খন্দকার ফারজানা রহমান : নশ্বর এই পৃথিবীতে কিছুই অবিনশ্বর নয়। আমি যখন অধ্যাপক জিয়া রহমান স্যারের প্রয়াণের খবরটি শুনলাম, তখন পিএইচডির জন্য শিকাগোতে অবস্থান করছি। খবরটি এতই আকস্মিক যে বিগত ১২ ঘণ্টায় অন্য কোনোকিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না।
উনার মৃত্যু সংবাদ এভাবে পাবো এবং কীভাবে আত্মস্থ করবো তা নিয়ে আমি এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এক রকম হতবুদ্ধি দশার মধ্যেই উনাকে স্মরণ করছি, কিছু লিখছি।
অধ্যাপক জিয়া রহমান স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলোজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সময় এবং তখন থেকেই উনার সাথে সহকর্মী হিসেবে খুব কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন এবং এই বিভাগে যোগদানের কারণে শুরুর দিকে তার সান্নিধ্যে আমার শিক্ষকতা ও গবেষক জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাই একজন সহকর্মী হিসেবে তার মতাদর্শ, পেশাগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণগুলো আমি কাজে তুলে ধরেছি।
স্যারকে আমি যতদিন থেকে চিনি ততদিনই দেখেছি উনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-জাগরণ, অসা¤প্রদায়িকতা, সামাজিক অস্থিরতা ও জঙ্গিবাদ নিয়ে সবসময় সরব ছিলেন। তিনি আমাদের শিক্ষকদের থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত হতে উদ্বুদ্ধ করতেন।
সেই লক্ষ্যেই বিভাগে বিভিন্ন সময় সেমিনার, কথোপকথন ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন টকশো ও সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিগুলো তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়ে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমি তাকে দেখেছি অসা¤প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ ও লালন করতেন। অসা¤প্রদায়িক চেতনা যে একটি জাতিকে উন্নয়নের পথে অগ্রগণ্য করে রাখতে পারে তা তিনি তার জীবদ্দশায় বারবার ব্যক্ত করেছেন।
সা¤প্রদায়িকতা নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপের জন্য তিনি বারবার সমালোচনার শিকার হয়েছেন কিন্তু আমি তাকে কখনোই তার অবস্থান থেকে সরে যেতে দেখিনি। অপরদিকে সামাজিক বিভিন্ন অস্থিরতাকে তিনি তাত্তি¡ক ও বর্তমান যুগের সাথে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
বর্তমানে আধুনিকায়ন ও বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুলিশ কাঠামোর ব্যাপক সংস্কারই পারে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে; একই সঙ্গে উপযুক্ত শা¯িÍ বিধানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি যা তার লেখনী ও গবেষণায় প্রস্ফুটিত হয়েছে।
কারণ, আমরা জানি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি বড় বৈশিষ্ট্য। দ্রæত অপরাধীদের শা¯িÍ বিধানের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পুলিশের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, অন্যদিকে জনগণের কাছে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যায়।
এছাড়াও তার মতে, ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ পুলিশিংয়ের কোনোই বিকল্প নেই। এর অর্থ হলো যেকোনো অপরাধ যাতে সংঘটিত হতে না পারে সেইভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এছাড়া তিনি সামাজিক বিভিন্ন বিষয় এবং সামাজিক আন্দোলন নিয়ে সবসময় সরব ছিলেন, যেমনÑবিচারহীনতার সংস্কৃতি, অতি রাজনীতিকীকরণ, সা¤প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ ইত্যাদি। তিনি মনে করতেন এসব কারণের ফলেই সাধারণ মানুষ তাদের সঠিক প্রাপ্য বিচার পাচ্ছে না এবং সমাজে অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
পাশাপাশি জঙ্গিবাদ নিয়ে আমি তাকে তার কর্মজীবনের পুরোটা সময় গবেষণা, লেখালিখি, আলোচনা সভা ও কাজ করতে দেখেছি। সর্বশেষ তার লেখা ‘ঞবৎৎড়ৎরংস রহ ইধহমষধফবংয: ঞযব চৎড়পবংং ড়ভ জধফরপধষরংধঃরড়হ ধহফ ণড়ঁঃয ঠঁষহবৎধনরষরঃরবং’Ñবইটি একটি গবেষণামূলক বই যেখানে তিনি জঙ্গিবাদের বিভিন্ন দিকসহ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কীভাবে জঙ্গিবাদের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ছে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
বইটি বাংলাদেশভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের প্রথম অভিজ্ঞতামূলক অধ্যয়ন যা মৌলবাদের প্রক্রিয়া, মতাদর্শ এবং তরুণদের দুর্বলতা যা সহিংসতার দিকে পরিচালিত করে তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। গুণগত গবেষণা পদ্ধতি গ্রহণ করে, এটি প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসী সন্দেহভাজন, তাদের পরিবার, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।
একটি রাজনৈতিক-ধর্মীয় প্রকৃতির সন্ত্রাসবাদের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে, বইটি বোঝার চেষ্টা করে যেকোনো উপাদানগুলো সহিংস একক পরিচয় বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে এবং প্রবৃত্তি, রাজনীতি ও বি¯Íার, দুর্বল যুবকদের সাথে অঞ্চলগুলোর চরমপন্থার ঝুঁকির দিকে নজর দেয়।
বাংলাদেশে একাডেমিক-পুলিশ গবেষণার যে পার্টনারশিপ, তার পেশাগত ভিত্তি মজবুত করতে অধ্যাপক জিয়া রহমানের অবদান বিশেষভাবে উলেøখযোগ্য বলে আমি মনে করি। বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণা ফিল্ডে পাঠিয়ে তিনি পুলিশের নানান দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন।
পৃথিবীর নানান জায়গায় আজ ক্রিমিনোলজির শিক্ষার্থীরা সফলতার সাথে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। তাদের গবেষণার হাতেখড়ি এসব প্রজেক্টের মাধ্যমেই হয়েছে। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সাথে গবেষণা করেছি।
বাংলাদেশকে হয়তো আরও অনেক কিছু দিতে পারতেন তিনি চাইলে কিন্তু সময় পেলেন না। চলে যাওয়ার বড় তাড়া তার পিছু ছাড়েনি। পরিশেষে এইটুকুই বলতে চাই, মানুষ বাঁচে তার কর্মে, আয়ুতে নয়।
অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান শুধুমাত্র আমার সহকর্মীই ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে পÐিত ছিলেন। উনার কাছে পেশাগত জায়গায় অনেক কিছু শিখেছি। উনার মতাদর্শ ও কাজের মধ্যে উনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)
অধ্যাপক জিয়া রহমান: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর
জনপ্রিয় সংবাদ