অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাঙালির জীবনে এক কালোঅধ্যায় নেমে আসে। আমরা পরাধীন হলাম। সেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে আমরা ভারত-পাকিস্তান একসঙ্গে ১৯০ বছর লড়াই করেছি। আমাদের দুর্বলতা ছিল আমাদের অনৈক্য। আমরা কেউ মুসলিম আর কেউ হিন্দু। আর সেই দুর্বলতাকে পুঁজি করে ইংরেজরা আমাদের ১৯০ বছর শোষণ ও শাসন করেছে। আমরা একটা স্বাধীনতা ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পেয়েছিলাম। ভারত স্বাধীন হয়েছিল ১৫ আগস্ট। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করতে পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেব নিয়ে এলেন উর্দু ভাষার বয়ান। কেঁপে উঠল ক্ষণিক বাঙালির মন! মনে প্রশ্ন জাগলো- আমরা কি তবে স্বাধীন হয়েছি? আমরা ধর্মকে ভিত্তি করে পাকিস্তান বানিয়েছি কিন্তু -আমাদের ভাষা? এখন কি তবে ইংরেজির বদলে উর্দু শিখতে হবে? এখনকি তবে সালোয়ার কামিজ টুপি পরতে হবে? বাঙালি আর অপেক্ষা করেনি সিদ্ধান্ত নিতে। না- বাংলা হবে আমাদের মাতৃভাষা। সেই থেকে আমাদের স্বাধীনতা মানে ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীনতাকে সকল আদর্শর উপরে স্থান দিয়েছি। আবার সংগ্রাম করেছি স্বাধীনতার। আমাদের কাছে স্বাধীনতা মানে আমার জীবনধারা আমার ভাবনা থেকে আসবে।
স্বাধীনতার জন্য ইউরোপের মানুষ সরতে সরতে নেদারল্যান্ড থেকে নিউইয়র্ক পাড়ি জমিয়েছে। বানিয়েছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি। এই স্বাধীনতাকে আন্তর্জাতিক আদর্শ বানিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকা। অপরদিকে চীনের একজন নাগরিক তার শহর থেকে অন্য শহরে গেলে রাষ্ট্রীয় সুবিধা বন্ধ করে দেয়। সেখানে একদল ক্ষমতায় থাকে। নেই গণতন্ত্র। তারা এভাবে উন্নয়ন করেছে অনেক। আজ তারা বলতে চায় গণতন্ত্র-স্বাধীনতা উন্নয়নের সহায়ক নয়। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হাসি পায়। স্বাধীনতা মানুষের প্রতিটি রক্তের কণায় কণায়। সেই স্বাধীনতাকে মানুষ লালন করে। সেই স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না যারা, তারা মানুষ কি না তা ভাবনার বিষয়।
মেরুদ-হীন জীবন বাংলায় কখনোই চায়নি। আর তাই বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে নিজের জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছে। সেই স্বাধীনতা কারও দান নয়-রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতা। স্বাধীনতার একটি অর্থ আমি পেয়েছি বাঙালি দার্শনিক-অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ‘উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধং ঋৎববফড়স ’ লেখা থেকে। উন্নয়ন সক্ষমতা ও স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা। তথ্য থেকে জ্ঞান আর জ্ঞান থেকে মানুষ সক্ষমতা অর্জন করে। জ্ঞান মানুষকে স্বাধীন করে সেটা আমরা জানি প্রাচীন দার্শনিক প্লেটোর রিপাবলিক থেকে।
স্বাধীনতা মানে বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আমি কি খাবো এবং কি খাবোনা সেটাও, কি পরবো কি পড়বোনা সেটা আমাদের স্বাধীনতা। তবে তাই বলে ঘুষ ও সুদ নেয়াকে স্বাধীনতা বলা যায় না। তেমনি প্রতারণা, দুর্ভোগ সৃষ্টি করবার সক্ষমতাকে প্রদর্শন স্বাধীনতা বলা যায় না। মানুষের স্বাধীনতা আছে বলেই সে নৈতিক সত্তা। প্রাণীর স্বাধীনতা আছে তবে তারা নৈতিক সত্তা নয়।
স্বাধীনতা মানে দাসত্ব থেকে মুক্তি-নিজের বিবেকের কাছে নিজেকে বন্দি করা। আজ সেই স্বাধীনতা যেন কেন জানি হুমকির মুখে। করোনা আমাদের সেই স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করে দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যেন একে অপরের কাছে অচেনা হয়ে যাচ্ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে স্বাধীনতার কথা বলে একটি মহল দিনে দিনে আমাদের পরাধীন করবার খেলায় মেতেছে। করোনার কথা বলে আমাদের ও সরকারের মাঝে একটি শক্ত দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা তাই শঙ্কিত।
অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে তাই স্বাধীনতার পূজারিরা রাজপথে নামছে। চীন মনে করে আমেরিকান স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধারণা দিয়ে গড়া বিশ্ব সম্পর্ক বদলে দিতে হবে। বাঙালি যে স্বাধীনতাকে লালন করে তাদের চেতনায় সেই স্বাধীনতা কি হুমকিতে? আন্তর্জাতিক দখলদারকে পরাস্থ করে আমরা যেন-বাঁচিয়ে রাখি স্বাধীন বাংলার স্বপ্নটাকে-স্বাধীনতা নাগরিকদের তাদের ভালোভাবে বাঁচার স্বার্থ ও সেজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও পরিকল্পনা এবং পলিসি প্রণয়ণে অধিকার দেয়। সেই অধিকার যাতে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য আমাদের সচেতন থাকা একান্ত জরুরি। স্বাধীনতা মানে ন্যায়বিচার (ভধরৎঃৎরধষ) পাওয়ার অধিকার। আজ সেই অধিকার যে হুমকিতে তা আমরা প্রায় দেখছি। নীরবতাকে সম্মতি হিসেবে নিয়ে যাতে আমাদেরকে কেউ ভুল পথে নিতে না পারে সেজন্য প্রতিবাদ করা স্বাধীনতার অংশ।
স্বাধীন বাংলার স্বপ্নকে মাথায় নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রাম বাঙালি করেছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্ট হত্যা করে বন্দি করা হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতাকে। আমরা সামরিক জালে সামরিক হুকুমে অনেক দিন আটকে ছিলাম। সেই স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের আবার ২১ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই কদাকার অন্ধকার শক্তি আবার একে একে বাতিগুলোকে নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকার ঘনীভূত করছে- আমাদের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিতে চায় তারা। আমরা যেন সজাগ থাকি। আমরা কোন ভাষায় কথা বলবো, কি খাবো, কি পরবো, কি পড়াবো তার স্বাধীনতা যেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক অংশীজন যেন সীমা অতিক্রম না করে। আমরা যেন স্বাধীন বাংলার স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখি। যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি সেভাবে যেন আবার আমাদের স্বাধীনতা না হারাই।
লেখক: ন্যায় ও সুশাসন গবেষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়