প্রযুক্তি ডেস্ক : গ্রাফিন এমন এক উপাদান, যা মানবজাতির অনেক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে। এতদিন ব্যবহারিক জীবনে এই মূল্যবান পদার্থটির ব্যবহারে কিছু বাধা থাকলেও সম্প্রতি এর বড় এক বাধা দূর হয়েছে। গ্রাফিনকে ‘বিস্ময়কর উপাদান’ বলার কারণ হচ্ছে এটি একদিকে যেমন বিশ্বের সবচেয়ে পাতলা উপাদান, তেমনি এটি একইসঙ্গে অনেক বেশি শক্ত ও অনেক নমনীয়। ফলে, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং টিসু’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তিগত ডিভাইস তৈরিতে গ্রাফিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এতদিন বিজ্ঞানীদের শঙ্কা ছিল, এটি মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অর্থাৎ ব্যবহারিক জীবনে গ্রাফিন ব্যবহারের ফলে বড় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এখন গবেষকরা বলছেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রাফিন গ্রহনে মানবদেহে ফুসফুস বা কার্ডিওভাসকুলার ফাংশনে স্বল্পমেয়াদী কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। গ্রাফিনের প্রথম নিয়ন্ত্রিত ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’ ছিল এ গবেষণা, যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে অতি-বিশুদ্ধ গ্রাফিন অক্সাইড, যা পানিতেও ঠিকভাবে কাজ করে।
এই গবেষণায় ১৪ জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে কাজ করেছেন গবেষকরা, যারা ‘এক্সপোজার চেম্বারে’ সাইকেল চালানোর সময় মাস্ক পরিহিত অবস্থায় দুই ঘণ্টা নিজেদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রাফিন গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় মানবদেহের ফুসফুস, রক্তচাপ, রক্তের জমাট বাঁধা ও রক্তে প্রবাহের ওপর গ্রাফিনের প্রভাব কেমন ছিল, পরীক্ষার আগে ও পরে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকরা। এর দুই সপ্তাহ পর আরও কিছু পরীক্ষা চালানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের পুনরায় গবেষণাগারে ফিরিয়ে আনা হয়। গবেষকরা বলছেন, মানবদেহে ফুসফুস, রক্তচাপ বা অন্যান্য ক্ষেত্রে গ্রাফিনের নেতিবাচক প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকদের নজরে এসেছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এ উপাদান গ্রহণ করলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা যায়। তবে, গবেষকরা জোর দিয়ে বলছেন, এর প্রভাব ‘খুবই কম’। গবেষকরা বলেছেন, দীর্ঘ সময় গ্রাফিনকে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখলে সেটা স্বাস্থ্যে ঝুঁকি তৈরি করে কি না বা এর অন্যান্য রূপ মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে কি না, তা দেখতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। যুগান্তকারী উপাদানটি প্রথম বিজ্ঞানীদের নজরে আসে ২০০৪ সালে। সে সময় একে ‘বিস্ময়কর’ উপাদান বা ‘ওয়ান্ডার ম্যাটেরিয়াল’ বলে আখ্যা দেন বিজ্ঞানীরা। গ্রাফিন মূলত কার্বনের একটি রূপ, যা ষড়ভুজ এক জালির আকারে পরমাণুর একক স্তর নিয়ে গঠিত। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা সক্রিয়ভাবে গ্রাফিন নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে বোঝার চেষ্টা করছেন এটি ফুসফুস বা স্বাস্থ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে কি না।
‘ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গ’-এর ‘সেন্টার ফর কার্ডিওভাসকিউলার সায়েন্স’-এর গবেষক ড. মার্ক মিলার বলেছেন, “গ্রাফিনের মতো ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলো বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে দৈনন্দিন জীবনে গ্রাফিনের নিয়মিত ব্যবহার শুরু করার আগে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, এগুলোর তৈরি প্রক্রিয়া নিরাপদ কি না।”
“কীভাবে এ অনন্য পদার্থটি মানবদেহে প্রভাব ফেলতে পারে, তা বোঝার ক্ষেত্রে বড় এক পদক্ষেপ হল স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে গ্রাফিনের নিরাপদ ব্যবহার খুঁজে দেখার বিষয়টি।” “সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করলে আমরা নিরাপদেই এইসব ন্যানো প্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব।” ‘ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার’ ও বার্সেলোনা’র ‘কাতালান ইনস্টিটিউট অফ ন্যানোসায়েন্স অ্যান্ড ন্যানোটেকনোলজি’র অধ্যাপক কোস্তাস কোস্তারেলোস বলেছেন, “গ্রাফিন নিয়ে প্রথম নিয়ন্ত্রিত গবেষণা এটি, যেখানে সুস্থ মানুষের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে যে গ্রাফিন ‘অক্সাইড’-এর এমন এক অতি বিশুদ্ধ রূপ, যা নির্দিষ্ট আকারে ভাগ করার পাশাপাশি এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এমনভাবে উন্নত করা যেতে পারে, যা মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমিয়ে দেবে।”
“উপাদানগত ও জৈবিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ গবেষণা চালাতে আমাদের ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। এ ছাড়া, বিশ্বের নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের একত্র করে এমন ক্লিনিকাল গবেষণা চালানোর প্রথম ঘটনাও এটি।” ‘ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন’-এর মূল বিজ্ঞানী অধ্যাপক ব্রায়ান উইলিয়ামস বলেছেন, “এ ধরনের গ্রাফিন স্বল্প মেয়াদে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই তৈরি করা যেতে পারে, যা বিভিন্ন নতুন ডিভাইস থেকে শুরু করে চিকিৎসা, উদ্ভাবন ও পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন নতুন কৌশল তৈরির দরজা খুলে দিতে পারে।”