো। তারপর ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপন প্রচার পদ্ধতি পরিবর্তন হতে থাকে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বাণিজ্যিক রূপ নিতে থাকে। এরপর এলো রেডিও, টেলিভিশন। আর বর্তমানে ইন্টারনেট, ইউটিউব, ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিজ্ঞাপন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে পণ্যের গায়ে কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগানো। বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে নারী। দুই চারটা পণ্য বাদে সব পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীকে ব্যবহার করা হয়। দরকার পড়ুক অথবা নাই পড়ুক। পণ্য-দ্রব্য উৎপাদন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পের মতো নারীর শরীরও একটা শিল্প। নারী-শরীরের মূর্তি হোক অথবা নারী-শরীরের অঙ্কিত চিত্র হোক এবং আজকের বিজ্ঞাপনের নারী অথবা নারীর চিত্রযুক্ত স্টিকার সবই শিল্প। জাস্ট ইন্ডাস্ট্রি।
আমার ছোটোবেলায় দেখেছি সানদার মহিলা-পুরুষরা মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রী ফেরি করতে আসতো। তখন ছোটো ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই নারী পুরুষের শরীর সম্পর্কে কৌতুহলী ছিলাম। প্রসাধন সামগ্রীর মধ্যে একটা ছিল বনানী হেয়ার রিমোভার ক্রিম। মোড়কে অর্ধ উলঙ্গ এক নারীর ছবি। যার পরনে আঁটোসাঁটো শাড়ি, হাত দুইটা ওপরে তোলা, কমনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, পরিষ্কার বগল, নাভী, শাড়িটা যেন নিচের দিকে খুলে পড়ছে। তাকিয়ে থাকতাম ছবির দিকে। আর এখন তো নারীর প্রসাধন, সাজসজ্জার দ্রব্যের বৈচিত্র্য এবং প্রতুলতা আশ্চর্য রকমের বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রেসিয়ারে মেয়েদের স্তনের সুডৌল ছবি, লিপস্টিকের মোড়কে কামুক ঠোঁটের ভঙ্গি, মাসকারায়, আই লাইনারে চোখের দৃষ্টিতে কামশর, পেন্টিতে চমৎকার উরু আর নিতম্বের চিত্র, শাড়িতে স্ফীত কোমর, গভীর নাভি, ভরাট স্তনের ছবি। থ্রি পিসেও মাথা থেকে পা পর্যন্ত কামনাময়ী শরীর উপস্থাপনা। টেলিভিশন, মাল্টিমিডিয়া, ইউটিউবের বিজ্ঞাপনে মডেলদের জীবন্ত ছবি দেখি। মেয়েরাও মডেলিং করার জন্য উন্মত্ত। শোবিজের জগতে শরীর দেখিয়ে প্রতিষ্ঠা পেলে নিজেকে ধন্য মনে করে। সাবান, পাউডার, ক্রিম, বডি স্প্রে মেয়েদের নানান রকম প্রসাধন, পুরুষের প্রসাধন সামগ্রীতেও নারীকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করা হয়। পারিবারিক পরিবেশে টেলিভিশন দেখা যায় না। নারীর ব্যবহারযোগ্য পণ্য প্রচারের জন্য নারীর শরীরকেই কেন ব্যবহার করতে হবে? এগুলো ব্যবহার না করলে নারীরা কি তাদের পণ্য চিনবে না?
কমার্শিয়াল ফিল্মগুলোতে দেখা যায় হিরোর শরীর সুট-কোট-টাই দিয়ে জড়ানো; ওদিকে হিরোইনের শরীরে কাপড় নাই বললেই চলে। বরফের দেশে গিয়ে গানের শুটিং করে। সেখানে নায়কের গরম কাপড়ের অভাব নাই। কিন্তু নায়িকার গায়ে একটা কাঁচুলি আর পরনে একটা লেংগুট ছাড়া আর কিছুই নাই। বাস্তবিক নায়িকার শরীরকে পুঁজি করেই বাণিজ্যিক ছবিগুলো নির্মিত হয়। টেলিভিশন নাটকেও একই অবস্থা। কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের পোশাক স্বল্পতা বড়োই অশালীন। বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে, নাটক সিনেমায় শরীর প্রদর্শন করে মেয়েরা সুপারস্টার হয়। শরীর প্রদর্শনীতে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সময় জীবন-যৌবন বিসর্জনও দেয় অনেকে। যুগ যুগ ধরে নারী-স্বাধীনতার কথা শুনে আসছি। স্বাধীনতার জন্য তারা লড়াই করে আসছে। সে লড়াইয়ের ইস্যু তো নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা নয়। ভেবে চিন্তে দেখলে দেখা যায় নারী ছতর-খোলার স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো স্বাধীনতা পায়নি।
ইউটিউব, গুগলে কোনো শিক্ষণীয় বিষয় দেখতে চাইলে, পড়তে চাইলে সার্চ দিলেই নারীর উদাম দেহের ছবি আগে দেখে নিতে হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয় দেখতে চাইলেও আগে নারীর শরীর দেখতে হয় তারপর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক শিল্প যেন নারীর দেহশিল্প। আর সবচেয়ে সস্তা পণ্য হচ্ছে নারীর বিভিন্ন অঙ্গের অশ্লীল ছবি বা বিজ্ঞাপন। এই যে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র নারী-শরীরের কদর্য ব্যবহার সমগ্র নারী সমাজকে কি লজ্জিত করে না? এতে নারী সমাজ কি অপমানিত বোধ করে না? অবশ্যই করে। সেজন্যই তো সাধারণ নারীরা এ সকল ছবি বিজ্ঞাপন দেখে লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়। এক নারীর শরীর দেখা মানে সকল নারীর শরীর দেখা। কিন্তু শিক্ষিত নারীরা এতে বিব্রত হয় না। তারা এগুলোকে নারীর অর্জন, তার ক্যারিয়ার বলে মনে করে। নারীকে যে ইন্ডাস্ট্রি বানানো হয়েছে এগুলো নিয়ে নারীবাদীরাও কিছু বলে না। এটাকে তারা নারীর এগিয়ে যাওয়া এবং সাফল্য মনে করে। নারীদেহের সর্বাত্মক ব্যবহারকে তারা সমর্থন করে। আজকাল পোশাকের শোরুমগুলোতে পোশাক প্রদর্শনীর জন্য নারী পুরুষের ডামি পুতুল ব্যবহার করা হয়। শোরুমের সামনে এরা সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে। কাপড়ে জড়ানো নারী পুতুলগুলোর স্তন সুউচ্চ, সুস্পষ্ট। ছেলেরা কাপড় দেখার অজুহাতে পুতুলের বুকে হাত দেয়। অনেক সময় দোকানের চিপে-চাপায় নষ্ট পুতুলগুলো উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকে। লোকেরা তাদের বুক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে। দোকানের কর্মচারীরা পুতুলের পোশাক পালটায়। ওরা পুতুলের বুক স্পর্শ করে বিকৃত আনন্দ পায়।

পণ্য বাজারজাতকরণে নারীর শরীর অপরিহার্য, অনস্বীকার্য শিল্পে পরিণত হয়েছে। আমি এখানে একটা বিজ্ঞাপনের উদাহরণ দেবো। এটি একটি অনলাইন ব্যাংকের ব্যাংকিং সেবা নিয়ে বিজ্ঞাপন। সেখানে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা অভিনয় করেছেন। পুরুষটির গায়ে জ্যাকেট। আর মহিলার গায়ে একটা শার্ট। পুরুষটি স্বাভাবিক ভঙ্গীতে হাঁটছে। আর মহিলাটি এমন ভঙ্গীতে হাঁটছে তার বুকের মোশন অদ্ভুতভাবে উঠছে নামছে। যাতে দর্শকের দৃষ্টি তার বুকের দিকেই নিবদ্ধ হয় এবং এই বিজ্ঞাপন বারবার এলেও দর্শকের চোখ ক্লান্ত হয় না। সুতরাং তাদের ব্যবসা কত লাভজনক।
এতো গেল বিভিন্ন ব্যবসায়িক দল, গোষ্ঠী ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নারীর শরীর নিয়ে বাণিজ্য। বর্তমানে ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের শরীর দেখিয়ে টাকা কামাচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে তথাকথিত ভাইরাল হবার জন্য, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বাড়িয়ে টাকা উপার্জনের লক্ষ্যে টিকটক, রিল্স বানিয়ে মেয়েরা দেদার শরীর প্রদর্শন করছে। নারীর এই শরীর-বাণিজ্য কতটুকু যৌক্তিক, তা ভাবার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে নারীকেই সচেতনভাবে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নারী নিজে যদি তার শরীরের অনৈতিক প্রদর্শন বন্ধ করে, তাহলে পুরুষ তাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না।
নারীর শরীর তার সম্পদ, তার আত্মমর্যাদা। অথচ পৃথিবীর আদি থেকে আজ অবধি নারী-শরীরকে যেভাবে যত প্রদর্শন করা হয়েছে অন্য কোনো বস্তুকে এত প্রদর্শন করা হয়নি। সেইটা নন্দনশিল্পেই হোক আর উৎপাদন শিল্পেই হোক। নারী জাতি শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিক হয়েছে। কিন্তু তারা মননে-মানসে সর্বোচ্চ আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। নারী বর্তমানে সমাজের লৌহ-শৃঙ্খল অনেকটাই ভেঙেছে বটে কিন্তু তারা নিজের আত্মর্যাদাবোধ সম্পর্কে এখনো সম্পূর্ণ সজাগ নয় বলেই মনে করি। কোথায় তাদের মর্যাদা, কীসে তাদের আত্মসম্মান- সে সম্পর্কে এখনো তারা প্রায় অন্ধকারে। তাদের শিক্ষা ও সচেতনতা তাদের সেই অন্ধকারকে এখনো সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারেনি। নারী যথার্থ অর্থেই শিক্ষিত ও সচেতন হোক, তার আত্মসম্মান এবং মর্যাদাকে নিজেই পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন করতে শিখুক এটাই কাম্য। শিক্ষার আলো তার চেতনার অন্তর্জগৎকে আলোকিত করুক, ঋদ্ধ করুক ও মহিমান্বিত করুক এটাই প্রত্যাশা করি।
নীলুফার ইয়াসমিন: লেখক ও গবেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা, সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, টাঙ্গাইল