নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় পার্টি ‘চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে’ মন্তব্য করে দলকে ফের ‘সুসংগঠিত’ করার লক্ষ্য নিয়ে আগামী ৯ মার্চ জাতীয় সম্মেলন ডেকেছেন নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা রওশন এরশাদ।
গতকাল রোববার দুপুরে গুলশানে নিজের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে রওশন বলেন, “নেতা-কর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে আমি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে আগামী ৯ মার্চ পার্টির দশম জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা দিচ্ছি।“
৭ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়। দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন নিজে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জাতীয় পার্টি। নির্বাচনের পর পার্টি থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়, যারা রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত। এরপর গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ৬৭১ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সেই প্রেক্ষাপটে গত ২৮ জানুয়ারি এক মতবিনিময় সভায় রওশন নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে ‘অব্যাহতি’ দেন। তবে রওশনের ওই দাবি ‘আমলে নেননি’ জিএম কাদের বা চুন্নু। এরমধ্যে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জিএম কাদেরকে এবং উপনেতা হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে স্বীকৃতি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে রওশন বলেন, ‘কাজী ফিরোজ রশীদ এবং সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃবৃন্দ এবং এরশাদভক্ত সর্বস্তরের অগণিত নেতা-কর্মীরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা সবাই মিলে সুন্দর একটি জাতীয় সম্মেলন উপহার দিয়ে জাতীয় পার্টিতে আবার প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনতে চাই। কারণ দেশ ও জাতির জন্য রাজনীতির অঙ্গনে জাতীয় পার্টির প্রয়োজনীয়তা এখন অপরিহার্য।’
দেশে গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ভীত শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় পার্টি ‘সংগ্রাম করে যাচ্ছে’ দাবি করে রওশন বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সময় মতো পার্টির জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান। জাতীয় পার্টির সম্মেলন আয়োজনের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের যে ঘোষণা দিয়েছি সেই সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমি একটি সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেছি।’
রওশান সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের নামও ঘোষণা করেন। সেখানে আহ্বায়ক করা হয়েছে কাজী ফিরোজ রশীদকে। সহ-আহ্বায়ক সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, যুগ্ম-আহ্বায়ক হয়েছেন গোলাম সরোয়ার মিলন, সদস্য সচিব হলেন সফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জিয়াউল হক মৃধা। এছাড়া জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব, প্রেসিডিয়াম সদস্য, উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যান, যগ্ম-মহাসচিব, সম্পাদকম-লী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং জেলা কমিটির সভাপতি বা আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক বা সদস্য সচিব ক্রমানুসারে সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। সবাই থাকুক এক ছাতার তলে: কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, “দেশের বাজার পরিস্থিতিসহ নানা বিপর্যয় নিয়ে সংসদে যারা আছেন তারা কথা বলেন না, একতারা বাজিয়ে গান গান। এখানে কথা বলতে হবে। আমি মনে করি জাতীয় পার্টির এই কাউন্সিল অতীতের সকল কাউন্সিলের চেয়ে সুসংগঠিত হবে। সবাই জাতীয় পার্টিতে ফিরে আসবে। আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদ চান, জাতীয় পার্টির সবাই এক ছাতার নিচে যেন চলে আসে। আর এটার বাস্তবায়ন হবে আসন্ন কাউন্সিলেই।”
রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ‘পচা মাংসের দলা ফেলে দিয়ে নতুন উদ্যোমে জাতীয় পার্টি তৈরি হবে’ বলে মন্তব্য করেন পার্টির কো- চেয়ারম্যান ও ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। তিনি বলেন, “আমরা শুনেছি নিজের থেকে দল বড়, দলের থেকে দেশ বড়। আর এবার আমরা কি দেখলাম? দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে নিজে বড়, আর নিজের চাইতে স্ত্রী বড়। এইভাবে কোনো দল চলতে পারে না। তাই জাতীয় পার্টির প্রতি জনগণে যে প্রত্যাশা, তার প্রতিফলন এবার আমরা ঘটাতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি।”
রওশনের ঘোষিত মহাসচিব মামুনুর রশিদ বলেন, “আমরা আশা করব আগামী ৯ মার্চের সম্মেলনে দেশের অসংখ্য নেতাকর্মী যোগ দেবেন। পার্টিকে যারা কলুষিত করেছেন, নেতাকর্মীদের মনে আঘাত দিয়েছেন, আমি তাদেরকে বলব, আর পার্টিকে নিয়ে খেলা করবেন না। আপনারা অপরাধবোধ থেকে শর্তহীনভাবে ক্ষমা চান। আজ বাবলা, ফিরোজ ও সেন্টুরা যেহেতু রওশন এরশাদের পাশে আছেন, সুতরাং এবার বিপ্লব হবেই হবে।“ পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম সারোয়ার মিলন ও সাইফুল ইসলাম সেন্টু, অধ্যাপক দেলায়ার হোসেন খান, এরশাদের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
বাইরের কে কাউন্সিল ডাকল, তাতে আমাদের কী: চুন্নু: জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আমরা এখনও কোনো কাউন্সিল ডাকিনি। বাইরের কে কাউন্সিল ডাকলো না ডাকলো তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ গতকাল রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রওশন এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার যোগদানের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন তিনি। মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘কাজী ফিরোজ রশীদ সাহেবকে আগেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। তিনি যদি মূল দলের সঙ্গে না থাকতে চান, অন্য কোথাও যেতে চান, তাহলে পদত্যাগ করা দরকার ছিল। সেটা উনি কেন করেননি, আমার জানা নাই। কিন্তু উনি যেহেতু অন্য একটা দলে যাওয়ার চিন্তা করেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন, এটা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই চেয়ারম্যান তার সিদ্ধান্ত জানাবেন।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চার-পাঁচটা গ্রুপ আছে। মঞ্জু গ্রুপ, কাঁঠাল গ্রুপ, সাইকেল মার্কা, জাতীয় পার্টি মোম মার্কা। নতুন একটা হতেই পারে। সবারই স্বাধীনতা আছে। কেউ যদি জাতীয় পার্টির নাম ব্র্যাকেটবন্দি করতে চায় করবে।’ চুন্নু বলেন, ‘তবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে যে দল আছে, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১২, এটা ঠিক আছে। আমরা বলেছি সময় হলে আমাদের সম্মেলন করবো।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাপা মহাসচিব উল্লেখ করেন, ‘পার্টি ছেড়ে অনেকের চলে যাওয়ার সঙ্গে মূল্যায়নের কিছু নেই। একটা দল থেকে অনেকেই চলে যেতে পারে। এতে ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। একসময় বিএনপি ছেড়েও অনেকে চলে গেছে। খালেদা জিয়া হাউজ ওয়াইফ ছিলেন, অনেকে ভেবেছেন দল টিকবে না। কিন্তু বিএনপি টিকে গেছে। এখন আমার মতো সিনিয়র নেতারা চলে গেলেই দল টিকবে না, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে দেখা যাবে।’
জাতীয় পার্টিতে ‘প্রাণ ফেরাতে’ ৯ মার্চ সম্মেলন ডেকেছেন রওশন
জনপ্রিয় সংবাদ