প্রযুক্তি ডেস্ক : একটি ক্ষমতাধর বা শক্তিশালী কম্পিউটার, যা চোখের পলকে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে, এমন কল্পনাই বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন (ইউসিএল)’-এর প্রকৌশলীরা। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি দেখিয়েছেন ইউসিএল-এর প্রকৌশলীরা। এটি এমন এক ধরনের সুপার কম্পিউটার, যা কাজ করে ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ নীতির ভিত্তিতে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স— পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। পরমাণুর পরিসর ও প্রকৃতির আচরণ বর্ণনা করার পাশাপাশি এটি প্রকৃতির এমন এক মৌলিক নিয়ম ব্যাখ্যা করে যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে মহাবিশ্বে হওয়া ঘটনাবলীর। গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘অ্যাডভান্সড ম্যাটিরিয়ালস’-এ, যেখানে প্রায় নিখুঁতভাবে এ ধরনের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির নতুন একটি উপায় তুলে ধরা হয়েছে। ২৫ বছরে এই প্রথম বিজ্ঞানীরা সুপার কম্পিউটার তৈরির উদ্দেশ্যে একক পরমাণু স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে নির্ভুলতার হার প্রায় শতভাগ। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোয়ান্টাম কস্পিউটিংয়ে এ ধরনের একক পরমাণু ব্যবহৃত হয় ‘কিউবিট’ তৈরির উদ্দেশ্যে, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিভিন্ন ‘ব্লক’ নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে ‘কিউবিট বা কোয়ান্টাম বিট’ হল কোয়ান্টাম তথ্যের একটি মৌলিক একক। বর্তমান সময়ের কম্পিউটারে বাইনারি একক (০ ও ১) ব্যবহৃত হলেও এর বিপরীতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয় ‘কিউবিট’, যা একইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ ডেটা চিহ্নিত ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। এ গবেষণায় দুটি কোয়ান্টাম ঘটনাকে সামনে আনা হয়। একটি— ‘সুপারপজিশন’, যেখানে বিভিন্ন ‘কিউবিট’ একসঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। অন্যটি হল— ‘এনট্যাঙ্গলমেন্ট’, যেখানে বিভিন্ন কিউবিট যত দূরেই থাকুক না কেন, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সংযুক্ত হতে পারে। এই সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খুব জটিল সমস্যা মোকাবেলার সুযোগ পেতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যা প্রচলিত সুপার কম্পিউটারের জন্যও কঠিন। ওষুধ, অর্থ ও নিরাপত্তা খাতে এ প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে ব্যাপক ধারণা রয়েছে। এ মূহুর্তে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি খুঁজে দেখা হচ্ছে। তবে, এর কাজের পরিসর বাড়াতে ও ত্রুটির হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন গবেষকরা। নিজস্ব গবেষণা পদ্ধতিতে আলাদাভাবে সিলিকন স্ফটিকের মধ্যে আর্সেনিক পরমাণু বসিয়ে দেখেছে ইউসিএল-এর গবেষণা দলটি। প্রচলিত বিভিন্ন কম্পিউটার চিপে ব্যবহার করা উপাদান হল সিলিকন। পাশাপাশি, আর্সেনিকও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের পরিচিত এক উপাদান। ফলে, এ পদ্ধতিতে তৈরি প্রযুক্তির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ এটি। এর আগের প্রচেষ্টায় ফসফরাস পরমাণু ব্যবহার করেছিলেন গবেষকরা, যা ৭০ শতাংশ সময় সঠিকভাবে স্থাপন করা গেছে। তবে, দলটি আর্সেনিক ব্যবহার করার পর এর ব্যর্থতার হার কমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
এ গবেষণার প্রধান লেখক ড. টেইলর স্টক বলেছেন, ৯৭ শতাংশ নির্ভুলতার সঙ্গে পরমাণু বসানো সম্ভব হয়েছে। আর শিগগিরই শতভাগ সাফল্যে পৌঁছানোর বিষয়ে আশাবাদী তারা। তবে, এক্ষেত্রে সমস্যাও আছে। কারণ, এ মুহূর্তে পরমাণুগুলো স্থাপন করতে হচ্ছে ‘ম্যানুয়াল’ উপায়ে, যা বেশ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। ঠিক যেন প্রতিটি পরমাণুকে আলাদাভাবে বসাতে একটি সুই ব্যবহার করার মতো। তাই লাখ লাখ, এমনকি শত কোটি কিউবিটওয়ালা কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য এ প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয় করার পাশাপাশি এর গতিও বাড়াতে হবে। এমন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এ গবেষণার সম্ভাব্য পুরষ্কার বিশাল, যেখানে বেশ কিছু শিল্প ও গবেষণা খাতে বড় অগ্রগতি দেখাতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। সিলিকন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজারমূল্য প্রায় ৫৫ হাজার কোটি ডলার। আর সিলিকন ও আর্সেনিক’কে সমন্বয় করা এ গবেষণা কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকে বাস্তব রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ। গবেষণার জ্যেষ্ঠ লেখক অধ্যাপক নিল কার্সনের দাবি, এ গবেষণার মাধ্যমে বড় এক মাইলফলক অর্জন করেছেন গবেষকরা। আর এ গবেষণার পরবর্তী ধাপ হতে পারে এই প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে ও স্বয়ংক্রিয় করতে যেসব প্রকৌশলগত কাজ করা প্রয়োজন, সেগুলো পূরণ করা। তবে, একটি বৈশ্বিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির বিষয়ে আশাবাদী কার্সন।